শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

চামড়া শিল্পে বিপর্যয়ের দায়ভার

এইচ এম আব্দুর রহিম : দেশের ইতিহাসে গত ৩১ বছরের মধ্যে এবারের ঈদুল আযহায় কুরবানির পশুর চামড়ার দাম অনেক কম ছিল। দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিখাত চামড়া শিল্প। পোশাক শিল্পের পর এ খাত থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। এই শিল্পের কাঁচামালের দামে যদি ভয়াবহ রকম ধস নামে, তাহলে এর প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর পড়বে এটা নি:সন্দেহে বলা যায়। এ নিয়ে দেশ জুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। চামড়ার ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, এবারের চামড়ার দাম স্মরণকালের মধ্যে সর্বনি¤œ। দাম না পেয়ে অনেকেই কুরবানির পশুর চামড়া ফেলে দিয়েছেন। অনেকেই কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। এমন ঘটনা ঘটেছে সাতক্ষীরা, খুলনা, নীলফামারী, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। চামড়া কেনার লোক না পাওয়ায় সারাদিন অপেক্ষার পর বাধ্য হয়ে কুরবানির পশুর চামড়া মাটির নীচে পুঁতে ফেলে। খুচরা চামড়া ব্যবসায়ী ও মওসুমি কাঁচা চামড়ার সংগ্রহকারীরা ন্যূনতম দর দিয়েও ট্যানারি মালিক এবং পাইকারদের কাছে চামড়া গ্রহণকারীরা, চামড়া বিক্রি করতে পারেনি। এতে রাগে দু:খে ও হতাশায় ঢাকা, চট্টগ্রামে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কের ওপর চামড়া ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে যায়। এ অবস্থাকে কেই বলছে সি-িকেট কেউ বলছে অন্তরালের খেলা।

এ বছর কুরবানির পশুর চাহিদা ছিল এক কোটি ১০ লাখের মতো। এর জন্য প্রায় ৪৫ লাখ গরু প্র¯ুÍÍত ছিল। বাকিটা ছাগল মহিষ কুরবানি হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়ার বাজার ধস নামার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্য দিকে কম দামে চামড়া কিনতে পারায় এবং কাঁচা চামড়া বিদেশে রপ্তানির অনুমতি মেলায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত লাভ হাতিয়ে নিবে আড়তদার, ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা। তবে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন লাভ যাবে আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের পকেটে। চামড়া রপ্তানি হলে ট্যানারি মালিকরা আর কম দামে এদের কাছ থেকে চামড়া কিনতে পারবেন না। জানা গেছে, ১৯৮৯ সনে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে কেনা চামড়া এ বছর ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ টাকা দামের খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র দেড়শ’ টাকায়। আর এ বছর এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকায় কেনা কুরবানির পশুর চামড়া এক হাজার টাকায় বিক্রি করতে পেরেছেন এমন কোন সংবাদ শোনা যায়নি। আর যত টাকা দিয়ে খাসি কিনুক না কেন স্বল্প মূল্যে তা বিক্রি করতে হয়েছে। সারা বছরই জবাই করা গবাদি পশু থেকে চামড়া আসে। তবে মুসলিম প্রধান এই দেশে ঈদুল আযহার সময় প্রায় ৪০ শতাংশ চামড়া আসে।

 এবার গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে প্রতিবর্গ ফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। সারা দেশে খাসির দামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গ ফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা। এবং বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা। বিগত বছরগুলো নামাযের পর পরই রাজধানিসহ বড় বড় শহরে বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় অসংখ্য খুচরা ও মওসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের ভিড় দেখা গেলেও এবার তাদের দেখা মেলেনি।

কাঁচা চামড়ার খুচরা ও মওসুমি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ট্যানারির মালিক এবং পাইকারদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে সরকার নির্ধারিত দরে চামড়া ক্রয় কাজে নেমে পড়ত। কিন্তু এবার খুচরা পাইকারী ব্যবসায়ীরা অগ্রিম কোন টাকা পায়নি। এমন কি ট্যানারি মালিক ও পাইকারদের কাছে কোন দর পাইনি। কাঁচা চামড়ার খুচরা ও মওসুমি ব্যবসায়ীরা অগ্রিম টাকা পেত কিন্তু এবার পাইনি। এ কারণে তারা অল্পদামে চামড়া কিনেছেন। যা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কম। অতীতে কুরবানির আগে সরকার কে কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যেত; কিন্তু এবার শুধু চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া ছাড়া কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। ঈদুল আযহার আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে চামড়া ক্রয় সংগ্রহের জন্য ঋণ দেয়া হতো কিন্তু এবার তা দেয়া হয়নি। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড এ্যন্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, আমাদের হাতে এই মুহূর্তে চামড়া কেনার মতো টাকা নেই। ফলে মওসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এবার সব চামড়া এবার কিনতেই পারি নাই। ঈদের পর ১৪ আগস্ট ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যসোসিয়েশন (বিটিএ) এক সংবাদিক সম্মেলনে জানায়, কাঁচা চামড়ার রপ্তানির সরকারি সিদ্ধান্তে শতভাগ দেশীয় চামড়া শিল্প হুমকির মুখে পড়বে। এ খাতে সাত হাজার টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে।

