বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

কাশ্মীর কি ভারতের অংশ ?

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : কাশ্মীরী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নটি দীর্ঘদিনের। আর এই ইস্যুতে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীরা দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। প্রতিনিয়তই স্বাধীনতাকামীদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ভূ-স্বর্গ খ্যাত জম্মু-কাশ্মীরের রাজপথ। বিষয়টি নিয়ে ভারতের পক্ষে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিষয়ক ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার মাধ্যমে সে আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলে দিয়েছে ভারত সরকার।
স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরী জনতার বিক্ষোভ ঠেকাতে সেখানে কারফিউ জারিসহ সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে টেলিযোগাযোগ সহ ইন্টারনেট পরিসেবাও। কাশ্মীরীরা অভিযোগ করছেন ভারত সরকার কাশ্মীরী নির্মম গণহত্যা চালানোর জন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কাশ্মীর বিষয়ে ভারত সরকারের পোড়ামাটি নীতির কারণে কার্যত এই উপত্যকা গোটা বিশ্ব থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তাই সেখানে বাস্তবে কি ঘটছে তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও ভারত সরকার সেখানে যে নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালাচ্ছে সে বিষয়টি মোটামোটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
জম্মু-কাশ্মীর যে ভারতের অংশ নয় তা হাইকোর্টের একটি ঐতিহাসিক রায়ে স্পষ্ট। ২০১৫ সালে প্রদত্ত এক রায়ে জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অংশ নয় এমনই সিদ্ধান্ত দিয়েছে জম্মু-কাশ্মীরের হাইকোর্ট। সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী এই ঘোষণা দেয় হাইকোর্ট। এই রায়ে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা পরিবর্তন, বাতিল ও সংশোধনযোগ্য নয় বলেও পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে। হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়েছে, ‘Kashmir is not part of India and thus can not be amalgamated in India. Under the article of 370 constitution, Kashmir is an autonomous area’. মূলত এই রায়েই প্রমাণিত হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অংশ নয় বরং ভারত এই ভূখন্ডের জবরদখলকারী।
জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে কোন বিতর্ক না থাকলে নিজেদের দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্যই ভারতই পরিকল্পিতভাবে এই বিতর্ক সৃষ্টি এবং দীর্ঘদিন তা জিইয়ে রেখেছে। বিষয়টি নিয়ে গবেষকরা বিভিন্ন সময় তাদরে অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করেছেন। প্রায় সকল গবেষণায়ই কাশ্মীরকে স্বাধীন ও স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে দেখানো হয়েছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে একজন ভারতীয় গবেষকের গবেষণা থেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এ গবেষণাপত্রটি ভাষণ আকারেই উপস্থাপন করেছিলেন জ্যোতিভূষণ দাসগুপ্ত। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং ‘Jammu and Kashmir ও I Indo-Pak Relations’ বই দু’টির লেখক। তার এই লেখনীর মাধ্যমে আমরা জম্মু-কাশ্মীরের প্রকৃত ইতিহাসের সাথে পরিচিত হতে পারবো। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্ত হওয়ায় লেখাটি অনন্য বলেই প্রতীয়মান হয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের কাগজ ‘মন্থন সাময়িকী’র ২০০০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সংখ্যা থেকে নেয়া হয়েছে।
তিনি তার লেখায় বলেছেন, ‘কাশ্মীর সমস্যার যে দিকটা খবরের কাগজে থাকে না, সে দিকটা নিয়ে আমি আপনাদের কিছু কথা বলবো। আসলে কাশ্মীরটা কী? দেশভাগের আগে ১৯৪১-এর ‘সেন্সসাস’ অনুযায়ী কাশ্মীরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ লাখ। আজকে ঠিক কত হবে আমি জানি না। কাশ্মীরে যারা বাস করেন তাদের মধ্যে আছে ডোগরা। ডোগরা নামটা অনেকে শুনেছেন। ওদের মধ্যে হিন্দু আছেন, আবার মুসলমানও আছেন। বর্ণ হিসাবে (Caste) ডোগরাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ আছেন, রাজপুত আছেন, ক্ষত্রিয়, মহাজন আছেন, সবার নীচে আছেন হরিজন। এই ডোগরারাই জনসংখ্যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল-যখন মহারাজা হরি সিং কাশ্মীর ছেড়ে চলে গেলেন। ডোগরারা থাকেন মূলত জম্মুতে’।
‘আরেকটা অংশ হল পাহাড়ী। পাহাড়ীরা থাকেন কাশ্মীর উপত্যকা আর জম্মুর মাঝখানে যে পাহাড়গুলি আছে তার মাঝখানের অঞ্চলে। এদের কথা বলার ভাষা মিশ্র হিন্দী, পাঞ্জাবী, ডোগরা আর সংস্কৃতি শব্দ নিয়ে তৈরী এই ভাষা’।
‘এরপর আছে গুজর। এরা হল জিপসী, বেদুইন জাতি। এরা কোথায় থাকেন ? এদের কোনো স্থায়ী আস্তানা নেই। পুঞ্চ, রিয়াসী, মুজফ্ফরাবাদ জেলায় এদের ভারী সংখ্যায় পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালে তারা পালিত ভেড়া, ছাগলের পাল নিয়ে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে পড়েন’।
‘এরপর হল কাশ্মীরী। এদেরই কথা আপনারা শোনান, যাকে বলা হয় কাশ্মীরীয়ত। এরা ইন্দো-এশিয়ান সভ্যতার অংশ। বর্তমানে এদের বেশীরভাগ মুসলমান হলেও, এই সমস্ত সভ্যতা ১৪শ’ শতকের আগে মোটামুটি হিন্দু সভ্যতা ছিল। এ ছিল প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার অংশ। এরা ছাড়াও কাশ্মীরে নিষাদ, খাসাস, দারাদ, ভাউট্রা, ভিক্সাস, দামারাস, তান্ত্রিন ইত্যাদি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। কিন্তু বাইরে থেকে অন্যান্য ভূখন্ড ও জনসমষ্টির সাংস্কৃতিক সম্মিলন কাশ্মীরে খুব হয়নি। হয়নি তার কারণ পাহাড়’।
