শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মুসলিম শাসকগণ ছিলেন উদার ধর্মান্ধ নয়

মনসুর আহমদ : মুসলমান রাজা বাদশাহদের ইতিহাস কালো প্রচ্ছদে মোড়া গোপন ইতিহাস নয়। স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট ইতিহাসকে অনেক মুসলিম বিদ্বেষী ঐতিহাসিক বিকৃতভাবে পেশ করে মানুষকে ধোঁকায় নিমজ্জিত করতে চান। তারা ঈর্ষাকাতর হয়ে স্বেচ্ছায় মুসলিম ইতিহাসের বিখ্যাত বীরগণকে নানা ধরনের বিশ্রী উপাধিতে অভিহিত করে নীচু মনের পরিচয় দিয়ে থাকেন। এমন একটি মিথ্যা ও হীন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে সাম্প্রতিক কালের নতুন দিল্লী থেকে বিশ^ হিন্দু পরিষদ (VHP) কর্তৃক প্রকাশিত একখানা পুস্তকে। সেখানে মোগল স¤্রাট বাবর ও আওরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ ও গণহত্যাকারী  রূপে আখ্যায়িত করে লেখা হয়েছে, “Muslim should understand what kind of message they are sending by insisting on continuing the occupation of our sacred places, an occupation which was started by fanatics and mass murderers like Babar and Aurangzeb. we do not like to think of our Muslim compatriots as heirs and followers of much invaders and tyrants.”(The great Evidience Shri Ram janmobhoomi Mandir. Page- 36)
বাবর  ও আওরঙ্গজেব সম্পর্কে যে মন্তব্য করা হয়েছে তা হীন উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও মিথ্যা। প্রমাণ স্বরূপ এম. আর. শর্মা প্রণীত  “The crescent of India থেকে তার কথা তুলে ধরা যেতে পারে। বাবর তার একটি উইলে বলেছেন, People of diverse religions inhabit Hindusan, you should not not allow religious prejudice to influence yoyr mind, and administer impartial justice having the  due regard to religious susceptibilities and religious  customs of all sections of the people.  In particular refrain from the slaughter of cows, for that is the why to win the hearts of the people of Hindustan ... ... ...  You should never destroy the worship  of any community.. .. (P – 272 of S.R Sharma:The crescent of India) ... 
অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা হিন্দুস্তানে বসবাস করে। তোমাদের উচিত হবে না ধর্মীয় কুসংস্কারে মনকে প্রভাবিত করা। পক্ষপাতহীন শাসনব্যবস্থা চালু করাই তোমাদের কর্তব্য। সমস্ত ধর্মের প্রথা , রীতি নীতি ও অনুভূতির প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধা পোষণ করা উচিত।  বিশেষ করে গো হত্যা থেকে  বিরত থাকবে। এভাবেই তোমরা হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের হৃদয়কে জয় করতে পারবে. .. .. তোমাদের কখন উচিত হবে না কোন ধর্মীয় উপসনালয় ধ্বংস করা।  
বিশ^ হিন্দু পরিষদ বাবর ও আওরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ বলার কারণ হিসেবে বেছে নিয়েছে ফয়জাবাদ সেটেলমেন্ট রিপোর্টের উল্লেখিত মসজিদ নির্মাণ। Faizabad setettlement Report (1880)-এ উল্লেখ রয়েছে- The report confirms that Babar built the Babri Mosque in 1528 on the site of janmasthan  temple marking the birthplace of Ram. On swargadwar Mandir., Aurangajeb constructed a mosque, and on Tretaka- Thakur the same was done by either Auranagzeb  or Shajahan, according to well known Mohammedan practice of inforcing  their religion on others. The columns of the destroyed Janmasthan  temple have been used in the Babri Mosque.”
