বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সমাজ-সভ্যতায় বিভ্রান্তির কত রঙ

‘মোরগ ডাকলো মামলা হলো’- এটি এএফপি পরিবেশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম। ৮ জুলাই (২০১৯) পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ফ্রান্সে মহিস নামের একটি মোরগের কারণে তার মালিককে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন এক প্রতিবেশী। মোরগটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিদিন ভোরে সেটি উচ্চশব্দে ডেকে আশপাশের সবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। মামলাটি ফ্রান্সজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। অনেকে এই মামলাকে ফরাসি গ্রামীণ সংস্কৃতির ওপর আঘাত হিসেবে দেখছেন। তার ওপর মোরগ হলো ফ্রান্সের অন্যতম জাতীয় প্রতীক। এই মামলার প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয় গত ৪ জুলাই। এ দিন আদালতের বাইরে মোরগ মহিসের পক্ষে অনেক সমর্থক উপস্থিত ছিলেন। অনেক মোরগ-মুরগিও ছিল সেখানে।
ঘটনাটি ঘটে ফ্রান্সের পশ্চিমাঞ্চলীয় দ্বীপ ওলেহোঁর হোশফো শহরে। সেখানকার সাঁ-পিয়ে-দোলেহোঁ এলাকার বাসিন্দা কোহিন ফেসুর পোষা মোরগ মহিস। তাঁর ৪০ প্রতিবেশির মধ্যে মাত্র দু’জন মহিসের ডাক নিয়ে অভিযোগ করেছেন। এ নিয়ে স্থানীয় গেজাক গ্রামের মেয়র ব্রুনো দিওনিস দু সেজু একটি চিঠি লিখেছেন। সেই খোলা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘গ্রামে গির্জার বেল বাজবে, গরু হাম্বা ডাকবে, গাধারাও ডাকবে- এই তো ফ্রান্সের ঐতিহ্য। আমি যখন শহরে যাই, তখনতো ট্রাফিক বাতি ও গাড়িঘোড়া সরাতে বলি না।’ মেয়র ব্রুনোর খোলা চিঠিটি আমাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। বর্তমান সময়েতো পৃথিবীর নানা জায়গায় নানা পদে নানা মানুষ অধিষ্ঠিত আছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গত বক্তব্য প্রদানে কয়জন এগিয়ে আসেন ? মেয়র ব্রুনো শুধু নিজেদের ঐতিহ্যের পক্ষেই কথা বলেননি, উদার মনে শহুরে জীবনের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সহাবস্থানের যৌক্তিক চেতনাকেও তুলে ধরেছেন। এমন দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন।
মোরগের মালিক কোহিনের বিরুদ্ধে যিনি মামলা করেছেন, তিনি কিন্তু সহাবস্থান চেতনার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সক্ষম হননি। ৪০ প্রতিবেশীর মধ্যে ৩৮ জনই মোরগের ডাক নিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। তারা হয়তো জানেন, মোরগ ফ্রান্সের অন্যতম জাতীয় প্রতীক। আর প্রতিবেশীর মোরগ, গরু ও গাধার ডাকতো প্রকৃতির সাথে বসবাসের মতই স্বাভাবিক বিষয়। এ নিয়ে অভিযোগ করার কী আছে? আসলে বর্তমান সভ্যতায় আমরা অনেকেই আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থবাজ হয়ে উঠেছি। নিজেকে ছাড়া সমাজের অন্য মানুষের কথা ভাবতে চাই না। এমন অবস্থায় মানুষ এতটাই ক্ষুদ্র হয়ে যায় যে, স্বাভাবিক কা-জ্ঞানও হারিয়ে বসে। ফলে মোরগের ডাকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে যায়। ফ্রান্সের মানুষ এমন অজাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তারা বলছেন, এই মামলা ফ্রান্সের গ্রামীণ সংস্কৃতির ওপর একটি আঘাত। আদালত কি রায় দেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আমাদের আত্মা পবিত্র না থাকলে আমরা সবদিক থেকে ক্ষুদ্র হয়ে যাই। ‘আমাদের আত্মার গুরুতর অসুখ’Ñ এটি একটি প্রতিক্রিয়ার শিরোনাম। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রতিদিন খবরের কাগজ আর টেলিভিশনের পর্দাজুড়ে থাকে ধর্ষণের খবর, যা আমাদের জানায় আমাদের আত্মায় বাসা বেঁধেছে এক গুরুতর অসুখ। ধর্ষণের শিকার বৃদ্ধা থেকে শিশু, মেয়ে এবং ছেলে, যাদের বয়স দুই থেকে নিয়ে আশি। নানা সংস্থার, গণমাধ্যমের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ধর্ষণের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, যেমন বাড়ে নিরাময়-অযোগ্য অসুখের প্রকোপ। তিনি আরও বলেন, ধর্ষকদের তালিকায় এখন আর শুধু বখাটে বা মাদকাসক্তরাই  নেই, আছে কেতাদুরস্ত পরিবারের ক্ষমতাশালীদের সন্তানরাও। শিশু ধর্ষকদের তালিকায় এখন নাম লিখিয়েছেন স্কুল-মাদরাসার শিক্ষকরা এবং অত্যাশ্চর্যভাবে মসজিদের ইমাম।
