শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সঞ্চয়পত্রের লগ্নিতে মন্দা প্রসঙ্গ

ব্যাংকসহ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সরকারের নেতিবাচক নীতি ও কার্যক্রমের পরিণতিতে দেশে সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতেও আশংকাজনক মন্দা নেমেছে। নতুন অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রথম মাস জুলাইতেই সঞ্চয়পত্রে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ অর্ধেকে নেমে এসেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, পূর্ববর্তী বছরের প্রথম মাসে যেখানে ৫ হাজার ৩৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল সেখানে চলতি বছরের একই মাসে বিক্রি হয়েছে মাত্র ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই বিক্রি কমেছে ২ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকার। 

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরসহ অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, সঞ্চয়ের এই খাতটিতে বিনিয়োগ করতে গিয়ে মানুষকে নানামুখী ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। তাছাড়া সরকার শুধু উৎস করই বাড়ায়নি, বিভিন্ন ধরনের কড়াকড়িও আরোপ করেছে। পাঁচ লাখ টাকার বেশি টাকার সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর আগে যেখানে পাঁচ শতাংশ হারে উৎস কর ছিল, চলতি অর্থবছরে সেখানে একই উৎস কর দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া এক লাখ টাকার বেশি মূল্যমানের সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে টিআইএন সার্টিফিকেট দেখিয়ে প্রমাণ করতে হচ্ছে যে, তিনি একজন ট্যাক্সদাতা। শুধু তা-ই নয়, দেশের কোনো না কোনো ব্যাংকে তার আ্যাকাউন্ট থাকাকেও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এমন কড়াকড়ির অর্থ, ট্যাক্সদাতা না হলে এবং কোনো ব্যাংকে আ্যাকাউন্ট না থাকলে কেউ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন না। তাছাড়া একই ব্যক্তিকে একাধিক স্থান থেকেও সঞ্চয়পত্র কিনতে দেয়া হচ্ছে না।

উল্লেখ্য, আগে ব্যাংকের সুদের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে মুনাফা পাওয়া যেতো অনেক বেশি। যেমন পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ, পেনশন সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ মুনাফা দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি তিন বছর মেয়াদি মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ এবং ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। কিন্তু সরকারের সর্বশেষ নীতি ও সিদ্ধান্তের কারণে সুদের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্রের আয় অনেক কমে গেছে। তার ওপর রয়েছে নানা ধরনের কড়াকড়ি।

 দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে আরো জানানো হয়েছে, এসবই সরকার করেছে বিভিন্ন ব্যাংকের চাপ ও অনুরোধে। কারণ, বর্তমান সরকারের আমলে দফায় দফায় সুদের হার কমানোর পাশাপাশি কথিত জঙ্গিদের অর্থায়ন প্রতিহত করার নামে এমন কিছু কঠোর আইন কার্যকর করা হয়েছে যেসবের কারণে মানুষ ব্যাংকে টাকা জমানো প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিল। কিন্তু অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছে সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের পর। সুদের হার কমানোসহ কড়াকড়ির পাশাপাশি ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার বাড়ানোর ফলে বিনিয়োগকারী সাধারণ মানুষ আবারও ব্যাংকের দিকে ঝুঁকেছে । 

সঞ্চয়প্রত্রের বিক্রি কমে যাওয়ার পেছনে অন্য কিছু বিশেষ কারণেরও উল্লেখ রয়েছে দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে। সরকারের নেয়া ঋণ এগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রতি বছরই সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস তথা ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের খাত থেকে ঋণ নিয়ে থাকে কিন্তু কোনো বছরই নির্ধারিত বা ঘোষিত পরিমাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। যেমন বিগত অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয়পত্র খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের শেষে দেখা গেছে, সরকার ঋণ নিয়েছে প্রায় দ্বিগুণÑ ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। 

বর্তমান অর্থবছরেও সরকার সঞ্চয়পত্র খাত থেকে একইভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তথ্যাভিজ্ঞরা মনে করেন, এটাও সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। বিনিয়োগকারী সাধারণ মানুষ চায় না, বাজেট বাস্তবায়নের নামে তাদের কষ্টের অর্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হোক। সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা দেখার পর সরকারি বিনিয়োগে আস্থা রাখতে পারছে না জনগণের।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের নীতি ও কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যাওয়ার এবং মাত্র এক বছরের মধ্যে অর্ধেকে নেমে আসার খবর অত্যন্ত আশংকাজনক। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবং আমরাও মনে করি, একটির পর একটি করে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে এভাবে পতন ঘটানোর পরিণতি জাতীয় অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর হয়ে উঠতে পারে। কথাটা অকারণে বলা হচ্ছে না। স্মরণ করা দরকার, বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাংকে আমানত হিসেবে টাকা জমা রেখে, এমনকি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য এফডিআর করেও মানুষকে ঠকতে হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকে তিন মাসের জন্য এক লাখ টাকার এফডিআর করলে উৎস কর ও আবগারি শুল্ক কেটে রাখার পর আমানাতকারী ফেরৎ পেয়েছেন ৯৯ হাজার ৯৫৬ টাকা। অর্থাৎ কোনো লাভ বা মুনাফা দেয়ার পরিবের্তে ওই আমানাতকারীর কাছ থেকে উল্টো ৪৪ টাকা কেটে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকের সুদের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে মুনাফা অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছিল বলেই মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু এবার উৎস করসহ নানা পন্থায় সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রেও বাধার সৃষ্টি করেছে সরকার। ফলে বিক্রি তো কমেছেই, সঞ্চয়পত্রসহ সাধারণভাবে অর্থ জমানোর ব্যাপারেও আগ্রহ হারিয়ে মানুষ উল্টো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। 

বলা বাহুল্য, কোনো দেশের অর্থনীতির জন্যই এটা শুভ লক্ষণ নয়। আমরা তাই অপ্রয়োজনীয় কড়াকড়ি আরোপ এবং সুদের হার কমানোর মতো প্রশ্নসাপেক্ষ পন্থায় বিনিয়োগকারী সাধারণ মানুষকে নিরুৎসাহিত করার বিরোধিতা করি। সরকারের বরং এমন নীতি ও পন্থা নির্ধারণ করা উচিত, যার মাধ্যমে একদিকে ব্যাংকগুলো লাভজনক ব্যবসা করতে পারে এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষকেও ক্ষতিগ্রস্ত না হতে হয়। আমরা আশা করতে চাই, কখনো ব্যাংকের আবার কখনো সঞ্চয়পত্রের ওপর কড়াকড়ি আরোপের অবাস্তব নীতি ও কার্যক্রম থেকে সময় থাকতেই সরকার নিবৃত্ত হবে। জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধির স্বার্থেই এটা এখন বেশি দরকার।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