বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

২০৪১ সালের চট্টগ্রামকে সামনে রেখে পরিকল্পনা করতে হবে

চট্টগ্রাম ব্যুরো : গত শুক্রবার বিকেলে টাইগারপাস সিটি কর্পোরেশন কনফারেন্স হলে চট্টগ্রাম নগরীতে মেট্রোরেল চালুকরণ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ নগরীর সেবাসংস্থা প্রধানদের সাথে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। সভায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আলহাজ্ব আ.জ.ম.নাছির উদ্দীন প্রধান অতিথি এবং সিডিএ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জহিরুল আলম দোভাষ বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। চসিক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিকের সঞ্চালনায় সিটি মেয়র বলেন নগর যানজট নিরসনে মেট্টোরেলের বিকল্প নেই। ঢাকার পরে চট্টগ্রাম বৃহত্তম শহর। শুধু তাই নয় এটি এখন জেলা শহর ও বানিজ্যিক নগরী। এই নগরীর গুরুত্ব অপরিসীম। দিন দিন শহরের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর রুপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম বন্দরসহ সকল সংস্থাকে আরো কার্যকরী ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এরই সাথে নিশ্চিত করতে হবে নগর যোগাযোগ ব্যবস্থা। তিনি বলেন ৬০ বর্গমাইল এলাকার এই শহর। এই শহরকে বর্ধিত করার জন্য সাবেক মেয়র মরহুম এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিভিন্ন আইনী জটিলতার কারণে এই কাজটা তিনি সম্পন্ন করতে পারেন নি। ওই এলাকার কিছু মানুষ এটা করতে দেয়নি। যারা করতে দেয়নি, তারা তাদের স্বার্থ চেয়েছে, আর ক্ষতি করেছে দেশের। ওই সময়ে যদি শহরটা বর্ধিত করা যেতো, তাহলে শহরের উপর বর্তমানে মানুষের যে চাপ সেটা আর হতো না।
এই প্রসঙ্গে সিটি মেয়র বলেন, জীবন জীবিকার তাগিদে দেশের প্রত্যাঞ্চল থেকে এই শহরে বিভিন্ন পেশার মানুষ আসছে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদের জন্য গণ-পরিবহনসহ বিভিন্ন সেবা নিশ্চিত করা নগর সেবা সংস্থার সমূহের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। নগরবাসীর সেবাদানের জন্য ৩২টি সেবা সংস্থা রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান সমূহের কার কি দায়িত্ব তা লিপিবদ্ধ আছে। এই প্রতিষ্ঠানসমূহ যতবেশী সচল হবে,নগরবাসী ততবেশী উপকৃত হবে। তিনি বলেন ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়রই একমাত্র জনপ্রতিনিধি। তিনি নগরবাসীর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত মেয়র। অপরাপর প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা সরকার কর্তৃক মনোনীত। তাই তাদের উচিত নগর উন্নয়নে সিটি মেয়রকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। মেট্টোরেল নির্মাণ প্রসঙ্গে মেয়র বলেন ম্যাস রেপিড ট্রানজিটের (এমআরটি) প্রাক-যোগ্যতা সমীক্ষা। এই সমীক্ষার উপর আরো বৃহত্তর পরিসরে মতবিনিময় হবে। এরপর চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহন করা হবে তিনি উল্লেখ করেন। এই মেট্টোরেল নির্মাণে নগরসেবা সংস্থা সহ নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন মেয়র। তিনি বলেন আধুনিক বিশ্বে শহরকেন্দ্রিক গণ-পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে এম.আর.টি অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাধ্যম। এটি শুধু গণ-পরিবহন নয়, দ্রুত গণ-পরিবহনও বটে। তাই সকল উন্নত দেশে এম.আর.