শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বিলুপ্তির পথে দেশীয় মাছ

* ১০০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির হুমকিতে আর ৬৫ প্রজাতির পুরোপুরি বিলুপ্ত
মুহাম্মদ নূরে আলম : বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিচিত দেশীয় মাছ বাজার থেকে প্রায় নাই হয়ে গেছে। দেশী মাছের অভাব তীব্রতর হচ্ছে দিনদিন। কলকারখানার বর্জ্য, নদী খাল জলাশয় ভরাট, জমিতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, নদী ও হাওরে নাব্যতকা সংকট, পূজার সময় উজান থেকে পদ্মা ও যমুনা নদী দেব দেবীর মূর্তির বিষাক্ত রঙের কেমিক্যাল, দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাওয়ার বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।  দেশী প্রজাতির মাছ মানুষের দেহের পুষ্টি যোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক সময় বাজারে মাছের সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত। বাংলাদেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে ১০০ টির বেশি দেশীয় মাছ থাকলেও এখনো কোন মাছকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়নি। দেশীয় ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে থেকে দুই দশকের ব্যবধানে ৬৫ প্রজাতির মাছ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে, বিদেশীসহ ৩০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছের ব্যাপারে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার কাছে হালনাগাদ কোন তথ্য নেই। বিদেশি মাত্র ২৪ প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষের ব্যাপকতায় দেশী প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির হুমকিতে পড়েছে। তবে বাংলাদেশে এখন প্রতি বছর সাড়ে ৪২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি মাছ উৎপন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে নদী, বিল ও হাওরসহ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২৫ শতাংশ, পুকুর, ডোবার মত বদ্ধ জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ এবং বাকি অংশ সমুদ্র থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে ৮ লাখ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়।
মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদপ্তরের পৃথক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশী প্রজাতির প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। এসব গবেষণায় প্রাকৃতিক উৎসের মাছের বেশ কিছু ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। মাছের বিচরণ এলাকা নদী, হাওর বাওড় ও বিল দূষিত হয়ে যাচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, রাজধানীর চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বালু, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী প্রায় মাছশূন্য হতে চলেছে। এ ছাড়া দেশে এ পর্যন্ত ৩০টি আগ্রাসী প্রজাতির বিদেশি মাছ ঢুকে পড়েছে, যা দেশি ছোট মাছগুলো খেয়ে সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। দেশের কৃষিকাজে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ টন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা মাটি চুইয়ে জলাভূমিতে যায়। এর কারণে মাছের উৎপাদন কমছে। এ ছাড়া ধারাবাহিক দূষণ ও পলি পড়ে নদী ভরাট হওয়ায় মাছের বিচরণ কমে আসছে।
সূত্রে আরও জানাযায়, বর্ষা শেষে পানি সরে গিয়ে কিছু পানি হাওরের জলাশয়-বিল, ঝিল, নদী, নালা, খালে, ডোবায় তলানী হিসেবে জমা হয় । সেই সাথে হাওরের মুক্ত জলাশয় চড়ে-বেড়ে উঠা সব মাছ ওইসব বিল, ঝিল, নদী, পুকুরে আশ্রয় নেয়। ফলে এই হাওর জলজ প্রাণী বৈচিত্রের সঙ্গে বিশাল মৎস্য ভান্ডারও। দেশের উত্তর-পূর্বাংশে ৭টি জেলার ৪৭টি উপজেলা নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে ৯৫, সিলেটে ১০৫, হবিগঞ্জে ১৪, মৌলভীবাজারে ৩, নেত্রকোণায় ৫২, কিশোরগঞ্জে ৯৭ এবং ব্রাম্মণবাড়িয়ায় ৭টি মিলে মোট ৩৭৩ টি হাওর রয়েছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিজমিতে অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশক ও অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবহার, খাল-বিল-ডোবা ভরাট, উন্মুক্ত জলাশয়ে বাঁধ নির্মাণসহ মাছের বিচরণক্ষেত্রের প্রতিকূল পরিবর্তনের কারণে দিনদিন দেশীয় মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। মানুষ বাজার থেকে নিয়মিত দেশি মাছ কিনতেন। অনেকে নিজেদের পলো, জাল, বড়শি দিয়ে খাল, বিল, পুকুরে মাছ ধরতেন। এ ছাড়া বাঘাইড়, গোলসা, পাবদা, আইড়, নামাচান্দা, তারা বাইম, বড় বাইম, কালবাউশ, দাড়কিনাসহ প্রায় ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন। জলাশয়-ডোবা ভরাট, অবৈধ কারেন্ট জাল দিয়ে মাছ ধরা, জমিতে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারসহ মাছের অনূকূল পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
হাইব্রিড ফসল ও মাছ উৎপাদনের দিকে নজর দিতে গিয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছ নিধন নিশ্চিত করা হচ্ছে। দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর-ডোবা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশিয় প্রজাতির মাছ। প্রাকৃতিক উৎসে জন্মানো কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, চাপিলা, টাকি, রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, রিটা, পাঙ্গাশ, বোয়াল, খৈলসার, বাইলা, বাইম, মেনি বা চেদরি মতো সুস্বাদু দেশি মাছগুলো এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে।
মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, অধিক মুনাফার আশায় হাইব্রিড মাছের চাষ করতে গিয়ে জলাশয়গুলো থেকে দেশি মাছের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। দেশি মাছ খাদ্যগুণে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। চিকিৎসকরা শিশু ও বৃদ্ধসহ সব মানুষের পুষ্টির জন্য সাধারণত এসব দেশি মাছ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু বাজারে সরবরাহ না থাকায় এসব মাছের দাম খুবই বেশি। তাই ক্রেতার চাহিদা মেটাতে আবার পর্যাপ্ত পরিমাণ দেশি মাছ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা জরুরি।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন-পবা’র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, খাল-বিল, ডোবা-জলাশয়গুলোর শ্রেণি পরিবর্তন করে ইজারা না দেওয়া এবং নদী, খাল-বিল, জলাশয়ে অভয়াশ্রম সৃষ্টি করে প্রজননের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। এরই মধ্যে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজননের সুযোগ তৈরির জন্য ডাকাতিয়া নদীতে দুটি স্থানে অভয়াশ্রম করার প্রস্তাব দিয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা বিভিন্ন সময় চিঠি পাঠিয়েছেন। গণসচেতনতা তৈরি করে কৃষিজমিতে অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশকের ব্যবহার রোধ এবং মৎস্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা গেলে বিপন্ন প্রজাতির এসব মাছ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
তিনি আরও বলেন, এক সময় জলাভূমিতে দেশীয় প্রাচুর্য ছিলো। কিন্তু এখন বেশ কিছু প্রজাতির মাছ তেমন দেখা যায় না। দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছ বিলুপ্তির কারণে স্থানীয় জেলেদের দুর্দিন যাচ্ছে। বাঘাইড়, নানদিয়া, কালবাউশ, পাপদা, আইড়, নামাচান্দা, তারা বাইম, বড় বাইম, কাকিলা, ইংলা, দারকিনা, খলিশা, লাল খালিশা, বইচা খলিশা, কৈ, বাইল্লা, মেনি, কাঁটাচান্দা, রানী গুতম, বোয়ালি পাপদা, লালচান্দা, ছোট পাপদা, বাতাসি, কাজলি। বাঁশপাতা, বাছা, বুজুরি টেংরা, টেংরা কওয়াজঙ্গী, কেচকি, বোয়াল, চান্দা, গাংমাগুরসহ (চেকমেকা) প্রায় ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বলছে, এর মধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হবার পথে বাঘাইর, পিপলা শোল বা বাক্কা মাছ, মহাশোল, নান্দিলা মাছ, চান্দা, ভাঙ্গান বাটা, খরকি মাছ, কালো পাবদা, চেনুয়া মাছসহ বেশ কিছু মাছ রয়েছে। ময়মনসিংহে বাংলাদেশের একমাত্র মৎস্য জাদুঘরের সূত্রে