বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪
Online Edition

আম-বাগানের ভুত

শেখ বিপ্লব হোসেন : বহুদিন আগের কথা। আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম। সবেমাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে বড় আপুর বাড়ি দুই কিলো দূরত্ব।

একদিন সকালে মা বললেন, “তোর বড় আপু তোকে আজ একবার যেতে বলেছে।” বড় আপুর বাড়ির কথা শুনে আমি ভীষণ আনন্দিত হলাম। কী জন্য? কেন যেতে বলেছে? আমি আর মাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস করলাম না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। বড় আপুর বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক আগে। তাঁর একটা ফুটফুটে বাচ্চা হয়েছে। নাম রাশেদুল ইসলাম। বয়স দুই বছর। বাচ্চাটিকে দেখতেও খুব মিষ্টি। ভাবলাম, মামা বলে কথা। সেখানে খালি হাতে যাওয়া যায় নাকি! মাকে বললাম, “আমাকে কিছু টাকা দাও! বাবুর জন্য কিছু চকলেট নিয়ে যাবো।” আমার কথা শুনে,মা তাঁর শাড়ির আঁচলের গিট খুলে আমাকে দুই টাকা দিয়ে বললেন, “এই দিয়ে কিছু নিয়ে যাস। হাতে টাকা-কড়ি নেই। তোর আপুর জন্য সঙ্গে কিছু ডিম নিয়ে যা। আমাদের বাড়ির মুরগীর ডিম। ডিম ওর খুব প্রিয়।”

আমাদের বাড়িতে অনেক মুরগী পুষতেন মা। মুরগীগুলো ডিমও দিতো অনেক। সেই ডিম বিক্রি করে মা টাকা জমাতেন। আমার স্কুলের খরচ দিতেন। যাহোক, মায়ের দেওয়া বেশ কয়েকটি ডিম নিয়ে পায়ে হেঁটেই বড় আপুর বাড়িতে গেলাম। যাওয়ার সময় মায়ের দেওয়া টাকা দিয়ে ছোট ভাগ্নের জন্য অনেকগুলো লজেন্স কিনে নিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে তো বড় আপু মহা খুশি! আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করলো। দুপুরবেলার খাবার খেয়ে ছোট ভাগিনাকে নিয়ে হৈহুল্লোড় করে সময় কাটালাম।

দেখতে দেখতেই বিকেল হয়ে এলো। আমি আপুকে বললাম, “আপু! আমি বাড়ি চলে যাবো। কাল স্কুল খোলা।” স্কুলের কথা শুনে, আপু আর আমাকে জোর করলো না। আমার হাতে ১০ টাকা গুজে দিয়ে বললো, “আমাদের দৌলতপুর হাইস্কুল মাঠে মেলা বসেছে। যাওয়ার সময় মেলা ঘুরে দেখে যাস।” আপুর দেওয়া টাকা পেয়ে আমি তো মহা খুশি!

তখন ছিলো বোশেখ মাস। বোশেখ মাসে গ্রামের হাট-বাজারে মেলা বসতো। বিকেল থেকে শুরু করে অনেকরাত অবধি মেলা চলতো। মেলায় নাগরদোলা, পুতুলনাচ, সার্কাসসহ নানারকম  বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতো। এ ছাড়াও শিশুদের জন্য বিভিন্ন খেলার সামগ্রী যেমন- চোরকিফুল, ফেইজকা পাখি, নানা রঙের বেলুন, বাঁশি, মাটির ঘোড়া, মাটির পুতুল, টমটমগাড়ি ইত্যাদি মেলায় পাওয়া যেতো । মেয়েদের জন্য  রঙবেরঙ  চুড়ি, আলতা-চুলের ফিতাসহ নানান কিছু। খাবার সামগ্রী হিসেবে  মিষ্টি, চমচম, দই, সন্দেশ, গুড়ের জিলাপি, ঝুরি, চিনির তৈরি নানারকম কারুকাজে  সুসজ্জিত হরেক রকম মিষ্টি খাবার পাওয়া যেতো।

