বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ইউরোপিয়ানদের হুমকিতে কুর্দিদের ওপর হামলা বন্ধ হবে না

১৪ অক্টোবর, দ্য ডন : সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি নিরাপদ অঞ্চল গঠন করতে কুর্দি গেরিলার (ওয়াইপিজি) বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর কারণে ইউরোপের দুটি দেশ তুরস্কের কাছে অস্ত্র রফতানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফ্রান্স ও জার্মানি শনিবার ঘোষণা দিয়েছে, তারা তুরস্কে অস্ত্র রফতানি স্থগিত করছে।

এর জবাবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বলেছেন, ইউরোপিয়ানদের এ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞায় কুর্দি সন্ত্রাসীদের ওপর চালানো সামরিক অভিযান বন্ধ হবে না।

তুরস্কের সামরিক বাহিনী গত বুধবার সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ওয়াইপিজি গেরিলা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে।

ফ্রান্সের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, কুর্দি গেরিলাদের বিরুদ্ধে যেসব অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম তুর্কী সেনারা ব্যবহার করতে পারেন, তার সবই আঙ্কারার কাছে রফতানি করা বন্ধ থাকবে।

এর কয়েক ঘণ্টা আগে জার্মান সরকার তুরস্কের কাছে অস্ত্র রফতানি স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়। জার্মানি হচ্ছে তুরস্কের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ।

অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার পর ইউরোপিয়ানরা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রোববার এক ভাষণে এরদোগান বলেন, এসব হুমকি সত্ত্বেও কুর্দিদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে। ইতিমধ্যে সেখানে ২৪টি গ্রাম কুর্দিশূন্য করা হয়েছে। সেখানে তুরস্কে আশ্রয় নেয়া সিরীয় শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা হবে।

এখন পর্যন্ত যা দখল করেছে তুরস্ক

তুরস্ক সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ভেতরের দিকে প্রবেশের চেষ্টা করছে। রবিবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, তাদের সেনারা ১০৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে। এই এলাকার মধ্যে ২১টি গ্রাম রয়েছে।

সাংবাদিকদের এরদোয়ান জানিয়েছেন, সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ শহর রাস আল-আইন তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। যদিও এসডিএফ দাবি করেছে, তুর্কী বাহিনীকে তারা শহরের উপকণ্ঠে পিছু হটতে বাধ্য করেছে।

তুর্কী প্রেসিডেন্ট আরও জানিয়েছেন, সীমান্তের ১২০ কিলোমিটার ভেতরে তাল আবিয়াদ শহর দখল করেছে তুরস্কের সেনারা।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক যুদ্ধ পর্যালোচনাকারী সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, তুর্কিরা ওই এলাকার প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। রাস আল-আইন ও তাল আবিয়াদ শহর এসডিএফবিরোধী তুরস্কের অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

তুরস্ক আরও জানিয়েছে, তাদের মিত্ররা সিরিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। যা সীমান্তের ৩০-৩৫ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত।

হতাহতের সংখ্যা কত?

তুরস্কের সামরিক অভিযানে সীমান্তের উভয় পাশে বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে। সিরিয়ান অবজারভেটরি জানিয়েছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অর্ধশতাধিক বেসামরিক নাগরিক ও শতাধিক কুর্দি যোদ্ধা নিহত হয়েছে। এসডিএফ জানিয়েছে তাদের নিহত যোদ্ধার সংখ্যা ৫৬। তবে তুরস্ক বলছে নিহত কুর্দিদের সংখ্যা ৪৪০।

তুরস্কের দেওয়া তথ্য অনুসারে, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে ১৮ জন বেসামরিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া চার তুর্কি সেনা ও ১৬ জন তুর্কীপন্থী যোদ্ধা সিরিয়ায় নিহত হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবিক সহযোগিতা সংস্থা জানিয়েছে, অভিযান শুরুর পর ১ লাখ ৬০ হাজার বেসামরিক নাগরিক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সংস্থাটি নিজেদের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছে।

