অ্যামাজনের ধোঁয়া যেভাবে ঢেকে দিয়েছে দূরের শহর
সংগ্রাম অনলাইন : অ্যামাজন বনে আগুন লাগার ঘটনা এ বছরে ৮০ শতাংশের বেশি বেড়ে গিয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে এটি বিশ্বের অন্যতম বড় শহর সাও পাওলোকে ঢেকে দিয়েছিল।
২০১৯ সালের ১৯শে অগাস্ট দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহর সাও পাওলোয় সূর্যাস্ত হওয়ার পূর্বাভাস ছিল সন্ধ্যা ৫টা ৫১ মিনিটে। কিন্তু প্রায় দুই ঘণ্টা আগেই পুরো শহরটি অন্ধকারে ছেয়ে যায়।
এর পেছনে ছিল দুইটি কারণ। একটি হলো দক্ষিণ মেরুর দিক থেকে আসা ঠাণ্ডা আবহাওয়া আর অ্যামাজনে লাগা আগুনের ধোঁয়া।
ধারণা করা হয়, সাও পাওলোতে আসা ওই ধোঁয়া উড়ে এসেছে ২৫০০ কিলোমিটার দূরের অ্যামাজনের দাবানল থেকে।
ভয়াবহতার প্রকোপ
ব্রাজিলের পরিবেশ দপ্তর বলছে, অ্যামাজনের বনে দাবানলের ঘটনা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছে। অনেক সময় স্থানীয় কৃষকরা বন পুড়িয়ে চাষের জমি বের করার জন্যও বনে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে।
স্যাটেলাইট ছবি গবেষণা করে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ স্পেস রিসার্চ (ইমপে) দেখতে পেয়েছে, গত জানুয়ারি মাস থেকে অগাস্ট মাস পর্যন্ত অ্যামাজন বনে ৭২,৮০০টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে যে, ব্রাজিলের রাজ্য রোনডোনিয়া এবং অ্যার্কে এবং প্রতিবেশী বলিভিয়া এবং প্যারাগুয়ের বিশাল আগুন থেকে ধোয়ার উৎপত্তি হওয়ার পর সেটা দক্ষিণ দিকে ভেসে আসছে।
এই সংখ্যা ২০১৮ সালের তুলনায় ৮৩ শতাংশ বেশি।
দক্ষিণ দিক থেকে আসা ঠাণ্ডা বাতাসের সঙ্গে মিলে এই ধোঁয়া সাও পাওলো শহরের ওপর ভারী ও নিচু মেঘ তৈরি করে। মেঘের সঙ্গে মিশে যাওয়ার কারণে ধোঁয়া আর বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না।
আবহাওয়াবিদ মার্সেলো সেলুত্তি বিবিসিকে বলছেন, ''এটা যেন একটি প্যানের ভেতর ফুটতে থাকা উত্তপ্ত পানি আর তার ওপর একটি ঢাকনা বসিয়ে দেয়া। ফলে সরে যাওয়ার পরিবর্তে ধোঁয়া নিচু বায়ুমণ্ডলে আটকে পড়ে, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার উঁচু।''
আরেকজন আবহাওয়াবিদ জোসেলিয়া পেগোরিম বলছেন, স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে যে, ব্রাজিলের রাজ্য রোনডোনিয়া এবং অ্যার্কে এবং প্রতিবেশী বলিভিয়া এবং প্যারাগুয়ের বিশাল আগুন থেকে ধোঁয়ার উৎপত্তি হওয়ার পর সেটা দক্ষিণ দিকে ভেসে আসছে।
সাও পাওলো শহরে সূর্যাস্ত হওয়ার পূর্বাভাস ছিল সন্ধ্যা ৫টা ৫১ মিনিটে। কিন্তু প্রায় দুই ঘণ্টা আগেই পুরো শহরটি অন্ধকারে ছেয়ে যায়।
''গত সপ্তাহের শেষের দিকে, বিশেষ করে শুক্রবারে, আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেয়েছি যে, ধোঁয়া দক্ষিণ দিকে ভেসে আসছে।''
সাও পাওলোর এই অন্ধকার হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি এমন সময় ঘটেছে, যখন ব্রাজিলের সরকার অ্যামাজন বন উজাড় হয়ে যাওয়া ঠেকাতে ব্যর্থতার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে।
ইমপের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে যে, ২০১৮ সালে সবমিলিয়ে ৭৫০০ কিলোমিটার বনাঞ্চল হারিয়ে গেছে, যা ২০১৭ সালের তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেশি।
২০১৯ সালের আপাত পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, অ্যামাজন বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার এই হার প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো গত জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর তিনগুণ হয়ে গেছে।