টি-র ব্যবস্থা চালু রয়েছে। চট্টগ্রাম শুধু বন্দর নগরীই নয়, এটি দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীরও দাবিদার। তাই মেট্টোরেল স্থাপন এ নগরীর জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব জহিরুল আলম দোভাষ বলেন প্রস্তাবিত মেট্টোরেলের ডিপোর জন্য ৬০ একর জায়গা কথা প্রাক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। এত জায়গা এই শহরে পাওয়া না। তাই তিনি মিরেশ্বরাই হাটহাজারী সহ এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তির উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন এই প্রকল্প আরো আগে নেয়া উচিত ছিল। তারপরেও সিটি মেয়র এ উদ্যোগ নেয়ার জন্য তিনি তাকে সাধুবাদ জানান। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন সিডিএ চেয়ারম্যান।চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন শহরে ৫৪ কিলোমিটার সড়ক সমূহকে ৩টি ষ্টেশন লাইনে ভাগ করেছে। সেইগুলো হলো ষ্টেশন লাইন-১ এ কালুরঘাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, চান্দগাঁও সিএনবি বাস ষ্টপ, হাজেরা-তজু ডিগ্রি কলেজ, বহদ্দারহাট, কাপাসগোলা, চকবাজার, জহুর আহমদ চৌধুরী রোড, লার খান বাজার, দেওয়ানহাট, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, বারিক বিল্ডিং, নিমতলি, সল্টগোলা ক্রসিং, সিইপিজেড, সিমেন্ট ক্রসিং, ষ্টিলমিল বাসসন্টপ, পতেঙ্গা, পতেঙ্গা বিচ, এয়ারপোর্ট, ষ্টেশন লাইন-২ -এ সিটি গেইট, কর্নেলহাট, একে খান বাস ষ্টপ, সরাইপড়া, সয়া বাজার, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, পোর্ট নিউ মার্কেট, নিমতলি, বারিক বিল্ডিং, সদরঘাট, ফিরিঙ্গী বাজার, শহীদ বশিরুজ্জামান স্কয়ার এবং ষ্টেশন লাইন-৩ -এ বাংলাদেশ অক্সিজেন, হাশেম বাজার রোড, মুরাদপুর, চকবাজার, চন্দনপুরা, আন্দরকিল্লা, কতোয়ায়ালী, ফিরিঙ্গী বাজার, পাঁচলাইশ একে খান বাস স্টপ লিংক-পাঁচলাইশ, মেডিকেল কলেজ, জিইসি স্কয়ার, বিজিএমইএ ইন্সটিটিউট, ফয়েস লেক, পাহাড়তলী লিংক রোড, একে খান বাস ষ্টপ রয়েছে। চট্টগ্রামের জন্য এম.আর টি -এ প্রাক যোগ্যতা সমীক্ষা প্রস্তুত করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাস্স্থান ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড কন্সাল্ট্যান্টস লিমিলেড।
চুয়েটের ভিসি রফিকুল আলম বলেন, নগর উন্নয়নের ভিশন হতে হবে দূরদর্শী। ভবিষ্যতে নগরের আয়তন বাড়বে। ২০৪১ সালের চট্টগ্রাম কেমন হবে সেই পরিকল্পনায় মাথায় নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এমআরটির কানেকটিভিটি বাড়াতে হবে। এটি বাস্তবায়নে যাতে ওভারলেপিং না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিধান রায় বলেন, চট্টগ্রামে আমি এমআরটির পরিকলল্পনাকে সাধুবাদ জানাই। এটি অবশ্যই কেটি যুগোপযুগি পদক্ষেপ। এতে ২০ কিমিতে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী দরকার। এমআরটি চালু হলে নগরে গাড়ি চলাচল হ্রাস পাবে। যানজট এড়াতে এবং কর্মঘন্টা রক্ষার্থে বন্দর নগরীতে এমআরটির বিকল্প নেই। ভবিষ্যত পরিকল্পনায় হাটহাজারী, মিরসরাইকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনাও মাথায় রাখতে হবে।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস বলেন, সত্যিকার অর্থে নগর উন্নয়নে ফ্লাইওভার ও এমআরটি দুটোই জরুরী। এর জন্য প্রথমে দরকার সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়। এ বিষয়ে ঢাকায় এমআরটি কর্তৃপক্ষের নিকট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই তাদের সাথেও আলোচনা দরকার।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, বে টার্মিনাল একটি কার্যকরী উদ্যোগ। নগরীর এবারের জলাবদ্ধতা ও যানজট নগরীর ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তাই মেট্টোরেল একটি স্বপ্নের প্রকল্প, এর বিকল্প নেই। এ প্রকল্প টেকসই ও জনকল্যাণকর করতে চট্টগ্রাম শহরকে বাঁচাতে হলে চসিক-সিডিএর সমন্বয়ের বিকল্প নেই।
