কুসুম ফোটার স্বপ্ন দেখেন বিলাল হোসাইন নূরী
তাজ ইসলাম : মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে।একজন কবি, লেখক,শিল্পী স্বাপ্নিক হন অন্য দশজন মানুষ থেকে একটু বেশি। বিলাল হোসাইন নূরী একজন গল্পকার। গল্পে বিস্তৃত করেন তার স্বপ্নের ভুবন। স্বপ্ন দেখেন সুন্দর সমাজের,আদর্শ মানুষের আর ভালোবাসা ও সমপ্রীতিময় এক বাংলাদেশের।"তার কল্পনায় উঠে আসে একাত্তর। স্বাধীনতা। মানচিত্র এবং পতাকা। সে স্বপ্ন দেখে,কখন এ দেশ হয়ে ওঠবে সত্যিই এক স্বপ্নপুরী। কখন ছোট- বড়,ধনী- গরীব,শত্রু- মিত্র সবাই এক হয়ে যাবে দেশ গড়ার প্রশ্নে। হাতে হাত রেখে গড়ে তুলবে ভালোবাসার নতুন বাংলাদেশ। ( স্বপ্নপুরী)। " নূরী তার স্বপ্নের জাল বিস্তৃত করেছেন "কুসুম ফোটার বেলা "গল্প গ্রন্হে। স্বপ্নপুরী এ গ্রন্হের প্রথম গল্প। প্রতিটি গল্পই তিনি লিখেছেন একেকটি সুন্দর কল্পনাকে অবলম্বন করে। যাতে আছে তার পাঠকের জন্য চরিত্র গঠনের অনুপম উপদেশ। নূরীর এ গ্রন্হের পাঠক শিশু কিশোর শ্রেণী। প্রত্যেকটি গল্পই যেন একটি বীজ রোপণ করেছেন শিশুর নরম মনে। গল্পের ভাষা সহজ,বর্ণনা সাবলীল,গল্পের গভীরে গ্রথিত আছে একটি করে বার্তা। যা গল্পকার পৌঁছে দিয়েছেন পাঠক হৃদয়ে সযতনে। গল্পগুলো আকারে ছোট হলেও শিক্ষণীয় অংশের গুরুত্ব প্রশংসনীয়।
"যুদ্ধ" গল্পে নানাভাই যুদ্ধের গল্প বলছেন। নাতি আমিন শুনছে। আমরা আমিন হয়ে গল্পের ভিতরে ঘুরে আসলাম, শেষ পর্যন্ত কোন গল্পই পেলাম না। গল্পকার যখন বলেন "গল্প এগিয়ে চলছে ধীরে ধীরে। নানাভাই আমিনকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। আমিন জানতে পারছে অনেক অজানা কথা।"এখন কেউ যদি আমিনকে প্রশ্ন করে সেই অজানা কথাগুলো কি? ইতিহাসের বাঁকটাই বা কি? আমিনের জন্য গল্পকার তার গল্পের প্লটে কোন উত্তরই রেখে যান নি। এটি শিশুদের উপযোগী লেখা বই। গল্পটি পড়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমন্ধে কোন ধারণাই শিশু মনে জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। অথচ সার্থক গল্পের শর্ত হিসেবে তার ছাপ রাখা ছিল অপরিহার্য। যেমন গল্পের ভিতর গল্প আছে এর পরের গল্প "চাঁদের খেয়ায় "। গল্পের একটি চিত্র অংকিত আছে "নদীর কাছে চিঠি "গল্পে। একজন সালমান তার দাদার কাছ থেকে জানতে পারছে নীল নদকে উদ্দেশ্য করে লেখা আমীরুল মুমেনীন হযরত ওমর (রাঃ) ঐতিহাসিক চিঠির ইতিহাস। পাঠক মনে অনুভূত হয় একজন শাসকের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার চিত্র। গল্পকারের সাফল্য এভাবেই ছড়িয়ে পড়া উচিৎ তার রচিত গল্পের পরতে পরতে।
পাতায় পাতায় বা প্রতি গল্পে কোরান হাদিসের উদ্ধৃতি দেয়া গল্পকারের পরিকল্পিত বৈশিষ্ট। উদ্ধৃতির পরিমাণ কম রেখে গল্পকে চরিত্র গঠনের লেখকের মননশীলতার ছাপ রাখতে পারলে আরো ভালো হত। গল্প বলার সময় ওয়াজ যতটা সম্ভব আড়াল রাখতে পারাই কাম্য। শিশু মনে এতে গল্পে উপভোগের আনন্দটা ব্যাহত হয়। সত্যটা,উদ্দেশ্যটা, শিল্পের মোড়কে, আনন্দের আবহে বর্ণনাতেই গল্পকারের মুন্সিয়ানা ফুটে উঠবে প্রকটভাবে। অবশ্য এসব অভিযোগ এ বইয়ের জন্য প্রযোজ্য নয়। কেননা গল্পকার তার বইটিকে সাজিয়েছেন ইসলামী গল্পের আবরণে। সে অর্থেই তিনি প্রতি গল্পে ধর্মীয় আবহ তৈরী করার প্রয়াস চালিয়েছেন। এতে তার উদ্দেশ্য সফল হলেও তৈরী হয়েছে সীমাবদ্ধতা। সর্বজনীনতার শরীরে উঠেছে একটি স্পষ্ট দেয়াল। নাম ধারণ করেছে