শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে করণীয়

নুসরাত জাহান : ‘বিশ্বের যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণ কর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

নজরুলের এই উক্তির মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায় নারী ও পুরুষ অখ- মানব সমাজের দুটি অপরিহার্য অঙ্গ। পুরুষ মানব সমাজের একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করলে আরেকটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করে নারী। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি সমাজেই নারী ও পুরুষ সমানভাবে পরস্পরের মুখাপেক্ষী।
নারী সুদীর্ঘকাল ধরে নানাভাবে নিপীড়িত ও নিস্পেষিত হয়েছে এবং আজকের সভ্য সমাজেও হচ্ছে। ইসলাম শুরু থেকেই সর্বতোভাবে নারী নির্যাতনের বিপক্ষে সোচ্চার। ইসলাম নারীর অধিকার ও মর্যাদা উন্নয়নের জন্য নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছে।
ক) সম্মানিত সৃষ্টি : ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ অতীব সম্মানিত ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। ইসলাম জন্মগতভাবেই নারী ও পুরুষ উভয়কেই এই মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানদেরকে সম্মানিত করেছি’। [বনী ইসরাইল-৭০]
খ) মর্যাদা ঈমান ও আমলের উপর নির্ণয়ের মাপকাঠি : ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতা সুস্থ চিন্তা ও সঠিক কর্মের সাথে সম্পৃক্ত।
‘পুরুষ বা নারীর মধ্য থেকে যেই ভালো কাজ করলো সে ঈমানদার হলে আমি একটি পবিত্র জীবন যাপন করার সুযোগ দেব এবং তারা যে কাজ করেছিল, আমি তাদেরকে উত্তম পারিশ্রমিক দান করব।’ [আন-নাহল-৯৭]
আর এসেছে সূরা আল ইমরান-১৯৯৫।
গ) সভ্যতার নির্মাতা : জীবনের সব রকমের তৎপরতা উত্থান-পতনের ক্ষেত্রে সর্বদাই নারী ও পুরুষ পরস্পরকে সহযোগিতা করেছে।
আল্লাহ বলেন, ‘আর মুমিন পুরুষ আর মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয়, মন্দ কাজকে নিষেধ করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে।’ [সূরা আত-তওবা : ৭১]
ভুল ধারণার অপনোদন : পুরুষকে সৃষ্টি করার যেমন একটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে, তেমনি নারীর ক্ষেত্রেও। আর আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা নারী ও পুরুষ উভয়কে সৃষ্টি করে অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণ করেছেন।
আসমান ও যমীনের মালিকানা আল্লাহরই, তিনি যা চান তাই সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা তাকে কন্যা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র দান করেন। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। [সূরা আশ-শূরা: ৪৯-৫০]
ইসলাম নারী জাতিকে লাঞ্ছনা ও অমর্যাদাকর অবস্থান থেকে দ্রুততার সাথে উঠিয়ে এনে এমনই অধিকার ও মর্যাদা দান করেছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী (সা.)’র যুগে আমরা আমাদের স্ত্রীদের সাথে কথা বলতে এবং প্রাণ খুলে মেলামেশা করতেও ভয় পেতাম এ ভেবে যে, আমাদের সম্পর্কে কোনো আয়াত নাযিল না হয়। [সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫১৮৭] 
এছাড়া জীবন্ত প্রোথিত নারী কবর দেওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (আত: তাকভীর]
নারীদের সাথে সদয় আচরণ করো [সূরা আন-নিসা]
স্ত্রীদের কাঁচের সাথে তুলনা করে নবী (সা.) বলেন, এক সময় রাসূল (সা.) ও স্ত্রীগণ উটের পিঠে সফর করেছিলেন। তিনি বলেন, কাঁচগুলোকে স্ত্রীদেরকে একটু দেখে শুনে যতেœর সাথে নিয়ে যাও’। [সহীহ্্ মুসলিম, হাদীস নং-৬১৮২]
সহিংসতা ও অবমাননার পরিস্থিতি থেকে নারী মুক্তির উপায় : ১) সমাজের সকল স্তরের কর্তা ব্যক্তিগণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার পরিচালকবৃন্দ এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে কর্মরত কর্মী ও শিল্পীদেরকে নারী উন্নয়নের পশ্চিমা ধ্যান-ধারণা বর্জন করে ইসলাম থেকে দিকনির্দেশনা গ্রহণ করতে হবে।
২) নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে বর্তমান স্তরেই বিলোপ সাধন করতে হবে। শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি, সাংস্কৃতিক কর্মকা- ও অনুষ্ঠানাদিতে মহিলাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতে হবে। হাদীসে এসেছে : কোনো ব্যক্তি যেন কোন স্ত্রী লোকের সাথে তার মাহরাম পুরুষের উপস্থিতি ছাড়া নিরিবিলিতে সাক্ষাত না করে। [বুখারী]
আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা প্রাচীন জাহেলী যুগের মত নিজেদের সাজসজ্জা প্রকাশ করে বেড়িয়ো না। [আল আহযাব-৩৩]
৩) ‘কবিতা, গল্প, সঙ্গীত, সিনেমা, রেডিও, টেলিভশন এবং পত্র-পত্রিকাকে অশ্লীলতা ও যৌনতার স্পর্শ থেকে যেকোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। তোমরা অশ্লীলতার ধারে কাছেও যেয়ো না।’ [আল-কুরআন]
৪) নিজেদেরকে সব সময় একজন মুসলিম নারীর বেশে রাখুন। আপনি যদি ঈমানদার হন এবং নিজের ব্যক্তিত্বকে রোযা, নামায, যিকির ও দোয়া দ্বারা সজ্জিত রাখেন তাহলে এসব সৎ কাজের বরকতেও আপনি নিরাপত্তার গ্যারান্টি পাবেন।
৫) একমাত্র ঈমানদার ও লজ্জাশীলা আত্মীয়স্বজন, শিক্ষা সহপাঠিনী এবং ইসলামের দাওয়াতে ব্যাপৃত থাকে এবং ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে তাদের সাথে সম্পর্ক রাখুন।
৬) শিক্ষা ও সাংসারিক কাজে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে পর্দার বিধান মেনে চলুন। পুরোপুরি পর্দা না করলেও অন্তত শালীন পোশাকে চুল, সাজসজ্জা ও শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশ ঢেকে চলাফেরা করুন।
হে নবী, তুমি/ তোমরা স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিন নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা যাবে কিন্তু উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। [আহযাব-৫৯]।
৭) গায়েরে মুহাররম পুরুষদের সাথে মেলামেশা এড়িয়ে চলুন। একান্ত বাধ্য হলে পর্দার সাথে সাধারণ পোশাকে সুগন্ধি ও সাজসজ্জা ছাড়া যাবেন। সুললিত কণ্ঠে হেসে হেসে ভাবভঙ্গি সহকারে কথা বলে কাউকে অবাস্তব আশা পোষণ করার সুযোগ দেবেন না। মাঝখানে এতটা ব্যবধান রাখবেন যে, কেউ মুখ দিয়ে কোন বাজে কথা বলা দূরে থাক, ইশারা ইঙ্গিতেও কোন খারাপ মনোভাব ব্যক্ত করতে না পারে।
মহান আল্লাহ বলেন, তাহলে পর পুরুষদের সাথে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে যার অন্তরে ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে। [আহযাব-৩২]
ইসলাম যে নারী অধিকারের পতাকাবাহী এব্যাপারে আদৌ কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। ইউরোপ তো সাম্প্রতিককালেই নারীর প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ হবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কুরআন আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগেই ঘোষণা করেছে: ‘নারীদের ওপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষদের ওপরও নারীদের অধিকার রয়েছে ন্যায়সঙ্গতভাবে।’
কিন্তু সেই সাথে আমাদের এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না, মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘নারীদের ওপর পুরুষদের খানিকটা অগ্রাধিকার রয়েছে। যে অধিকারগুলো আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে-
(১) মোহর আদায় (২) যৌতুক প্রথা বন্ধ (৩) প্রয়োজনীয় ভরণপোষণে বাধ্যবাধকতা (৪) নারীদের সম্পত্তি বুঝে নেওয়া (৫) শান্তিপূর্ণ বাসস্থান নিশ্চিত করা। প্রয়োজনে ইসলাম একক পরিবারকে সমর্থন করে। (৬) হক্ব বা অধিকার ভালভাবে জানা ও তা মানার চেষ্টা করা। অর্থাৎ মহিলাদের মূল দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত থাকা। (৭) সর্বোপরি ইসলামের বিধি বিধান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চললে সহিংসতা ও অবমাননাকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