এই রিপোর্টটি যে পক্ষপাতদুষ্ট তাতে সন্দেহ নেই। কারণ  এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে,  অন্যদের উপর ইসলাম ধর্ম চাপিয়ে দেয়া মুসলমানদের অভ্যাস।  একথাটি যে সত্য নয় তার প্রমাণ ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দীঘর্ ইতিহাস।  এইপক্ষপাত পূর্ণ তথ্যের উপর নির্ভর করে বাবর ও আওরঙ্গজেবকে ধর্মান্ধ, গণ হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করণ একটি অনৈতিক কাজ।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. মাহমুদুল হাসান অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপসনালয়কে মসজিদে রূপান্তরের কারণ সম্পকে র্বলেন, গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরের যে নজির দেখা যায় তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে সকল বিজিত জাতি অধিকৃত অঞ্চলের গৃহসামগ্রী ও স্থাপত্য নিদর্শন প্রাসাদ ও মন্দির নির্মাণে ব্যবহার করেছে। রোমানগণ গ্রীকদের এবং বায়জানটাইনগণ রোমীয় এবং মুসলমানগণ বায়জানটাইন ইমারত দখল এবং সংস্কার করে সৌধ রচনা করেন। ... ... সমরাভিজানের সময় অথবা নতুন শহর স্থাপনের পর নাগরিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মসজিদ নির্মাণ করে নামাযের ব্যবস্থা অপরিহার্য। ... ... মসজিদকেও পরবর্তী পর্যায়ে বহু দেশে যাদুঘর বা বাসস্থান এমনকি মন্দিরেও রূপান্তরিত করা হয়। বিজিত দেশের কোন কোন উপাসনালয়কে মসজিদে রূপান্তর কিংবা মসজিদ রূপে ব্যবহারের কয়েকটি সংগত কারণ আছে। স্থানীয় অধিবাসীদের ইসলাম গ্রহণর ফলে পুরাতন উপাসনালয়টি তারাই মসজিদ রূপে ব্যবহার করেন। অথবা অধিবাসীদের দেশান্তর গমনের কারণে উপাসনা গৃহটি দীর্ঘকাল যাবত পরিত্যাজ্য অবস্থায় ছিল। খ্রিষ্টান শাসনামলে জেরুজালেমের বহু ইহুদী উপসনালয় ও গ্রীক মন্দির এই ভাবে পরিত্যাক্ত হয়। Solomon’s Great temple খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৯ সালে নেবুবাদনেজার (বাখতুনসর) কর্তৃক বিধ্বস্ত হয় এবং তিনি ইহুদীদেরকে জেরুজালেম হতে ব্যাবিলনে নির্বাসিত করেন। কয়েক শতাব্দী কাল পরে উক্ত স্থানেই মসজিদে আক্সা নির্মিত হয়। হজরত ওমর (রা.) জেরুজালেমের কর্তৃত্ব গ্রহণ ও খ্রিষ্টানদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার প্রদানের পর নামাযের সময় উপস্থিত হলে খ্রিষ্টান অধ্যক্ষ গির্জার মধ্যেই নামায পড়ার অনুরোধ জানালে তিনি তা এই বলে প্রত্যখ্যান করেন যে, তিনি এখানে নামায পড়লে পরবর্তীতে এটা মসজিদে রূপান্তরিত হব্ েতাই তিনি গির্জার নিকটে উন্মুক্ত স্থানেই নামায পড়েন।
এই নীতি সকল মুসলিম খলিফা ও রাজাবাদশাহ অনুসরণ করে চলেছেন। শুধু তাই নয় বিভিন্ন খলিফা মসজিদ নির্মাণ ও সংস্কারে অমুসলিম প্রকৌশলীদের সাহায্য গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেননি।উমাইয়া রাজত্বকালে জিয়াদ ইবনে আবদুল্লাহ কুফা মসজিদ সংস্কার করেন এই সংস্কার পরিচালনা করেন একজন পারসিক রুজবিহ ইবনে বুজুর্গ মিহির। 