ধর্মীয় গল্প। নববর্ষের আগমনে আমাদের সমাজে অনাহুতভাবে প্রবেশ করেছে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি। অল্প কথায় গল্পকার বিলাল হোসাইন নূরী সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন "নববর্ষ "গল্পে। দরিদ্রদের দানের নামে আমাদের ধনী সমাজের যে হীন মানসিকতা কাজ করে "শীতবস্ত্র " বিতরণের দৃশ্যায়নে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। এসব থেকে বেরিয়ে এসেছেন গল্পের নায়ক সালাম। সালাম নিজের জন্য যা পছন্দ করে তাই দান করেছে শীতকাতুরে মানুষের জন্য।পুরাতন, ব্যাবহারের অযোগ্য পোশাকাদি না দিয়ে সে নবীর হাদিসের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে তুলে দিয়েছে সদ্য কিনে আনা পোশাকসমূহ। বিলাল হোসাইন নূরী গল্প লিখেন মূলত সমাজ গঠনে অবদান স্বরূপ। শিশুরা সমাজের ভবিষ্যত। তাদের জন্যই তার লেখা। এ বইয়ের ২৭ টি গল্পের সবটিতেই আছে উপদেশের। শিশুতোষ গ্রন্হ হিসেবে মুদ্রণের ফন্টটি যথাযথ নয়। এটি পত্রিকা বা কিশোর পত্রিকার ফন্ট হয়ে গেছে। বাচ্চাদের বই বড় বড় হরফে ছাপা হলে তাদের পড়তে সুবিধা হয়। পড়তে আনন্দও পায়। বাংলাদেশে শিশুতোষ গ্রন্হের প্রচলিত ধারার ব্যতিক্রম এটি। একই বইয়ে অনেক ম্যাটার ঢুকিয়ে দেয়ার প্রবণতা হয়তো কাজ করেছে।" সোনালী বিচার " জ্ঞান অর্জনের তাগাদা এসেছে সুন্দর বিচারের প্রত্যশায়। আমরা মনে করি সুন্দর বিচার কেবল জ্ঞানী হলেই হবে না। জ্ঞানের সাথে সংযোগ হতে হবে আদল ও ইনসাফ। এবং উদ্ভাসিত হতে হবে ঐশী জ্ঞানের আলোতে। গল্পের স্যার বলেছেন "আমাদের ডুবে যেতে হবে জ্ঞানের সমুদ্রে। কুড়িয়ে আনতে হবে মুক্তো - মানিক। তবেই তো ন্যায় - বিচার, সুখ ও শান্তিতে আলোকিত হয়ে ওঠবে পৃথিবী।"এই যে ন্যায় বিচার, এর জন্য জ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশী খোদা ভীরু,ঐশী আলোর ঝলকানি অবশ্যই প্রয়োজন। আর এর পরিপূরক হিসেবেই নূরী লিখেছেন "তাকওয়া " ও "আমানত "র মতো গল্প।
একজন লেখককে একটি লিখা প্রস্তুত করার সময় অবলম্বন করতে হয় চতুর্মুখী সতর্কতা। শব্দ নিয়ে চাষাবাদ করেন কবি,সাহিত্যিকগণ। শব্দ চয়নে তাদের থাকতে হয় বিশেষ সতর্ক জ্ঞান। বাংলা ভাষা ভৌগলিকভাবে ও উচ্চারণগত পার্থক্যে স্পষ্টতই কিছুটা হলেও আলাদা বৈশিষ্ট নিয়ে হাজির হয় আমাদের সামনে। একজন লেখকের অবশ্যই উচিত তার নিজের দেশের ভাষার ব্যাবহারিক রূপটাকে তার সাহিত্যে প্রয়োগ করা। ভাষার লিখিত আর উচ্চারণগত প্রভেদ অবশ্যই ধরা পড়ে কলকাতার বাংলা আর বাংলাদেশের বাংলার মাঝে। আমরা যেখানে হীরাকে বলি হীরা,মুক্তাকে বলি মুক্তা,কলকাতার বাংলায় তা হীরে মুক্তো। ভাষা,ঐতিহ্যে আপোষহীনতা লেখকের কর্তব্যেরই অংশ। বিলাল হোসাইন নূরীদের সাহিত্যিক জীবনে জাতীয় প্রতিনিধিত্বশীল হতে হলে মুক্তো মুক্তার মতো বিষয়গুলো ধারণায় রাখতে হবে।
সাতাশটি গল্পের মূলভাব একজন পাঠকের মননে স্হান করে নিতে পারলে সে পাঠক হবেন একজন আদর্শ মানুষ। কেননা গল্পগুলো রচিতই হয়েছে কোরান হাদিসের ভাবরসের সমন্বয়ে। শিশুতোষ ধারার গল্পের এ বইটি ইসলামী শিশু সাহিত্যের চমৎকার একটি আয়োজন। বইটি সবার সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করবে। "কুসুম ফোটার বেলা " বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সাইফ আলি। প্রকাশনায়ঃ গ্রন্হকুঞ্জ প্রকাশন। মূল্য ১৮০ টাকা। আমরা বইটির প্রচার ও প্রসারে আশাবাদি।