‘পাহাড়ের কারণেই তখনকার দিনে লোকেরা কাশ্মীরে ঢুকে খুব বেশী কিছু করতে পারেনি। কাশ্মীর ছিল ভৌগোলিক কারণে বিচ্ছিন্ন। আবার এখানে যারা এসেছেন, তাদের কিন্তু কাশ্মীরীরা নিজেদের মধ্যে মিলিয়ে নিয়েছেন। ফলে যেটা হয়েছে তা হলো, সেই প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত এখানে এক ধরনের অ-সাম্প্রদায়িক জীবনযাপনের ভঙ্গি রয়েছে। উত্তর ভারতে যেমন আমরা দেখি- আমি হিন্দু, আমি মুসলমান। কাশ্মীরে গড়ে উঠেছে কাশ্মীরীয়ত। এর নিজস্ব স্বকীয়তা আছে’।
‘প্রথমে ছিল নাগা কালট্ (Cult) তারপর এল ব্রাহ্মণ্যবাদ (Brahminism), খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে বৌদ্ধধর্ম এলো কাশ্মীরে। বৌদ্ধরা বিহার এবং মন্দির বানিয়েছেন। এমনকি হিন্দু দেব-দেবতাদের উৎসর্গ করে সেগুলি তৈরী করেছেন। এক ধরনের বিশ্বাস থেকে অন্য ধর্মবিশ্বাসে উৎক্রমণ ছিল বরাবর শান্তিপূর্ণ। বাংলাদেশে যেমন হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে। জোর করে ধর্মান্তকরণ হয়নি। ১৪শ শতকে যখন প্রথম ইসলাম আসে কাশ্মীরে, এটা প্রথমে ছিল শান্তিপূর্ণ। এর মধ্যে ব্যতিক্রমও ছিল। যেমন ৫৫১-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দে মিহিরগুলের রাজত্বকালে বৌদ্ধ-বিরোধী ধর্মযুদ্ধ হয়েছে’।
‘১৫শ শতকে মুসলমান শাসক বুটসী খানের আমলে প্রবল অত্যাচার হয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে এত রাজত্ব পরিবর্তন হয়েছে, ধর্মের পরিবর্তন হয়েছে হাঙ্গামা হয়নি। এমনকি স্যার ওয়াল্টার রোপার লরেন্স (যিনি কাশ্মীরের সেটেলমেন্ট অফিসার ছিলেন) ‘দ্য ইন্ডিয়া উই সার্ভড বইতে লিখেছেন, ১৮৮৯ সাল পর্যন্ত একটাও সাম্প্রদায়িক ঘটনা তিনি কাশ্মীরে দেখেননি’।
‘কাশ্মীরে লিখিত ইতিহাস যা পাই, খ্রীষ্টপূর্ব ২৭৩ থেকে ২৩২-এ মৌর্য রাজা অশোকের সময় থেকে। এর আগের কথা লিখেছে কলহান, তার ‘রাজতরঙ্গিনী’ বইতে। এতে আগের দিনের ইতিহাস খুব প্রমাণ্য বলে মনে করেন না ঐতিহাসিকরা। কিন্তু তাঁর নিজের সময়টা অর্থাৎ ১১৪৮-৫০ মোটামুটি ঐতিহাসিক’।
‘মৌর্য রাজবংশের পর এল কুশানরা। তারপর এল গোনান্দরা-১৭৮ খ্রীষ্টাব্দে। এরপর ৫১৫-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দে কাশ্মীরে চলেছিল অত্যাচার হুন রাজবংশের মিহিরগুলের রাজত্বকাল। এইভাবে একটার পর একটা অত্যাচার কাশ্মীরে হয়েছে। দুঃখের কথা হলো আজ পর্যন্ত তারা কোনো ভাল গভর্নমেন্ট পায়নি। ফলে কাশ্মীরের লোকেরা কাপুরুষ হয়ে গিয়েছিলেন’।
‘এখনও কাশ্মীরের মানুষ মিহিরগুলের অত্যাচার মনে রেখেছেন। ৩ কোটি লোককে নাকি উনি মেরেছিলেন। মিহিরগুলের মৃত্যুর পর আসে গোনান্দা রাজবংশ। তারপর বিক্রমাদিত্য রাজবংশ। ১৯২ বছর ধরে এই হিন্দু রাজত্ব চলে। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ কাশ্মীরে এসেছিলেন ৬৩১-৩৩ খ্রীষ্টাব্দে। দারুণ বর্ণনা করেছেন তিনি কাশ্মীরের। উনি লিখেছেন, কাশ্মীরীরা দারুণ কাব্যিক, দারুণ সংস্কৃতিবান। দারুণ একটা জিনিস এরা তৈরী করে-শাল’।