বৈশাখী মেলা চলতো পুরো বোশেখমাস জুড়ে। বড় আপুর কথামতো মেলায় ঘুরতে গেলাম।

মেলায় ঢুকে পঞ্চাশ পয়সার বাদাম কিনে খেলাম। সারামেলা ঘুরে বেড়ালাম। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে কখন যে দিনের আলো নিবে গেছে, তা আমি বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ খেয়াল হলো অনেক রাত হয়েগেছে। ভাবলাম,  অনেক তো ঘোরা হলো। এখন বাড়িতে ফেরা যাক। আমাকে না পেয়ে মা হয়তো অনেক চিন্তা করছেন। মায়ের কথা মনে পড়তেই মেলা থেকে বেরিয়ে গেলাম। মেলা থেকে বেরিয়ে ভাবলাম, রাত অনেক হয়ে গেছে। এতরাতে মেইন রাস্তা দিয়ে না যাওয়াই ভালো। বরং গ্রামের ভিতর দিয়েই যাই। তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। আমি গ্রামের শর্টকাট রাস্তা ধরেই পথ চললাম। রাস্তার চারপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। রাস্তার দুপাশে ঘন বাঁশঝারে আবৃত।  মনে হচ্ছিলো যেন ভুতেরগলি।

রাস্তায় কোনো মানুষজন নেই। চারপাশ নিরব নিথর। আমি একা একা হাঁটছি। একটু ভয়ও হচ্ছিলো। তবু মনে সাহস নিয়ে পথ চলছি। কিছুদূর যেতে না যেতেই হঠাৎ ঝড়োবাতাস শুরু হলো। 

আকাশে মেঘপরীদের গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ। মাঝে মাঝে বিজলির ছটায় রাঙা আলো আমার সঙ্গী হয়ে পথ দেখায়। এমতাবস্থায় আমার মনে অজানা ভয় কাজ করতে লাগলো। আমি  হাঁটছি।

যেই বাঁশঝার পার করে আমবাগানের পথে হাঁটতে শুরু করলাম, তখনই বাধলো বিপত্তি। মনেহলো কে যেন আমার পাশদিয়ে চলে গেল। আমি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। আমার আগে পিছে ভালো করে দেখলাম। কিন্তু, কাউকে-ই দেখলাম না। ঘনকালো অন্ধকারে আমি কিছুই দেখলাম না। অন্ধকারে আমার চোখ অবসাদ হয়ে এলো। আমি দুহাতে চোখ দুটো পরিষ্কার করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু, নাহ! কিছুই দেখতে পারলাম না। 

তখন মনে হলো আমার সাথে একটা কিছু হতে যাচ্ছে। কিন্তু, কী হতে যাচ্ছে আমার অজানা!

হঠাৎ আনোয়ার স্যারের কথা মনে হলো। তিনি একদিন ক্লাসে ভুতের গল্প বলেছিলেন।

ভুতেরা নাকি গভীররাতে কাউকে একা পেলে ভয় দেখায়। পথ ভুলিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যায়! সুযোগ পেলে ভুতেরা নাকি মানুষের ঘাড় মটকায়! স্যারের কথা মনে পড়তেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমার গায়ের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেল। মনে হলো আমার শরীরটা অনেক ভারি লাগছে। আমি আর সামনে পা বাড়াতে পারছিলাম না। আমার পা পাথরের মতো জমে গেল।

ভয়ে আমার চোখ দুটো ভীষণ ব্যথা ও জ্বালা করছিলো। আমার গা ছমছম করছিলো। 

আশেপাশেও কেউ নেই। এখন কী করি! কিন্তু, কী আর করার! আমাকে তো এই পথ ধরে যেতেই হবে। নাহলে মা আমার জন্য খুব চিন্তা করবেন! মা হয়তো এখনো আমার জন্য জেগেই আছেন। মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে সামনে পা বাড়াতেই, বাবার কথা মনে হলো। বাবা একদিন বলেছিলেন, “যদি কখনো কোনো বিপদে পড়ো, আর যদি কোনো উপায় করতে না পারো, তাহলে মনে মনে কালিমা পাঠ করবে! মহান আল্লাহকে স্মরণ করবে। দেখবে, তোমার সব বিপদ চলে গেছে।” যেই ভাবা সেই কাজ। বাবার কথামতো আমি মনে মনে কালিমা পাঠ করতে শুরু করলাম। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করলাম। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই দেখলাম কালিমার জাদু! দোয়া পড়ার সাথে সাথে আমার শরীর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে লাগলো। আমার মন থেকে সমস্ত ভয় পালিয়ে গেল। ঝড়োবাতাস থেমে গেল। আমার চারপাশটা অনেক পরিষ্কার দেখতে পেলাম। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। দেখলাম, রাতের আকাশ তারায় তারায় খচিত। আমার মনটা আবার আগের মতো ঝলমলে হয়ে উঠলো। আমি তখন বাড়ির পথে পা বাড়ালাম।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