প্রতিক্রিয়ায় আরও বলা হয়, শরীরের অসুখ থেকে আরোগ্য পাওয়া যায়, মনের অসুখেরও চিকিৎসা আছে; কিন্তু আত্মার অসুখের? এই অসুখ নিরাময় করতে পারে নৈতিকতা, সুনীতি চর্চা, শুদ্ধাচার এবং নান্দনিক বোধের বিস্তার। কিন্তু যেসব উৎস থেকে সেগুলোর উৎসার এবং বিকাশ, সেগুলো আমরা রুদ্ধ করে দিয়েছি। আমরা বলি বটে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে কিন্তু এটি তো বক্তৃতার কথা, হাঁটু-ঝাঁকানো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার কথা। শুদ্ধতার উৎসগুলো পাথর চাপা থাকলে সচেতনতা কীভাবে বাড়বে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সঙ্গতভাবেই বলেছেন, শুদ্ধতার উৎসগুলো পাথরচাপা থাকলে  সচেতনতা কীভাবে বাড়বে? আর তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন আমাদের আত্মার গুরুতর অসুখের কথা। আমাদের সমাজে তো এখন আত্মার কথা খুব কমই শোনা যায়। শরীরের স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা এখন বেশ উদ্বিগ্ন। আর দেহজ কামনা-বাসনার প্রাবল্য এবং এর বিকৃত রূপতো পত্রিকার পাতা খুললেই পাওয়া যায়। ফলে আমরা বলছি আমাদের আত্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু আত্মাকে সুস্থ করার উপায় কী? এই প্রসঙ্গে তো প্রথমেই জানা প্রয়োজন আত্মার পরিচয়। আমাদের সবার আত্মা তো এক পর্যায়ে থাকে না। কারো আত্মা থাকে ‘নফসে আম্মারা’ বা কলুষিত অবস্থায়, কারো আত্মা থাকে ‘নফসে লাওয়ামা’ বা দ্বান্দ্বিক অবস্থায়। এ অবস্থা থেকে বিবেকের শাসন ও ধর্মীয় চেতনা মানুষকে ‘নফসে মুতমাইন্না’ বা প্রশান্ত আত্মা অর্জনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে এ পর্যায়ে উন্নীত হতে হলে খ-িতভাবে নয় বরং পরিপূর্ণভাবে মানুষকে হতে হবে আল্লাহর বান্দা। আর জীবনের সামগ্রিক অঙ্গনে, বিচিত্র সম্পর্ক সূত্রে বান্দা হিসেবে পথ চলায় মানুষকে গ্রহণ করতে হবে রাসূল (স.) এর মানহাজ বা কর্মপদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে গাফেল থাকায় অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এখন বিরাজ করছে ‘নফসে আম্মারা’ বা কলুষিত আত্মা। অথচ মানব সন্তান যখন পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয় তখন তো তার আত্মা অবস্থান করে ফেতরাতে বা স্বাভাবিক স্বভাবে। পরে তার পরিবার-পরিবেশ ও ভুল শিক্ষা-দীক্ষা তাকে মন্দ পথে নিয়ে যায় এবং তার আত্মা হয়ে পড়ে কলুষিত। তাই এখন আমাদের নজর দেয়া প্রয়োজন আমাদের চারপাশের পরিবেশ ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নামে আমরা এখন কী করছি? আমাদের টিভি-চ্যানেল, স্মার্টফোন আমাদের কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছে ? বিনোদন সংস্কৃতির নামে আমরা কী উপভোগ করছি? ভোগবাদ ও অশ্লীলতা যেন এখন আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। পরিবারে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন শিষ্টাচারের শিক্ষা নেই। এর ফলাফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। তাইতো বলতে হচ্ছে- আমাদের আত্মা এখন গুরুতর অসুস্থ।
আমাদের অসুস্থতা ও সংকটের মূলে রয়েছে শিক্ষাদর্শনের ভ্রান্তি। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব ও দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার সহযোগী পরিচালক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ১২ জুলাই এক বিবৃতিতে বলেছেন, ২০১৩ সালে শিক্ষার আধুনিকায়নের নামে নবম-দশম শ্রেণি থেকে শুরু করে মাস্টার্স শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ে ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’ শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি আমাদের গোচরে এসেছে। আমরা দেখেছি, এর আগে ২০১২ সাল পর্যন্ত একই বইগুলোতে এই ‘বিবর্তনবাদ’ পাঠ্য ছিল না। এই শিক্ষার মাধ্যমে ৯২ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশের কোমলমতি লাখ লাখ মুসলিম শিক্ষার্থীর মননে মহান আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাসকে ঘোরতর সন্দিহান ও ভঙ্গুর করে নাস্তিক্যবাদে তাদের উদ্বুদ্ধ করার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। বিবৃতিতে পাঠ্যবইয়ে ‘বিবর্তনবাদ’ অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদ জানিয়ে জুনায়েদ বাবুনগরী ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস ও জাতিবিনাশী এই শিক্ষা অবিলম্বে বাতিল ও নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।
শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবেও আমরা পাঠ্যবই থেকে ‘বিবর্তনবাদ’ বাদ দেয়ার দাবিকে সমর্থন করছি। ‘বিবর্তনবাদ’ আসলে বিজ্ঞানের নামে এক বড় ভুল। এমন ভুল মেনে নেয়া যায় না। ভুলের দৌরাত্ম্য শুধু রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজেই চলছে না; বিজ্ঞানের জগতেও লক্ষ্য করা যায় বড় ভুল। প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস রবার্ট ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’ তত্ত্ব বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল বলে দাবি করেছেন ভারতের এক মন্ত্রী। গত ২১ জানুয়ারি ভারতের এনডিটিভি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, স্কুল ও কলেজের টেক্সটবুক থেকে এই তত্ত্বটি সরানো দরকার বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের জুনিয়র শিক্ষামন্ত্রী সত্যপাল সিং। তিনি আরো বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা কোথাও উল্লেখ করেন নি যে, তারা একটি বনমানুষকে (শিম্পাঞ্জি) মনুষ্য সন্তানে রূপান্তরিত হতে দেখেছেন। পৃথিবীতে মানুষ আসার পর থেকে তারা সবসময় মানুষই ছিল।
ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’ তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল, এ কথা কিন্তু মন্ত্রী সত্যপাল সিং প্রথম বলেননি। বহু আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা তার এই তত্ত্বকে নিছক কল্পনা হিসেবেই বিবেচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে আমরা Lauis pasteur, Alexander oparin, Jeffrey Bada, Fred Hoyle এবং william Philip, Christian Anfinsen, Charles Fownes, Weghner, Alexander Flemming সহ নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বহু বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করতে পারি- যারা ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ’ তত্ত্বকে ভুল মনে করতেন। ডারউইন নিজেও তার মূল থিসিসে বর্ণনা করে গেছেন যে, যদি কোনো Intermediate Fossil না পাওয়া যায়, তবে তার তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হবে। তিনি ধারণা করতেন ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরা তার ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করতে পারবে। পরবর্তীতে ‘বিবর্তনবাদীরা’ প্রায় ১৪০ বছর ধরে Geological Layers-এ অনুসন্ধান চালান। কিন্তু তারা Intermediate Fossil আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। বরং তারা দেখতে পান ‘Missing Fossil’ অর্থাৎ তারা Link খুঁজে পাননি। ফলে ডারউইন বিবর্তনের ধারায় এককোষী প্রাণী থেকে শিম্পাঞ্জি হয়ে মানব অস্তিত্বের যে তত্ত্ব তুলে ধরতে চেয়েছেন তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিষয়টি এখন কল্পনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
আমরা মনে করি, ভারতের মন্ত্রী টেক্সটবুক থেকে ‘বিবর্তনবাদ’ তত্ত্বটি বাদ দেয়ার যে প্রস্তাব করেছেন তা যথার্থ হয়েছে। পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মগুলোতে তো প্রথম মানুষ হিসাবে হযরত আদম (আ.)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আর তিনি তো কোনো এককোষী প্রাণী বা শিম্পাঞ্জি থেকে উদ্ভূত হননি। প্রথম থেকেই তিনি মানুষ ছিলেন, কারণ মহান আল্লাহ তাঁকে মানুষ হিসাবেই সৃষ্টি করেছেন। মানব সন্তানদের ‘বিবর্তনবাদ’ পড়ে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তাই পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘বিবর্তনবাদ’ বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে জুনায়েদ বাবুনগরী সময়ের দাবি পূরণ করেছেন বলে আমরা মনে করি। একটা তত্ত্ব হিসেবে বিবর্তনবাদ বিজ্ঞানের ইতিহাসে থাকতে পারে, কিন্তু স্কুলের ছাত্রদের তা পড়ার প্রয়োজন নেই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