প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেন, মেয়রের সাহসী উদ্যোগের মধ্য একটি হলো চট্টগ্রামের জন্য এমআরটি। এর গুরুত্বের বিষয়ে দ্বিমত নেই।
প্রকৌশলী মো. হারুন বলেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। এমআরটির প্রস্তাবনায় চট্টগ্রাম শহরকে ছোট আকারে চিন্তা করা হয়েছে। বড় পরিসরে চিন্তা করলে উদ্যোগ আরও ফলপ্রসূ হবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মেট্টোরেল সম্প্রসারণ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
স্থপতি সোহেল শাকুর বলেন, এমআরটি আধুনিক একটি ব্যবস্থা। সঠিকভাবে না বুঝে কাজ করলে সরকারি অর্থ অপচয়ের শঙ্কা আছে। তাই দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।
স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, জনবহুল চট্টগ্রাম শহরে এখনই মেট্রো অপরিহার্য। চট্টগ্রামে ৬৫ লাখ জনসংখ্যার বসবাস। এক্ষেত্রে ইকোনমিক জোনগুলোকেও সংযুক্ত রাখা জরুরী। সিডিএ ২০৪১ সালের আলোকে মাস্টারপ্ল্যান করতে যাচ্ছে। ওয়ার্ড পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে এমআরটি হওয়া দরকার।
 প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, এই প্রথম চট্টগ্রামের একজন মেয়র এমআরটি নিয়ে পরিকল্পনা করছেন। এটি বাস্তবায়িত হলে তিনি চট্টগ্রামের মানুষের কাছে ইতিহাসে জায়গা করে নিবেন। যেহেতু এটি একটি ইউনিক পরিকল্পনা তাই এ বিষয়ে অনেক মতামত ও স্টাডির প্রয়োজন। মনে রাখতে চট্টগ্রাম বন্দরকে মাথায় নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে বন্দরকে বাদ দিয়ে কিছু করা যাবে না। সত্যিকার অর্থে পুরো দেশের জন্য চট্টগ্রামকে বাঁচাতে হবে। বে টার্মিনাল হলে বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা সড়ক যানজট মুক্ত হবে। তাই তিনি বন্দরের প্ল্যানিং জানার জন্যও মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। তিনি বলেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বন্দরের মতামত নিতে হবে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা ঝুঁকি এড়াতে এবং আইএসপিএস কোড মানলে বন্দরের ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার করা যাবে না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন বলেন, সিডিএ-চসিকের সমন্বয় নেই এ রকম শুনি। কিন্তু আজ দুই সংস্থার প্রধানকে একসঙ্গে দেখে খুব খুশি হয়েছি। এমআরটির বিষয়ে সত্যিকার ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে হবে। অবশ্যই বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদি ইউটিলিটি সরানোর অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিইসিএল এর ডাইরেক্টর প্রকৌশলী মো. আব্দুল আজিম জোবাইর, চসিক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশল মো. আবু সালেহ, প্রকৌশলী মুনিরুল হুদা, প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম, প্রকৌশলী সুদিপ বসাক, প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন, প্রকৌশলী অসিম বড়–য়া, প্রকৌশলী মো. আবু সিদ্দিক, প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ রেজাউল করিম, প্রকৌশলী শাহিনুল ইসলাম, প্রকৌশলী ফারজানা মুক্তা, স্থপতি আবদুল্লাহ আল ওমর, সাংবাদিক হোসাইন রাজু, সাংবাদিক আল রহমান, ম্যাক্স এর প্রকৌশলী মনির হোসেন, চট্টগ্রাম ওয়াসার মো. আরিফুল ইসলাম, এফপিসির প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া, বিবিএর এর সিনিয়র কনসালটেন্ট স্বপন প্রমুখ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