‘মুসলমান শাসনের শুরুটা চমৎকার। ১৩০১-১৩২০ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দুরাজা সহদেব দু’জনকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাদের একজন এসেছিলেন লাদাখ থেকে-বৌদ্ধ রাজকুমার রিনচেন এবং আরেকজন এসেছিলেন দার্দিস্তানের সোয়াট উপত্যকা থেকে। তিনি ছিলেন মুসলমান, নাম শাহ্মীর। ১৩১৯ সালে তাতাররা কাশ্মীর আক্রমণ করে। সহদেব পালিয়ে যান। সহদেবের প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্রের মেয়ে কোটা রাণীকে বিয়ে করে রিনচেন রাজা হলেন। উনি প্রাণপন হিন্দু হওয়ার চেষ্টা করেন। হিন্দুরা ওকে হিন্দু হতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে উনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ১৩২৩-এ তাঁর মৃত্যুর পর কোটা রাণী সহদেবের ভাই উদয়নদেবকে বিয়ে করে তাঁকে সিংহাসনে বসালেন। ১৩৩৮-এ উদয়নদেব মারা গেলে শাহ্মীর রাজা হলেন। তখন থেকেই শুরু হল মুসলমান রাজত্বকাল’।
‘এরপর মুসলমান রাজত্ব চলল তিনপর্বে-স্বাধীন সুলতানি আমল, মোগল বাদশাহী আমল এবং আফগান আমল। তারপর এসেছে শিখরা। সমস্ত সময় জুড়ে প্রচন্ড অত্যাচার হয়েছে কাশ্মীরে। কেবল মোগলরা সেরকম অত্যাচার করেনি, কারণ তারা দেশ শাসন করতে জানত। সবচেয়ে বেশী করেছে আফগান ও শিখরা। হিন্দু রাজার সময়ও অত্যাচার হয়েছে। স্বাধীন সুলতানী আমলে হিন্দুদের উপর বেছে বেছে অত্যাচার হয়েছে। এর ব্যতিক্রম ছিলেন জয়নুল আবেদিন। সুশাসনের জন্য দু’জনকে কাশ্মীরের মানুষ মনে রেখেছে- জয়নুল আবেদিন এবং ললিতাদিত্য’।
‘শিখ রাজা রঞ্জিৎ সিং এর আমলে ডোগরা রাজপুত বংশের সন্তান গোলাব সিং তাঁর কমান্ডার নিযুক্ত হন। বৃটিশ শাসকদের সঙ্গে ‘অমৃতসর চুক্তি’-র মাধ্যমে ১৮৪৬ সালে জম্মু ও কাশ্মীর ৭৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে গোলাব সিং-এর শাসনে আসে। ১৯২৫ সাল থেকে হরি সিং রাজা হন। হরি সিং-এর রাজত্বকালে অত্যাচারের নমুনা এরকম ‘রিজিওনাল রেকর্ডস সার্ভে কমিশন অব দ্য কাশ্মীর গভর্নমেন্ট’ থেকে জানা যায় যে, মোট রাজত্ব আদায়ের মধ্যে শাসক নিজে নিত ১২.৫ শতাংশ, ৪০ শতাংশ যেত বিদেশে, মাত্র ৩০ শতাংশ পেত জম্মু এবং নামমাত্র ১৭.২৫ শতাংশ বরাদ্ধ ছিল কাশ্মীরের জন্য। কাশ্মীর ছিল এই রাজত্বের মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল অংশ। তাহলে বুঝুন কি রকম রাজত্ব চলত কাশ্মীরে’।
‘এই রাজত্বেই ১৯০৫ সালে জন্ম হল শেখ আব্দুল্লাহর। তিনি ১৯৩০ সালে এমএসসি পাস করেন। ‘অল ইন্ডিয়া কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্স’ বলে একটা সংগঠন ছিল পাঞ্জাবে। কাশ্মীরীদের মধ্যে যারা শিখদের অত্যাচারে পাঞ্জাবে পালিয়ে গিয়েছিল, তারা এবং কিছু পাঞ্জাবীরা লাহোর থেকে এই সংগঠন চালাতো। এরা গরীব মুসলমান ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ দিত। শেখ আব্দুল্লাহ এ রকম একটা স্কলারশিপ নিয়ে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন’।
