বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আবুল মনসুর আহমদ : ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব

মুহম্মদ মতিউর রহমান : আবুল মনসুর আহমদ (জন্ম : ৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮, মৃত্যু : ১৮ মার্চ ১৯৭৯) একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ হিসাবে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন ও মুসলিম নবজাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সাংবাদিক হিসাবে আবুল মনসুর আহমদ ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুসলিম নবজাগরণে যে ভূমিকা পালন করেন, তাঁর সাহিত্য-চর্চা ও রাজনীতি এরই পরিপূরক বলা যায়। সাংবাদিক ও রাজনীতিক হিসাবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করলেও সাহিত্যিক হিসাবে তাঁর খ্যাতি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

আবুল মনসুর আহমদের জন্ম ১৮৯৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সাবেক ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে ধানীখোলা গ্রামে। গ্রামের পাঠশালা ত্রিশাল দরিরামপুরে পড়াশোনা করার পর তিনি ১৯১৭ সালে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক, ১৯১৯ সালে ঢাকা জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে আই.এ, ১৯২১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বি.এ. ও ১৯২২ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে বি.এল. পাশ করেন। অতঃপর তিনি কলকাতায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯২৩ সালে আবুল কালাম শামসুদ্দীন সম্পাদিত ‘মুসলিম ভাগ্য’ নামক সাপ্তাহিকে তাঁর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। এরপর ১৯২৩ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তিনি যথাক্রমে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সাপ্তাহিক ‘সুলতান’ ও মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’তে সহকারী সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৫-২৯ পর্যন্ত মৌলভী মুজীবর রহমান সম্পাদিত ‘দি মুসলমান’ পত্রিকায় কাজ করেন। অতঃপর ১৯২৯-৩৮ পর্যন্ত ময়মনসিংহ জজকোর্টে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু আইন ব্যবসায়ে মনসংযোগ করতে না পারায় তিনি পুনরায় ১৯৩৮ সালে ‘দৈনিক কৃষক’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত হন। ১৯৪৬-৪৮ সালে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের ‘নবযুগ’ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৪৬-৪৮ পর্যন্ত তিনি কলকাতাস্থ ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি আবুল মনসুর আহমদ রাজনীতির সাথেও সম্পৃক্ত হন। খেলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, স্বরাজ আন্দোলন, কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টি এবং পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন। ১৯৫৩-৫৮ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ১৯৫৬ সালে শিক্ষামন্ত্রী এবং ১৯৫৬-৫৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

সাহিত্যিক হিসাবে আবুল মনসুর আহমদের  অবদান বিশাল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। একাধারে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্য-রচনা, শিশু-সাহিত্য, আত্মজীবনী, রাজনীতি বিষয়ক রচনা ও ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণাপূর্ণ মননশীল রচনায় তিনি বাংলা  সাহিত্যকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের তালিকা :

উপন্যাস : ১. সত্য মিথ্যা (১৯৫০), ২. জীবন ক্ষুধা (১৯৫৫), ৩. আবেহায়াত (১৯৬৮)

গল্প : ১. আয়না (১৯৩৫), ২. ফুড কনফারেন্স (১৯৫০), ৩. আসমানী, ৪.পর্দা (১৯৫৫)

প্রবন্ধ : বাংলাদেশের কালচার (১৯৬৬) 

রাজনীতি বিষয়ক : ১. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (১৯৬৮), ২. শেরে বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু (১৯৭৩)

স্মৃতিকথা : আত্মকথা (১৯৭৮)

শিশু-কিশোর সাহিত্য :  ১. ছোটদের কাসাসুল আম্বিয়া (১৯৬৬), ২.গালিভারের সফরনামা (১৯৪৯)

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আবুল মনসুর আহমদের ছিল অকৃত্রিম মমত্ববোধ। ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পাকিস্তান পূর্বকালেই তাঁর সম্পাদিত কলকাতাস্থ ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারী প্রতিষ্ঠান ‘তমদ্দুন মজলিস’ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘তমদ্দুন মজলিসে’র উদ্যোগে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে জোরালো যুক্তিসহ তিনটি প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়। প্রবন্ধ তিনটি লেখেন যথাক্রমে আবুল মনসুর আহমদ, ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন ও অধ্যক্ষ আবুল কাশেম। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে এ গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। উক্ত প্রবন্ধে আবুল মনসুর আহমদ বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যুক্তিসহ জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন। 

আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একজন চিন্তাশীল লেখক ও বুদ্ধিজীবী। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে  তাঁর নিজস্ব চিন্তা ছিল। এক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা অন্যদের থেকে অনেকটা ভিন্ন এবং বাস্তবধর্মী। মাতৃভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ও মমত্ববোধ ছিল অপরিসীম। তিনি বাংলা ভাষার ইতিহাস, এর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, উৎকর্ষ ও এ ভাষার উপর নানাধরনের প্রভাব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বৌদ্ধ পাল শাসনামলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি, সেন আমলে দেশীয় ভাষা বাংলা চর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মুসলিম আমলে বাংলা ভাষা অর্গলমুক্ত হয় এবং তখন থেকে নানাভাবে এ ভাষা উৎকর্ষমন্ডিত হয়ে ওঠে। মুসলিম আমলে বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি, তুর্কি, উর্দু ভাষার অসংখ্য শব্দ আত্তীকৃত হয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ ও বিচিত্র ভাব প্রকাশের উপযোগী করে তোলে। ইংরাজ আমলে খৃস্টান পাদ্রী ও সংস্কৃত ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের যোগসাজশে বাংলা ভাষায় আত্তীকৃত আরবি, ফারসি, তুর্কি, উর্দু শব্দরাজি বর্জন করে দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দরাজি দিয়ে একধরনের কৃত্রিম ভাষা তৈরি করে এর নাম দেওয়া হয় ‘সাধু বাংলা’। ইংরাজ আমলে কলকাতা-কেন্দ্রিক কথ্য ভাষার ভিত্তিতে যে স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটে, সে ভাষার সাথে ভাটি বাংলা অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় প্রচলিত বাংলা ভাষার বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রচলিত আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দমিশ্রিত ভাষার সাথেও এর দুস্তর ফারাক। তাই আবুল মনসুর আহমদ এ ভাষাকে আমাদের ভাষা বলে মনে করেন নি। তিনি পূর্ববঙ্গে প্রচলিত কথ্যভাষার ভিত্তিতে, বিশেষত পূর্ববঙ্গের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষায় আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করেছেন। 

ভাষা মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠতম বাহন। ভাষা শুধু মনের ভাব প্রকাশেরই বাহন নয়; সাহিত্য, সংস্কৃতি জাতি ও রাষ্ট্রীয় পরিচয়েরও মাধ্যম। তাই ভাষার সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ‘বাংলাদেশের কালচার’ গ্রন্থে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে এ চিন্তাধারা প্রকাশ করে গেছেন। একটি দেশের যেমন একটি ভৌগলিক সীমারেখা থাকে, তেমনি একটি জাতিরও নির্দিষ্ট আদর্শ, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থাকে। এর মাধ্যমেই সে জাতির আত্মপরিচয় ও আত্মগৌরব তৈরি হয়। পরাণুকরণে অভ্যস্থ কোন জাতির আত্মসম্মান বা আত্মগৌরব বলে কিছু থাকতে পারে না। আমাদের সংস্কৃতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও গৌরবোজ্জ্বল। দীর্ঘ ইতিহাসের পথ ধরে বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক বিধি-বিধান, মূল্যবোধ ইত্যাদির ভিত্তিতে আমাদের সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছে। এ সংস্কৃতির লালন, চর্চা ও বিকাশের মাধ্যমেই আমাদের জাতিগত পরিচয়, গৌরব ও সমৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। 

আবুল মনসুর আহমদের ভাষাচিন্তা ও সংস্কৃতির ধারণা সম্পূর্ণ বাস্তব ও ইতিহাসসম্মত। আমরা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে পরাণুকরণে অভ্যস্ত। কিন্তু পরাণুকরণ হীনমন্যতাবোধের পরিচায়ক। এক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদের চিন্তাধারা অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি গঠনের উপযোগী। তরুণ প্রজন্মকে তাই আজ তাঁর চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় এগিয়ে আসা কর্তব্য। তিনি এক্ষেত্রে আমাদেরকে যথার্থ পথ-নির্দেশনা প্রদান করেছেন। 