খলিফা আল ওয়ালিদের অমর কীর্তি দামেস্কের জামে মসজিদ নির্মাণে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কারিগর ও স্থপতি সংগ্রহ করেন, বায়জাইনটাইন ও মাগরিবী ছাড়াও পারস্য ও ভারত বর্ষ থেকে আগত শ্রমিক ও কারুশিল্পি নিয়োজিত ছিলেন। খলিফা ইবনে ওয়ালিদের আমলে উমর ইবনে আবদুল আজীজ  মদীনা মসজিদের সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেন। নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য খলিফা মদিনায় ৮০ জন গ্রীক এবং কপটিক শিল্পী ও কারিগর প্রেরণ করেন।
কায়রোতে নির্মিত ইবনে তুল্ন মসজিদ সম্পর্কে আরব ঐতিহাসিকগণ বলেন যে, ইবনে তুল্ন যখন কোন ধ্বংসপ্রাপ্ত গির্জা থেকে সংগ্রহীত ৩০০ মার্বেল স্তম্ভ দ্বারা মসজিদ নির্মাণ পরিকল্পনা করেন তখন একজন কপটিক খ্রিষ্টান স্থপতি জানায় যে, মিহরাবের উভয় পাশের দুটি স্তম্ভ ছাড়া তিনি মসজিদটি নির্মাণ করতে সক্ষম। ইবনে তুল্ন এই খ্রিষ্টান স্থপতিকে মসজিদটি নির্মাণে তার সাহায্য গ্রহণ করেন।
হজরত উসমান (রা.) -এর খেলাফত কালে নুবিয়ার খ্রিষ্টান রাজা মারকানা মিশরের গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে আদকে (৬৪৪-৫৫-খ্রি.) উপহার স্বরূপ একটি মিম্বার প্রদান করেন। মিম্বারটি ফুসতাত মসজিদে সুষ্ঠুভাবে স্থাপনের জন্য একজন দক্ষ কপটিক কারিগর প্রেরণ করেন। বোকতার নামে এই কারিগর মেম্বার নির্মাণে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় প্রদান করেন। এভাবে দেখা যায় প্রথম যুগের খলিফাগণ মসজিদ নির্মাণে বিধর্মী স্থপতি ও কারিগর নিয়োগ করে ধর্মীয় উদারতার পরিচয় প্রদান করেন।
ইসলামের বিভিন্ন শাসনকালের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, কোন কালেই মুসলিম শাসকগণ বিধর্মীদের উপাসনালয় জোর করে গ্রহণ করে মসজিদে রূপান্তরিত করেননি। যেমন খলিফা  আল ওয়ালিদ মসনদে আরোহন করে মুসলমানদের জন্য নামাজের স্থান সংকুলান না হ্যওয়ায় প্রাচীন গ্রীক দেব মন্দির থেকে রূপন্তরিত গির্জাকে মসজিদ রূপে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। সুতারাং বলা যায় যে, ওয়ালিদ গির্জা জোর দখল এবং বিভক্ত করে মসজিদে রূপান্তরিত করেননি। তাঁর খিলাফতের পূর্বেই মুসলমানগণ গ্রীক প্রাচীন মন্দিরের পূর্বাংশ মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে এবং এই ব্যবস্থা প্রায় সত্তর বছর( ৬৩৭-৭০৬ খ্রি.) বলবৎ ছিল। ওয়ালিদ কেবল মাত্র পশ্চিম দিকে সেন্ট জনের গির্জাটি মসজিদের সম্প্রসারণের জন্য ক্রয় করেন। ইসলামের  বিধানে অন্য ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। কারণ ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ইসলামের প্রধান অঙ্গ। সুতারাং ওয়াফিদীর তথ্যানুযায়ী দামেস্ক বিজয়ের পর খ্রিষ্টানদের তাদের ধর্মমন্দির বা গির্জা থেকে বঞ্চিত করা হয়নি।
এই অবস্থা দেখা যায় কর্ডোভার জামে মসজিদ প্রসঙ্গে।  ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম বাহিনী স্পেন অধিকার করে কর্ডোভা নগরে অবস্থিত সেন্ট ভিনসেন্ট গির্জার অর্ধেক অংশে প্রথম মসজিদ স্থাপন করেন। বাকি অংশ গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ৭৫৫ সালে প্রথম আবদুর রহমান আদ দাখিল (৭৫৬- ৭৮৮খ্রি.)  সেখানে উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ডোভা মসজিদটিতে স্থান সংকুলান না হওয়ায়  প্রথম আবদুর রহমান গির্জার অংশ ক্রয় করে নিয়ে নতুন পরিকল্পনায় তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পূর্বে কর্ডোভার ইতিহাস বিখ্যাত জামি  মসজিদ নির্মাণ করেন।