কাঁচামাল না পেলে এ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত বিপুল জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে যাবে; দেখা দিতে পারে শ্রমিক অসন্তোষ। তাই কাচাঁ চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। অন্য দিকে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পিছনে ব্যবসায়িক কারসাজি রয়েছে। আবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, চামড়ার দাম নিয়ে সি-িকেটের বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে জানা দরকার। তবে এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। এক হলো বড় ধরনের সমস্বয়ের অভাব। ট্যানারি মালিক ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের আলোকে বুঝা যায়, তারা এবার অর্থায়নের অভাব অনুভব করছে এবং কাঁচা চামড়ার রপ্তানি সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের কাছে ব্যবসা বান্ধব ও শিল্প বান্ধব মনে হয়নি।’

এখানে যথাযথভাবে সরকারি তদারকির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো ঈদুল আযহার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বৈঠক করে যদি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারত, তাহলে চামড়া শিল্পের এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে পারত। অন্যদিকে সরকারের দু’জন মন্ত্রী সি-িকেটের কারসাজির কথা বলেছেন। সরকারের চৌকস গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। সেগুলোর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সে আলোকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এবং সি-িকেটের কারসাজি থাকলে সে ব্যাপরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত।

 এখানে কেমন জানি সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। কেন আজ আমাদের এই চামড়া শিল্পের বিপর্যয়? এখন কে নেবে এর দায়ভার? তাই চামড়াশিল্প রক্ষায় এর প্রকৃত কারণ বা রহস্য উদঘাটন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো, এবারের কুরবানির চামড়া খুব একটা ক্রয় বিক্রয় করা সম্ভব হয়নি। বেশির ভাগ চামড়া ক্রয় বিক্রয় না করতে পারায় নষ্ট হয়ে গেছে। যারফলে ফেলে দেয়া হয়েছে, মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। যদি সি›ি-কেটের লোকজন কিছু চামড়া ক্রয় করত, তা হলে কিছু চামড়ার দাম পাওয়া যেত। এখানে অদৃশ্যমান রহস্য থাকতে পারে। এটা একটি দেশের জন্য ইতিবাচক নয়। এগুলো দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। আল কুরআনে দান করার ক্ষেত্রে যে আটটি খাতের কথা বলা হয়েছে, সে অনুযায়ী কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা গরিব মিসকিন, অসচ্ছল, অভাবী, দু:খী, দুস্থ, এতিমদের দান করা হয়। 

এবার কুরবানির চামড়া ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারেনি। এর ফলে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে গরিব মিসকিন, অসচ্ছল, অভাবী, দু:খী, দুস্থ এতিমরা। ধর্মীয় মতে মিসকিন, অস্বচ্ছল, অভাবী, দু:খী, দুস্থ ও এতিমদের অধিকার বা হক আত্মসাৎকারীদের পরিণাম হবে কঠিন। পশুর চামড়া দেশের জাতীয় সম্পদ। দেশের রফতানি আয়ের বড় খাত চামড়া শিল্প। যে শিল্প থেকে রপ্তানি আয় আসে সেই শিল্পকে কোনো মতে অবহেলা করা ঠিক নয়। চামড়ার জন্য সরকার সুনির্দিষ্ট শিল্প এলাকা করেছে। সেই নতুন এলাকায় শিল্পগুলো স্থানান্তর করা হয়েছে কিন্তু কাজ অসম্পন্ন রেখেই। শিল্প মালিকরা উৎপাদনে যেতেই কারখানার পরিপূর্ণ পরিবেশ পাননি, তাহলে একটি রপ্তানিমুখী শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়বে আগেই চিন্তা করা উচিত ছিল। সরকারি কাজের অংশ বর্জ্যশোধনাগার দুই বছরেও নির্মাণ সম্পন্ন হলো না। এর দায় কে নেবে। এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকারের নৈতিক সমর্থন দরকার। আর এই সঙ্কটের জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার। রফতানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত হবে একমাত্র পথ। চামড়া শিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান আসে কুরবানির ঈদে। চামড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখা শুধু নয়, বিকশিত করতে হলে এ শিল্পের সাথে সঙ্গে জড়িতদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে পাট শিল্প যেমন ধবংস হয়ে গেছে তেমনি চামড়া শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