সিরীয় কুর্দিরা জানিয়েছে, তুরস্কের সামরিক অভিযান মোকাবিলায় সিরিয়ার সরকারের সঙ্গে তাদের একটি সমঝোতা হয়েছে। সমঝোতা অনুসারে সিরিয়ার সরকার দেশটির উত্তরাঞ্চলে সেনা পাঠাবে তুরস্কের অভিযান ঠেকাতে। গতকাল সোমবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এখবর জানিয়েছে।

এর আগে সিরিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে সরকারি বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দেশটির অবশিষ্ট সেনাদের সিরিয়ার ওই অঞ্চল থেকে প্রত্যাহারের পরপরই কুর্দিদের সঙ্গে সিরীয় সেনাবাহিনীর সমঝোতার কথা জানা গেলো।

গত সপ্তাহে শুরু হওয়া তুরস্কের সামরিক অভিযানের লক্ষ্য হলো সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে কুর্দি বাহিনীকে সরে যেতে বাধ্য করা।

সিরিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পুরো সপ্তাহজুড়ে ব্যাপক বোমা বর্ষণ হয়েছে। সীমান্তের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তুরস্ক। যুদ্ধে উভয়পক্ষের শতাধিক যোদ্ধা নিহত হয়েছে।

এদিকে, রবিবার কুর্দি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন তাদের বন্দী করা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিদেশি সদস্যদের অন্তত ৮০০ জন আত্মীয় আইন ইসা বন্দি শিবির থেকে পালিয়েছে।

সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে তুরস্কের সামরিক অভিযান ও যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমালোচনা করছে। সিরিয়ায় আইএসবিরোধী লড়াইয়ে পশ্চিমাদের প্রধান মিত্র ছিল এসডিএফ। কিন্তু তুরস্ক কুর্দিদের নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের শাখা মনে করে এবং সীমান্তের ৩০ কিলোমিটার গভীরে কুর্দিদের সরিয়ে সেফজোন প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। একইসঙ্গে তুরস্ক সিরীয় শরণার্থীদের ওই সেফজোনে প্রত্যাবাসন করতে চায়। সমালোচকরা বলছেন, এই অভিযানের ফলে কুর্দি জনগণ জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হতে পারেন।

সিরিয়া-কুর্দি চুক্তি সম্পর্কে যা জানা গেছে

উত্তর সিরিয়ার কুর্দি নেতৃত্বাধীন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সমঝোতার অংশ হিসেবে সিরিয়ার সেনাবাহিনী পুরো সীমান্তে মোতায়েন করা হবে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সিরীয় সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে তুরস্কের সেনাবাহিনী ও তাদের ভাড়াটে যোদ্ধাদের আগ্রাসন ও দখলকৃত এলাকা উদ্ধারে এসডিএফকে সহযোগিতা করবে। কুর্দিরা আরও জানিয়েছে, এই পদক্ষেপের ফলে তুর্কী সেনাবাহিনীর দখলকৃত আফরিনের মতো শহরও মুক্ত করার উপায় বের হবে।

২০১৮ সালে দুই মাসের অভিযানের পর তুরস্কের সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থিত সিরীয় বিদ্রোহীরা আফরিন থেকে কুর্দিদের পিছু হটতে বাধ্য করে এবং শহরটির দখল নেয়।

এই সমঝোতা কুর্দিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই এলাকায় দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সমর্থন ও সহায়তা প্রত্যাহারের পর তারা সিরিয়া সরকারের সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হলো। তবে সিরিয়া সরকারের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি।

তবে এসডিএফ প্রধান মাজলু আবদি স্বীকার করেছেন, আসাদ সরকার ও তার রুশ মিত্রদের সঙ্গে ‘সমঝোতা হবে বেদনাদায়ক’। ফরেন পলিসি সাময়িকীতে এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, আমরা তাদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করি না। সত্যি কথা হলো, আমাদের পক্ষে কাউকেই বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু যদি আমাদের সমঝোতা ও জনগণের গণহত্যাকে বেঁচে নিতে হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা জনগণকে রক্ষার পথই বেছে নেব।

গত সপ্তাহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আকস্মিকভাবে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে দেশটির মোতায়েনকৃত সেনাদের প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে তুরস্কের সামরিক অভিযানের পথ উন্মুক্ত হয়। আর এই অভিযানের ধারাবাহিকতায় সিরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছালো কুর্দিরা। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ঘটনাটিকে এসডিএফ বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