পাকিস্তান আন্দোলনের পটভূমিতে বিশেষত ১৯৪০ সালে  ‘লাহোর  প্রস্তাব’ গ্রহণের পর কলকাতায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে এ ভাষা-সচেতনতা সংগঠিত রূপ লাভ করে। ১৯৪৪ সালের ৫ মে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ মিলনায়তনে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির প্রথম সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে আবুল মনসুর আহমদ বলেন : “বস্তুত বাংলার মুসলমানদের যেমন একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, তেমনি তাদের একটা নিজস্ব সাহিত্যও আছে। সে সাহিত্যের নাম মুসলমানী বাংলা সাহিত্য বা পুঁথি সাহিত্য।... পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যিক রেনেসাঁ আসবে এই পুঁথি সাহিত্যের বুনিয়াদে। আমরা আবার পুঁথি সাহিত্যে ফিরে যাব সে কথা বলছি না। আমার মতলব এই যে, বাঙালী মুসলমানদের সাহিত্যের প্রাণ হবে মুসলমানদের প্রাণ এবং সে সাহিত্যের ভাষাও হবে মুসলমানেরই মুখের ভাষা। এই দুই দিকেই আমরা পুঁথি সাহিত্য থেকে প্রচুর প্রেরণা ও উপাদান পাব। ... আজকার তথাকথিত জাতীয় সাহিত্যে বাংলার মেজরিটি মুসলমানের জীবনই যে শুধু বাদ পড়েছে তা নয়, তার মুখের ভাষাও সে সাহিত্যে অপাংক্তেয় রয়েছে। মুসলমানদের আল্লা-খোদা, রোযা-নামায, হজ্জ-যাকাত, ইবাদাৎ-বন্দেগি, অযু-গোসল, খানাপিনা সমস্তই বাঙলা সাহিত্যের দিকপাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের কাছে বিদেশী ভাষা। এ যুলুমবাজির মধ্যে কোনো জাতির সাহিত্য গড়ে উঠতে পারে না। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য রচিত হবে পূর্ব পাকিস্তানীদের মুখের ভাষায়।”

আবুল মনসুর আহমদ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে এ ধারণায় উপনীত হন যে, মুসলিম শাসনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ বঙ্গ, পু-্র ও বঙ্গাল এ তিনটি জনপদে বিভক্ত ছিল। ভাষা-সাহিত্যের দিক দিয়ে এ তিনটি জনপদ আবার দুটি সাংস্কৃতিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিলÑ বর্তমান বাংলাদেশ মানে তৎকালীন পু-্র-বংগাল ছিল বঙ্গ এলাকা এবং অন্যটি ছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ মানে তৎকালীন বঙ্গ ছিল অবঙ্গ বা অঙ্গ এলাকা। গুপ্ত ও পাল শাসনামলে উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যের অঙ্গ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ ছিল বিশুদ্ধ সংস্কৃতের আওতাভুক্ত। পক্ষান্তরে, পু-্র-বঙ্গাল বৌদ্ধ-সংস্কৃতির আওতাভুক্ত ছিল। বৌদ্ধ-সংস্কৃত ছিল মাগধী-প্রাকৃত দেশজ ভাষাসমূহের সংমিশ্রণে সৃষ্ট চলতি ভাষা। পরবর্তীতে এ ভাষা থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি ঘটে। এভাবে গোটা বাংলা তৎকালে দুটি স্বতন্ত্র ভাষিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চলে বিভক্ত হয়। ভাষার এ স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ১৯৩৯ সালে তাঁর ‘ভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন : “বাংলা একটা নয়, দুইটা। বাংলাদেশের ইতিহাস খ-তার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ রাঢ়-বরেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয় অন্তরেরও ভাগ। সমাজেরও মিল নাই। এতকাল যে আমাদের বাঙালী বলা হয়েছে, তার সংজ্ঞা হচ্ছে আমরা বাংলা বলে থাকি।”

বিভাগ-পূর্বকাল থেকেই ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুজীবর রহমান খাঁ, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী প্রমুখ সে কথা বলে আসছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আবুল মনসুর আহমদ তাঁর এ স্বতন্ত্র ভাষার দাবিকে সুস্পষ্ট ও অকাট্য যুক্তিসহ তুলে ধরেন। তিনি বলেন : “আমাদের নিজস্ব কালচার বিকাশের ও নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির জন্য চাই আমাদের নিজস্ব ভাষা। আমাদের নিজস্ব ভাষা বাংলা, একথা আজ যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট নয় দুই কারণে। এক কারণ ঐতিহাসিক, অপর কারণ রাজনৈতিক।