‘১৯৩০ সালে তিনি এমএসসি পাস করে শ্রীনগর থেকে একটা সরকারী হাইস্কুল জুনিয়র টিচারের চাকরী পান। মাইনে ছিল মাসিক ৬০ টাকা। তখনকার দিনে ৬০ টাকা অনেক। জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। দাম বাড়তে থাকলো ’৪২-এর পর। শেখ আব্দুল্লাহ একটা ‘রিডিং রুম’ স্থাপন করেন শ্রীনগরে। সেখানে আলোচনা হত কাশ্মীরী মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা কিভাবে দূর করা যায়, লেখাপড়া কিভাবে শেখানো যায়। একই সময়ে গোলাম আব্বাস জম্মুর মুসলমানদের নিয়ে ‘ইয়ংমেনস্ মুসলিম এয়াসোসিয়েশন’ তৈরী করেছিলেন। অন্যদিকে লাহোরে কাশ্মীরী ও পাঞ্জাবী মুসলমানদের নিয়ে গঠিত ‘অল ইন্ডিয়া কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্স’ কাশ্মীরের রাজনীতি নিয়ে চর্চা করতো’।
১৯৩০-এ ইন্ডিয়াতে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়। গান্ধীর নেতৃত্বে এই আন্দোলনের কথা আমরা জানি। অন্যদিকে মহম্মদ ইকবাল তখন বলতে শুরু করেছেন মুসলমানরা স্বতন্ত্র। উত্তর-পশ্চিম ভারতে একটা মুসলমান বেল্ট তৈরীর কথা উনি বলেছেন। এই দুই ধরনের আন্দোলনের প্রভাব ছিল কাশ্মীরী মুসলমানদের মধ্যে। রিডিং রুম থেকে বিক্ষোভ শুরু হয় কাশ্মীরে। মুসলমানদের চাকরী দিতে হবে, লেখাপড়া শিখতে দিতে হবে। রাজা হটাও আন্দোলন তখনও শুরু হয়নি। বিক্ষোভ বাড়তে থাকে’।
‘মহারাজার বৃটিশ মন্ত্রী জিইসি ওয়েকফিল্ড রাজাকে একটা পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘একটা কাজ কর, এদের কাছ থেকে একটা ডেপুটেশন নিয়ে শোনো এরা কি বলতে চায়’। ১৯৩১’র ২১শে জুন, মুসলমানরা একত্র হয়ে ৭ জন প্রতিনিধি বাছাই করে। এই প্রতিনিধিরা ডেপুটেশনে যাবে। রাজাকে বলবে কি চাই তাদের। এই সময় আবদুল কাদির নামে এক পাচক হঠাৎ ওই সভায় এসে বলে-হিন্দুদের মারো, হিন্দুদের না মারলে কাশ্মীরীদের কিছু হবে না। হিন্দুদের মারো বললে হিন্দুরাজার আমলে শুনবে কেন? তাকে গ্রেপ্তার করা হলো’।
‘১৩ জুলাই যখন তাকে বিচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই সময় জনতা জেলখানার বাইরে জড় হয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। উপস্থিত সরকারী রক্ষীরা ভয় পেয়ে গুলি ছোড়ে। ২১ জন মারা যান। এইভাবে শুরু হল কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের। ১৯৩১’র ১৩ই জুলাই কাশ্মীরীদের স্মরণীয় দিন’।
‘১৯৩২ সালের জুলাই মাস। শেখ আব্দুল্লাহ দেখলেন এইভাবে আবেদন-নিবেদন করে চলবে না, আমাকে একটা রাজনৈতিক দল করতে হবে। তাঁর পরামর্শদাতা ছিলেন চারজন। যার মধ্যে প্রেমনাথ বাজাজ, গিরিধারীলাল ডোগরার মত হিন্দু ব্যক্তিরাও ছিলেন। প্রেমনাথ বাজাজই ওনাকে রাজনৈতিক দল গঠন করার পরামর্শ দেন। ১৯৩২-এ ‘অল জম্মু এ্যান্ড কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্স’ গঠন হয়। এইসব নানা আন্দোলন চলেছে। সাত বছর এই নামেই সংগঠন চলে’।
