শিশুভুবনে ডিজিটাল আসক্তি
বাবা-মা শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। এ কারণে তারা চান শিশু লেখাপড়া করে বড় হোক, মানুষ হোক। কিন্তু নানা ঘটনায় এখন এই প্রশ্নও জাগে যে, বিদ্যালয়ে পাঠালেই কি শিশু বড় হবে, মানুষ হবে? এর সাথে এখন আবার যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল আসক্তির প্রসঙ্গ। উন্নত বিশ্বে এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের অভিভাবক, আমাদের সমাজ পিছিয়ে থাকায় ডিজিটাল আসক্তি প্রসঙ্গে কী করণীয় তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি আছে, আছে উদ্যোগের অভাবও। তবে উন্নত বিশ্ব জিডিটাল আসক্তি নিয়ে কি ভাবছে, কোন পথে সমাধান খুঁজছে তা জানলে আমরা হয়তো উপকৃত হতে পারবো।
বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করছেন, স্মার্টফোন ও সোস্যাল মিডিয়ার চর্চা মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। পাশ্চাত্যে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে ‘স্ক্রিন অ্যাডিকশন’ তথা ডিজিটাল আসক্তি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। অনেকে বিষয়টিকে মাদকদ্রব্য ব্যবহারের সাথে তুলনা করছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা দিনে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। খেলাধূলা কিংবা মুখোমুখি বসে কথা বলা, গল্প করার আগ্রহ কমে যাচ্ছে। এ রকম ক্ষতিকর প্রবণতার আশঙ্কা করেছিলেন প্রযুক্তি জগতের অনেক গুণীজনই। বিশ্বখ্যাত ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্টিভ জবস তার সন্তানদের নিজের প্রতিষ্ঠানের তৈরি আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেননি। তিনি একবার নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার আক্ষরিক অর্থেই সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বদলে দিচ্ছে। আর আমাদের ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কের যে কী ক্ষতি হচ্ছে তা শুধু স্রষ্টাই জানেন।’ মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ফোন ব্যবহার করতে দেননি। ফেসবুকের প্রথম চেয়ারম্যান সিয়ান পারকার ফেসবুক ছেড়ে দেয়ার পর ফেসবুক সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘এই যে ক্ষণিক ডোপামিন তাড়িত ফিডব্যাক লুপস আমরা তৈরি করেছি এটা আমাদের সমাজের স্বাভাবিক সক্রিয়তা নষ্ট করে দিচ্ছে। সামাজিক আলাপ-আলোচনা নেই, পারস্পরিক সহযোগিতা নেই, আছে ভুল তথ্য আর মিথ্যা।’ তিনি এখন আর ফেসবুক ব্যবহার করেন না। আর ফেসবুকের সাবেক এক্সিকিউটিভ এ্যাসিস্টেন্ট আথেনা শাভারিয়া বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত আমাদের ফোনের মধ্যে বাস করে শয়তান, সে ছেলেমেয়েদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে।’ তিনি তার নিজের ছেলেমেয়েদের হাই স্কুলে যাওয়ার আগে ফোন ব্যবহার করতে দেননি। এখনও বাড়িতে তাদের ফোন ব্যবহারের সময়সীমা কঠোরভাবে বেঁধে দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, কোন ক্লাসে সেই ছেলেটি বা মেয়েটি সবচেয়ে ভালো করবে যার হাতে ফোন পৌঁছবে সবার পরে। আমেরিকার সিনসিনাটি চিলড্রেনস রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষকরা সম্প্রতি ম্যাগনেটিক রেজোনেস ইমেজিং (এমআরআই) প্রযুক্তির সাহায্যে শিশুদের মস্তিষ্কের ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা লক্ষ্য করেছেনÑ শিশুরা যখন কিছু পড়ে তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ (ফাংশনাল ব্রেইন কানেকটিভিটি) বেড়ে যায়। আর যখন ডিজিটাল যন্ত্রের পর্দায় অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট দেখে তখন তাদের মস্তিষ্কের সংযোগ কমে যায়। তাই গবেষকদের পরামর্শ হলো, শিশুদের মস্তিষ্কের সুস্থ বিকাশে পড়ার সময় বাড়াতে হবে, আর কমাতে হবে স্ক্রিনে চোখ রাখার সময়।
ডিজিটাল আসক্তি যে ক্ষতিকর তা গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু শিশুদের এ ক্ষতি থেকে রক্ষার উপায় কী? এ প্রসঙ্গে নানা পরামর্শ এসেছে। তবে আমরা মনে করি, কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ তেমন ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। বরং মধ্যপন্থা অবলম্বনই সঙ্গত হবে, কারণ সেটাই মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচিত। এমন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে শিশু-কিশোরদের জন্য ডিজিটাল যন্ত্রের ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ না করে বরং তা ব্যবহারের সময় কমানো এবং অশ্লীলতা বন্ধের উপর জোর দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া পড়ার সময় বাড়াতে হলে ছোটদের মজার মজার বই সরবরাহ করতে হবে এবং বাবা-মাকেও সেই পড়ায় অংশ নিতে হবে, ওদের সাথে গল্প করতে হবে। এর পাশাপাশি মুখোমুখি আলাপন, খেলাধুলা, প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়াতে যাওয়া শিশু-কিশোরদের ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশে সাহায্য করতে পারে। এছাড়া নৈতিক মূল্যবোধ তথা শিষ্টাচার শিক্ষা শিশু-কিশোরদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে অবদান রাখবে বলে আমরা মনে করি।