বোলসোনারো ক্ষমতায় আসার পর ব্রাজিলে অ্যামাজন বনভূমি উজাড় হওয়ার হার অনেক বেড়ে গেছে
শুধুমাত্র গত মাসেই ২২০০ কিলোমিটার বনাঞ্চল খালি করা হয়েছে, যা গত বছরের জুলাই মাসের তুলনায় ২৮০ শতাংশ হারে বেশি।
প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো প্রকাশ্যে এসব তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং এজেন্সির পরিচালক রিকার্ডো গ্যালভাওকে গত মাসে বরখাস্ত করে বিতর্ক আরো চাঙ্গা করে দিয়েছেন।
''আমার মনে হচ্ছে, এসব সংখ্যা বিশেষ উদ্দেশ্যে সাজানো হয়েছে। যা মনে হচ্ছে সরকার এবং ব্রাজিলের ওপর আঘাত করার জন্য,'' পহেলা অগাস্ট একটি সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো।
তিনি বারবার গণমাধ্যমে দাবি করেছেন যে, ''অ্যামাজন আমাদের।''
আন্তর্জাতিক লড়াই
গত কয়েকদিন ধরে জার্মানি এবং নরওয়ের সরকার ব্রাজিলের আমাজন ফান্ডে অর্থ অনুদান বন্ধ করে রেখেছে, যা অ্যামাজনের বনভূমি উজাড় হওয়া ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সহায়তার অংশ হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হতো।
নরওয়ে ছিল এই তহবিলের সবচেয়ে বড় দাতা দেশ, যারা গত এক দশকে একশো বিশ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সহায়তা দিয়েছে।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ স্পেস রিসার্চ (ইমপে) দেখতে পেয়েছে, গত জানুয়ারি মাস থেকে অগাস্ট মাস পর্যন্ত অ্যামাজন বনে ৭২ ৮০০টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
''তারা যেভাবে ভালো মনে করবে, সেভাবেই তাদের অর্থের ব্যবহার করতে পারে, ব্রাজিলের ওসবের দরকার নেই,'' প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেছেন মি. বোলসোনারো।
অ্যামাজনের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্রাজিলে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে অভিযোজনের জন্য এই বনভূমিটি রক্ষা করা বিশেষ প্রয়োজন, যা বিশাল পরিমাণে কার্বন শোষণ করে থাকে।
তবে প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যেই ওই অঞ্চল থেকে সম্পত্তি আহরণের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
তিনি আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ একটি বিশেষ এলাকা থেকেও সম্পদ আহরণের পক্ষে - যা দেশটির ১৯৮৮ সালের সংবিধানের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গত বছর নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, এমন আইন করা হবে যেন অ্যামাজনসহ পরিবেশগত সুরক্ষা এলাকাগুলোয় খনি অনুসন্ধান ও কৃষি বিষয়ক কোম্পানিগুলো কাজের সুযোগ পায়।
'বনভূমি উজাড়ের লাইসেন্স'
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তাকে 'ক্যাপ্টেন চেইনস' নামে ডাকছেন পরিবেশ কর্মীরা। কারণ হলো বনভূমি নিয়ে তার অবস্থান এবং ব্রাজিলের প্রধান পরিবেশ সংস্থা ইবামার তহবিল কমিয়ে দেয়া।
গ্রিনপিসের মুখপাত্র গত সপ্তাহে বলেছেন, ''এটাকে বলা যেতে পারে কোনরকম শাস্তি ছাড়াই বনভূমি উজাড় করার লাইসেন্স দিয়ে দেয়ার মতো একটি ঘটনা।''
বোলসোনারো আরো সমালোচনার মুখে পড়েছেন, যখন তিনি আদিবাসী এলাকাগুলোর দায়িত্ব বিচার বিভাগীয় মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
বিরোধী আইন প্রণেতারা এটিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে যে, সরকার যেন শিয়ালকে মুরগি দেখাশোনার দায়িত্ব দিতে চাইছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।