‘কিন্তু ১৯৩৯-এ এসে শেখ আব্দুল্লাহর মনে হল-আমরা তো শুধু মুসলমানদের হয়ে লড়াই করছি না। সত্যিই এই সাত বছর এঁরা যে আন্দোলন করেছেন তাতে শিখ ও হিন্দুরাও যুক্ত হয়েছেন। আন্দোলনটা কি? রাজার স্বৈরাচারী ক্ষমতা কমাতে হবে, এয়্যাম্বলী করতে হবে, ৭০ শতাংশ চাকরী মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে, আইন প্রণয়ন করতে হবে ইত্যাদি। সত্যিই মুসলমানদের কোন চাকরী ছিল না। পন্ডিতরা লেখাপড়া জানত, তাই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে তারা কিছু চাকরী পেত। সবচেয়ে বেশী চাকরী ছিল ডোগরা রাজপুতদের, ওরা রাজত্ব করতো। ম্যাট্রিক পাস না করে, এমনকি সই করতে না পেরেও তারা বড় বড় বিভাগীয় সেক্রেটারি পদে সরকারী চাকরী পেত। সুতরাং মুসলমানরা আন্দোলন তো করবেনই। আর তাতে হিন্দু, শিখরাও যোগ দিয়েছিলেন। এই আন্দোলনের নেতা হিসাবে শেখ আব্দুল্লাহ বুঝতে পারলেন যে তাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংগঠন করতে হবে। লড়াই তো মহারাজার বিরুদ্ধে। সুতরাং আলাদা কোনো দল নয়। ১৯৩২’র ‘মুসলিম কনফারেন্স-১৯৩৯’ এ নাম বদল করে হল ‘ন্যাশনাল কনফারেন্স’।
‘ন্যাশনাল কনফারেন্স কি করল? একটা ‘ন্যাশনাল ডিমান্ড’ পেশ করল-১৯৩৯’র ৩০শে সেপ্টেম্বর। তাতে তারা ‘যৌথ ভোট ব্যবস্থা’ চাইল, ‘দায়িত্বশীল আইন-প্রণয়ন’ চাইল এবং একটা আলাদা প্রস্তাবে কংগ্রেসের যুদ্ধ সম্পর্কিত মতকে সমর্থন করলো। এদিকে মুসলিম লীগে কোনো যুদ্ধ সম্পর্কিত নিজস্ব মত ছিল না, প্রচ্ছন্নভাবে বৃটিশের প্রতি সহানুভূতি ছিল। সুতরাং কাশ্মীরের এই ব্যাপারটা তাদের মোটেই ভাল লাগলো না’। ‘এইবার কংগ্রেসের কথায় আসি। বৃটিশ রাজত্বে দুটো ভাগ ছিল। একটা হল বৃটিশ ইন্ডিয়া, যাতে আমরা ছিলাম। আর একটা হল নেটিভ স্টেটস, ইন্ডিয়ান ইন্ডিয়া, যাকে আমরা করদ রাজ্য বলি। এদের সংখ্যা ছিল ৫৬৫। কিছু কিছু রাজত্ব খুব বড় ছিল, যেমন মাইসোর, কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ। অধিকাংশ ছিল ছোট। এদের সঙ্গে বৃটিশের সম্পর্ক কেমন ছিল? এরা নিজের নিজের এলাকায় সৈন্য রাখতে পারতো। কিন্তু কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারতো না, সেটা বৃটিশের এখতিয়ার। এরা এমনকি নিজেদের টাকা-পয়সাও তৈরী করতে পারতো। কিন্তু ইন্ডিয়ান মানি (বৃটিশ) চলতো সব জায়গায়। আভ্যন্তরীণ স্বশাসন, কিন্তু বাইরে বৃটিশের বিষয়, বাইরের পরিচয় তাদের কিছু ছিল না। ‘ডকট্রীন অব প্যারামাউন্টসী’ অনুযায়ী তোমরা রাজারা নিজেদের ব্যাপারটা দেখো। ইন্ডিয়ান ইন্ডিয়া বা নেটিভ স্টেট-এ গণতন্ত্র ছিল না, রাজত্ব ছিল খুবই খারাপ’।
‘সর্বভারতীয় কংগ্রেস কিন্তু এই নেটিভ স্টেটগুলিকে একটুখানি ক্ষমার চোখে দেখতো। কেন? তারা মনে করতো এইগুলি কতগুলি দুর্গ। এদের তাতিয়ে রাখলে দরকারমতো এদের দিয়ে বৃটিশকে আঘাত করা যাবে। যতদিন গেল, তারা বুঝতে পারলো যে আসলে পরের লড়াইটা করতে হবে বৃটিশ গভর্মেন্টের সঙ্গে। আর এই করদ রাজ্যগুলিকে আনতে হবে ইন্ডিয়ার মধ্যে। আনতে গেলে দুটো বাধা-রাজা নিজে চাইবে না ইন্ডিয়ার মধ্যে আসতে। বৃটিশ গভর্মেন্ট যখন বলেছিল তখনও তারা রাজী হয়নি। দ্বিতীয় বাধা হল প্রজা-রাজতন্ত্রে যার কোনো ক্ষমতা নেই। ফলে রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। আর দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে তারপর ইন্ডিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে’।