“ঐতিহাসিক কারণ বাংলা ভাষার ইতিহাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলা ভাষার স্রষ্টা ও বাংলা সাহিত্যের পিতা আসলে বাংলার নবাব-বাদশারাই। সে হিসাবে বাংলা মুসলমানদের নিজস্ব ভাষা। কিন্তু প্রায় দু’শ বছরের ইংরেজ শাসালে বাংলা ভাষার ও সাহিত্যের বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়েছে।... ঊনিশ শতকের গোড়া হইতে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বাংলা, ছিল প-িতী ভাষা। ঊনিশ শতকের শেষ দিক হইতে টেকচাঁদ ঠাকুর, দ্বিজেন ঠাকুর ও রবিঠাকুরের শক্তিশালী কলমের জোরে ভদ্রলোকের প-িতী বাংলা জনগণের ভাষায় রূপান্তরিত হইবার চেষ্টা করে। এমন কি, স্বয়ং, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতেও এ চেষ্টা প্রতিফলিত হয়।... দ্বিজেন ঠাকুর, রবিঠাকুর ও শরৎচন্দ্রের চেষ্টায় বাংলা ভাষা বড় জোর পশ্চিম বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাষা হইতে পারিয়াছিল। প্রকৃত জনগণের ভাষা হইতে পারে নাই। কারণ বাংলার আসল জনগণ যে মুসলমানরাও এবং তাদের ভাষাও যে জনপদের ভাষা, এ সত্য হয়ত ঐ মনীষীদের নিকট ধরাই পড়ে নাই।

“তারপর নজরুল ইসলাম তাঁর অসাধারণ প্রতিভা নিয়া ধূমকেতুর মত বাংলা সাহিত্য ও ভাষার আকাশে উদিত হন এবং মুসলিম বাংলার ভাষাকে বাংলা সাহিত্যের ভাষা করিবার সফল চেষ্টা করেন। নজরুলের এই চেষ্টার যে বিরুদ্ধতা আসে সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতা হইতে, তাতে শুধু সাম্প্রদায়িক তিক্ততাই বাড়ে না, হিন্দু-বাংলা ও মুসলিম-বাংলার কালচারের পার্থক্যও তাতে সুস্পষ্ট হইয়া উঠে।...

“রাজনৈতিক কারণ একেবারে আধুনিক। আজ বাংলা ভাগ হইয়াছে। এক বাংলা দুইটা স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের রূপ নিয়াছে। এতে বাংলা সাহিত্য ও ভাষার কি পরিবর্তন হইয়াছে, এইটাই আমাদের ভাল করিয়া বিচার করিতে হইবে।... (এক) বাংলা ভাগ হওয়ার আগেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলিম-বাংলার ভাষা ও হিন্দু-বাংলার ভাষায় একটা পার্থক্য ছিল।... (দুই) বাটোয়ারার আগে বাংলার রাজধানী সুতরাং সাহিত্যিক কেন্দ্র ছিল কলিকাতা। এখন সে জায়গা দখল করিয়াছে ঢাকা।” (১৯৫৮ সালের ৩ মে চাটগাঁয় অনুষ্ঠিত পূর্ব-পাক সাহিত্য-সম্মিলনীর কালচার ও ভাষা শাখার সভাপতির ভাষণ)।

ভাষা-চিন্তায় আবুল মনসুর আহমদ কতটা বাস্তববাদী ও প্রাগ্রসর তা উপরোক্ত বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট। ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে তিনি আমাদের ভাষার রূপ, পরিচয় ও ভবিষ্যতে তা কী রূপ পরিগ্রহ করতে পারে বা করা বাঞ্ছনীয় সে সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করেছেন, দীর্ঘকাল পরে বর্তমান স্বাধীন বাংলার পরিবর্তিত পরিবেশেও তা একান্তভাবে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়। বাংলা ভাষা স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। বাংলাদেশের প্রায় ষোল কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ঢাকা শুধু বাংলাদেশেরই রাজধানী নয়, বাংলা ভাষা-সাহিত্য চর্চা ও বিকাশেরও প্রধান কেন্দ্র। ২০০০ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা দেয়। এর প্রেক্ষিতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আবুল মনসুর আহমদের ভাষা-চিন্তা ও তাঁর যৌক্তিক অভিমতকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার সময় এসেছে। আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তার ক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদের চিন্তা-চেতনা কতটা বাস্তবসম্মত ও প্রাজ্ঞচিত, তা রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্যেও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেন : “সাহিত্যের প্রাণধারা প্রবাহিত হয় রাজধানীকে কেন্দ্র করিয়া। ঢাকাই যদি সারা বাংলার রাজধানী হইত তাহা হইলে ঢাকা-কেন্দ্রিক উপভাষাই হইত সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ভাষা। এই নিয়া দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা মুখ বাঁকা করিলে সেই বক্রতা আপনিই সোজা হইয়া যাইত, মানভঞ্জনের জন্য অধিক সাধাসাধি করিতে হইতনা।”

বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যপূর্ণ সার্থক অবদানের জন্য আবুল মনসুর আহমদ ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (ছোটগল্প) লাভ করেন। রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভাষা-চিন্তার ক্ষেত্রে অসামান্য ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য আবুল মনসুর আহমদ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ মহান ব্যক্তি ১৯৭৯ সালের ১৮ মার্চ ইন্তিকাল করেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