জানাযায়, এই মুহহূর্তে দেশের ১১৮ প্রজাতির দেশীয় মাছ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। আইইউসিএন বাংলাদেশের বিপন্ন প্রাণীর তালিকা করার জন্য দুটি জরিপ চালিয়েছিল, ২০০০ সালে প্রথম জরিপে ৫৪ প্রজাতির মাছ বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এরপর ২০১৫ সালে সর্বশেষ জরিপে তাতে আরো ৬৪ প্রজাতির মাছ যুক্ত হয়। এই তালিকায় সেই সব মাছকেই চিহ্নিত করা হয়েছিল যেগুলো গত ১০ বা ২০ বছরে দেখা যায়নি। আইইউসিএনের এ সংক্রান্ত নিয়মটি হচ্ছে, সর্বশেষ কোন একটি প্রজাতির মাছের দেখা পাবার পর পরবর্তী ২৫ বছরে যদি সেই প্রজাতির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ না পাওয়া যায়, তাহলে সেটিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
মৎস্য জাদুঘরের সূত্রে আরও জানাযায়, আইইউসিএনের পরবর্তী জরিপে এগুলোর ব্যপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা থাকতে পারে। আইইউসিএনের ২০১৫ সালের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী কয়েকটি শ্রেণীতে মোট ৬৪ প্রজাতির মাছকে রেড লিস্ট বা লাল তালিকাভুক্ত করেছে, এর মানে হচ্ছে এসব প্রজাতির মাছ হয় প্রায় বিলুপ্ত, মহাবিপন্ন ও বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আপডেটিং স্পেসিস রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ শীর্ষক এক প্রকল্পের অধীনে এই তালিকা করা হয়। এ সংক্রান্ত প্রথম জরিপটি হয়েছিল ২০০০ সালে, সে সময় ৫৪টি প্রজাতিকে রেড লিস্টভুক্ত করা হয়েছিল। জরিপে মূলত স্বাদু পানির এবং আধা লোনা পানির মাছকেই গণনায় ধরা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ঐ রেড লিস্ট তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে আইইউসিএন এর সর্বশেষ মূল্যায়নে ২৫৩ প্রজাতির মাছের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে সময়ের বিবর্তনে যেসব মাছ বিলুপ্তপ্রায় তার বেশির ভাগই নদীর মাছ মানে স্বাদু পানির মাছ। তবে, ৩০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছের ব্যাপারে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার কাছে হালনাগাদ কোন তথ্য নেই।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানাযায়, বাংলাদেশে বিপন্ন মাছের মধ্যে রয়েছে ব- পাঙ্গাস, দারি, ককসা, টিলা বা হিরালু, টিলা ককসা, রানি বা বউ মাছ, বেতাঙ্গি, বেটি বা পুতুল মাছ, কালা বাটা, ঘর পোয়া, ঘর পইয়া, ঘোড়া মাছ, এলানগা, কচুয়া পুটি, বোল, চিতল, গজার, টেংরা, রিটা, গাঙ্গিনা বা চাকা মাছ, বট শিং, ঘাউড়া, সাল বাইম। এছাড়া সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে বাও বাইম, চাপিলা, গুতুম, পুঁইয়া, পিয়াসি, জারুয়া বা উট্টি, ছেপ চেলা, গোফি চেলা, বাটা মাছ, নারু মাছ বা গনিয়া, কাচকি, ফলি, শিল বাইলা, বেলে, শিং, আইড়, বোয়াল, তেলি, কুইচ্চা মাছ, বামোস মাছ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা গণমাধ্যমকে বলেন, মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে তিনি প্রথমেই জলাশয় কমে যাওয়াকে দায়ী করেন। শহর ও গ্রাম দুইখানেই নদী-খালসহ সব ধরণের জলাশয়ের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কমার সঙ্গে দিনে দিনে কমছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিমাণও। কেবল দেশী জাত ও স্বাদের মাছই নয়, এর সঙ্গে কচ্ছপসহ নানা ধরণের জলজ প্রাণী ও সরীসৃপের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে জমিতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, যা বৃষ্টিতে ধুয়ে খাল বিলসহ জলাশয়গুলোতে পড়ে। এর ফলে মাছের মৃত্যু ও প্রজনন হার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। আছে কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা হয়, তার ফলেও মাছ মরে যায়, বলেন মিজ ফাতেমা। এর সঙ্গে অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন-সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করাকেও কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন সংশ্লিষ্টরা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