‘কংগ্রেস প্রথমে ছিল নিরপেক্ষ। পরে আস্তে আস্তে সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯২৭’এ ‘অল ইন্ডিয়া স্টেটস পিপল্স কনফারেন্স’ গঠন হল সব রাজ্যের মানুষকে নিয়ে। ১৯২৮’এ কংগ্রেস নেটিভ স্টেট বা করদ রাজ্যগুলির ব্যাপারে নির্দিষ্ট অবস্থান নিতে শুরু করে। ১৯৩৯’এ ‘অল ইন্ডিয়া স্টেট্স পিপল্স কনফারেন্স’-এর প্রেসিডেন্ট হলেন জওহরলাল নেহেরু। তিনি ঘোষণা করলেন-আমাদের দুটো জিনিস করতে হবে। রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ভিতরে গণতন্ত্র আনতে হবে। আর নেটিভ স্টেটকে ইন্ডিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। আমরা ‘ডকট্রীন অব প্যারামাউন্টসী’ মানি না। হয় ইন্ডিয়ায় যেতে হবে, নয় পাকিস্তানে যেতে হবে। স্বাধীন থাকতে পারবে না’।
‘১৯৪০ সালে নেহরু কাশ্মীরে যান। কাশ্মীরে যাওয়ার পর নেহেরু সঙ্গে শেখ আব্দুল্লাহর একটা সমঝোতা হয়। তারপর থেকেই ন্যাশনাল কনফারেন্স ‘নেহরুর লাইন’ ও কংগ্রেসের দ্বারা প্রভাবিত হয়। এইসব দেখে জম্মুর মুসলমান নেতা গোলাম আব্বাস ১৯৪১-এ আলাদা হয়ে ‘মুসলিম কনফারেন্স’ করেন। এই মুসলিম কনফারেন্সকে জিন্নাহ সমর্থন দেন, আর ন্যাশনাল কনফারেন্সকে কংগ্রেসের তল্পিবাহক আখ্যা দেন। সেখ আব্দুল্লাহর সঙ্গে জিন্নাহর সম্পর্ক খারাপ হয়’।
‘ন্যাশনাল কনফারেন্স ১৯৪৪-এ ‘নয়া কাশ্মীর’ পরিকল্পনা তৈরী করে। এটা সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ধাঁচে একটা কাশ্মীরী পরিকল্পনা। ১৯৪৬ সালে ন্যাশানাল কনফারেন্সের নেতৃত্বে শুরু হল ‘কুইট কাশ্মীর’ আন্দোলন। মহারাজা হরি সিংকে বলা হল-তুমি এককথায় তল্পিতল্পা নিয়ে কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাও। এই আন্দোলনটা কংগ্রেসী নেতারা খুব ভাল চোখে দেখেননি। কারণ কংগ্রেসী নেতারা কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসন চাইলেও হরি সিংকে কাশ্মীর থেকে তাড়াতে চাননি। এই আন্দোলনেও কিন্তু কাশ্মীরে হিন্দু ও মুসলমানরা একসঙ্গে ছিল। তখন কাশ্মীরের জনসাধারণ শেখকে ‘দেবতুল্য’ বলে মানতো’।
‘১৯৪৭-এ দেশ ভাগের সময় বৃটিশ গভর্নমেন্ট বলল কাশ্মীর ইত্যাদিরা স্বাধীন হয়ে যাবে। নেহরু এবং কংগ্রেস বললো-আমরা তা মানি না। আমরা মানি যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে বৃটিশ গভর্নমেন্ট যেমন নেটিভ স্টেটগুলির অধিকার পেয়েছে, আমরাও তেমনি সেগুলি ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার হিসেবে পাব। যারা পাকিস্তানে যাবে, তারা যেতে পারে। বাদ-বাকি স্টেটগুলি আসবে ইন্ডিয়ায়, সে তারা নিজেরা মানুক আর নাই মানুক’।