মুসলিম শাসন কালের কোন স্তরেই অন্য ধর্মের গির্জা, মন্দির ধ্বংস করে সে স্থানে শক্তি প্রয়োগে মসজিদ নির্মাণের তথ্য পাওয়া যাবে না। বাবর ও আওরঙ্গজেবকে মসজিদ নির্মাণের অভিযোগে যে ভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে তা অযৌক্তিক ও বিদ্বেষ প্রসূত। বাবরের স্মৃতি কথা যা বাবর নামায় পুংখানুপুংখ ভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। বাবর নামা Annetle Susnal Beveridge 1922 সালে  অনুবাদ করেন যেটা পড়লে বোঝা যায় এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে,  যদিও বাবার একজন ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন কিন্তু তিনি সবার সকল ধর্মের প্রতি যথেষ্ট সহনশীল ছিলেন। এতে পরিস্কার বলা হয়েছে যে, মোগল সম্রাট তাঁর অভিযানকালে  বিভিন্ন মন্দির পরিদর্শন করেন। এবং এগুলির স্থাপত্য সৌন্দর্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। হিন্দু মন্দির ধ্বংস করার কোন আকাঙ্খার কথা এখানে উল্লেখ নেই।
বাবরের হিন্দু ধর্মের প্রতি উদারতা প্রকাশ করতে গিয়ে গৌতম রায় দৈনিক আনন্দ বাজার পত্রিকায় ৫ডিসেম্বর ১৯৯০ সালের লেখেন, “এ মসজিদ (বাবরী মসজিদ) বাবরের বানানো নয়। বাবর কখনো অযোধ্যায় পৌঁছে ছিলেন এমন প্রমাণ নেই। তাঁর অনুগত জনৈক মির বাকি ১৫২৮ সালে এটি তৈরী করান। তা করতে গিয়ে রামের কোন মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল , এমন প্রমাণও নেই। বাবর বা তাঁর অনুগত মিরের পক্ষে ক্ষীয়মান পাঠান রাজ শক্তি, যাকে উৎখাত করেই মুগল  রাজ শক্তির প্রতিষ্ঠা সম্ভব এং যে কাজে হিন্দু রাজা রানী, জায়গীর দার, ভূইয়াদের সক্রিয় সাহায্য অত্যাবশ্যক। হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সে সাহায্যের আশা বাবর কিছুতেই করতে পারেন না। হিন্দু রাজা রানীদের সহযোগিতা যোগ সাজস  এবং শরীকানাই যে বাবর সহ সমগ্র মুসলিম রাজ শক্তিকেই হিন্দুস্তানে প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্ব দিয়েছিল, এ তো আজ ঐতিহাসিক সত্য।
এইভাবে আওরঙ্গজেবের গোটা শাসনকালে কোন মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস কেউ দেখাতে পারেনি। এ ছাড়া আওরঙ্গজেব বহু হিন্দুকে তাঁর রাজ কার্যে উচ্চপদে রেখে ছিলেন। তিনি যে হিন্দুদের প্রতি খারাপ আচরণ করতেন এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। এ ছাড়া তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আজম শাহের প্রতি আম্বরের রাজা জয়সিংহ এবং যোধপুরের যশোবন্ত সিংহয়ের উত্তম আচরণ প্রমাণ করে যে, বাদশাহ আওরঙ্গজেবের রোষানলে হিন্দুরা কখনই ছিল না।
 আজ ইতিহাসের আলোকের সমস্ত সত্যকে আড়াল করে বাবর ও আওরঙ্গজেবকে গণহত্যাকারী বা স্বৈরাচারী আখ্যা প্রদান তাদের প্রতি অত্যন্ত জুলুম ও অন্যায় কাজ ব্যতীত কিছু নয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