‘এই সময় বল্লভ ভাই প্যাটেল একটা বিভাগ খুললেন-স্টেট ডিপার্টমেন্ট, আমেরিকার মতো। ঐ বিভাগে সেক্রেটারি হয়েছিলেন ভিপি মেনন। ঠিক হল প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয়, যোগাযোগ- এই তিনটি বিষয়ে নেটিভ স্টেটগুলি ‘ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাকসেশন’-এর মাধ্যমে ১৫ই আগস্টের মধ্যে ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত হবে। সব রাজারা ১৫ই আগস্টের আগে সই করল এই ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’-এ। করল না কাশ্মীর, জুনাগড় এবং হায়দ্রাবাদ (তেলেঙ্গানা)’।
‘কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ঠিক করতে পারছিলেন না কি করবেন। যখন অক্টোবরে উপজাতি আক্রমণ শুরু হল, তারা মিউরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত এগিয়ে এল, তখন ভিপি মেনন শ্রীনগরে এসে মহারাজার সঙ্গে দেখা করলেন। দেখলেন মহারাজা পুরোপুরি ঘাবড়ে গেছেন। তিনি মহারাজাকে দ্রুত পরিবার ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে জম্মুতে চলে যেতে বললেন’।
‘সেই সময় জম্মু ও কাশ্মীরে প্রধান মন্ত্রী মেহেরচাঁদ মহাজন দিল্লিতে এসে নেহরুর সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘সৈন্য পাঠান, কাশ্মীরকে ইন্ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত করুন। আর জনসাধারণের দলকে যে ধরনের ক্ষমতা চান দিন। কিন্তু আজ সন্ধ্যার মধ্যেই সেনাবাহিনীর শ্রীনগরে যাওয়া দরকার। না হলে আমি জিন্নার কাছে যাব এবং তার সঙ্গে রফা করে শহরকে বাঁচাব। একথা শুনে প্রধানমন্ত্রী নেহরু উঠে দাঁড়ালেন, রেগে গিয়ে উনি আমাকে বেরিয়ে যেতে বললেন। যেই আমি বেরোনোর জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি, একটা ঘটনা ঘটল-যেটাই কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাত থেকে রক্ষা করলো। প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে শেখ আব্দুল্লাহ ছিলেন, তিনি আমাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। পরিস্থিতি খারাপ বুঝে উনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা ছোট্ট কাগজ পাঠান। প্রধানমন্ত্রী কাগজটা পড়লেন এবং বললেন-আপনি যা বলছেন সেটা আব্দুল্লাহরও মত। আর তাঁর মনোভাব পুরো পালটে গেল।’ আর এভাবেই জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হল’।
যদিও জ্যোতিভূষণ দাসগুপ্তের নিবদ্ধটি ত্রুতিমুক্ত বলে আমরা মনে করি না, তবে তার অভিসন্দর্ভে একথায় প্রমাণিত হয়েছে যে, জম্মু-কাশ্মীর কখনোই ভারতের অংশ ছিল না বরং তা স্বাধীন-স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতভুক্তির কোন সুযোগ নেই বরং জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ৪৭ নং রেজুলেশনের প্রস্তাব অনুযায়ী কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণভোটই এই সমস্যার একমাত্র ও গ্রহণযোগ্য সমাধান।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