শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

এইচ এম এরশাদ’র ইন্তিকাল

* প্রথম জানাযা সম্পন্ন কাল দাফন
স্টাফ রিপোর্টার : সাবেক প্রেসিডেন্ট, সাবেক সেনাপ্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ইন্তিকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল রোববার সকাল পৌনে ৮টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সহকারী পরিচালক রাশেদুল ইসলাম খান এরশাদের মৃত্যুর খবর প্রথম জানিয়েছেন।
এরপর এরশাদের পরিবারের সদস্যরা খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন। সাবেক এই রাষ্ট্রপতির মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর স্ত্রী জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ, ছোট ভাই জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ দলের ঊর্ধ্বতন নেতারা সিএমএইচে ছুটে যান। এরশাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল থেকে শোক জানানো হয়।
এরশাদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর (এরশাদের) আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে এরশাদের গঠনমূলক ভূমিকার কথা স্মরণ করেন। একই সঙ্গে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তিনি।
বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম জানাযা সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল রোববার বাদ জোহর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট জামে মসজিদে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাযায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, পরিবারের সদস্য ও সেনা সদস্যসহ জনসাধারণ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে সিএমএইচ থেকে এরশাদের লাশ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট জামে মসজিদে নেয়া হয়। জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা গেছে, আজ সোমবার সকাল ১০টার দিকে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এরশাদের দ্বিতীয় জানাযা হবে। বেলা ১১টায় এরশাদের লাশ নেয়া হবে কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে।
বাদ আসর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে এরশাদের তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। রাতে সিএইমচের হিমঘরে এরশাদের লাশ রাখা হবে। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় এরশাদের লাশ হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হবে রংপুরে। সেখানে জানাযার পর লাশ নিয়ে আসা হবে ঢাকায়। মঙ্গলবার ঢাকার সামরিক কবরস্থানে এরশাদের দাফন  করার কথা রয়েছে।
গত ২৬ জুন সকালে এরশাদ (৮৯) অসুস্থবোধ করলে তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। তিনি রক্তে হিমোগ্লোবিন-স্বল্পতা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন। তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।
আশির দশকে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আট বছর ক্ষমতায় থাকা সাবেক এই সামরিক শাসক একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার দিনহাটায় জন্মগ্রহণ করেন এরশাদ। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন।
বিগত শতাব্দীর আশির দশকে সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে টানা আট বছর রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন এরশাদ। নব্বইয়ের দশকের শেষে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় নেন এই সামরিক শাসক।
মাঝখানে কিছুদিন কারাবাস করলেও প্রায় চার দশক নিজের রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন এরশাদ। বারবার জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন; সর্বশেষ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
বর্ণময় চরিত্রের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার দিনহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তিনি চট্টগ্রামের পূর্ব বাংলার রেজিমেন্টাল ডিপোর উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৬৬ সালে কোয়েটায় মর্যাদাপূর্ণ কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ থেকে উন্নত কোর্স সম্পন্ন করেন। শিয়ালকোটে একটি ব্রিগেডের সঙ্গে সেবা করার পর তাঁকে ১৯৬৯ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড এবং ১৯৭১ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে এরশাদ পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৯ সালে তাঁকে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯১ সালে এরশাদ গ্রেপ্তার হন। ছয় বছর কারাভোগের পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন।
কারাগারে থেকে এরশাদ ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে নিজ জেলা রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন।
গণঅভ্যুত্থানে পতনের পরও এরশাদের দল জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদে উল্লেখযোগ্য আসনে বিজয়ী হয়। কমবেশি করে একই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল পরবর্তী সময়ের সাধারণ নির্বাচনেও। ২০০৬ সালে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের দল বিরোধী দলের ভূমিকায় উঠে আসে।
এরশাদের ইন্তিকালে রংপুরে শোকের ছায়া
মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, রংপুর অফিস : জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যু সংবাদ গতকাল রোববার সকালে ছড়িয়ে পড়ার পর রংপুরের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এরশাদের দাফন কার্য তাঁর শেষ ঠিকানা রংপুরের পল্লী নিবাসে করার দাবি জানিয়েছে রংপুরের জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ। তাদের দাবি এরশাদকে রংপুরের মাটিতেই সমাহিত করা হোক। বাবা-মায়ের পাশে অথবা এরশাদের নিজ হাতেগড়া স্বপ্নের পল্লী নিবাসে। এরশাদের মৃত্যুতে রংপুর সদর আসনে ২৮ বছরের একটানা রাজত্বের অবসান ঘটলো জাতীয় পার্টির। এখন থেকে রংপুরের হাল কে ধরবেন এ নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনার ঝড়।
গতকাল রোববার সকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে রংপুরবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। পথেঘাটে সর্বত্রই এরশাদকে নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে আলোচনা করতে দেখা গেছে। অনেককে মন্তব্য করতে শোনা গেছে এরশাদের অবর্তমানে রংপুরে এবং জাতীয় পার্টিতে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হলো তা অপূরণীয়। তবে এরশাদকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষের মাঝে। কারণ ১৯৯১ সাল থেকে রংপুর সদরের মানুষ এরশাদকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে আসছে। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মাঝে এরশাদের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফিজার রহমান মোস্তফা জানান, স্যারের দাফন রংপুরে করার জন্য আমি সংবাদ সম্মেলন করেছি। আমাদের রাজনৈতিক পিতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্যার পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। এক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র দাবি স্যারের অসিয়ত করা স্থান পল্লী নিবাসে তাকে সমাধিস্থ করতে হবে। মোস্তফা আরো বলেন, এরশাদ স্যার অসুস্থ শরীর নিয়ে এ বছরের মার্চে রংপুরে এসেছিলেন। তিনি নিজেই বলেছিলেন আমার শরীর ভালো নেই। আমি যে কোনো সময় মৃত্যুবরণ করতে পারি। তোমরা আমার ডিজাইনে পল্লী নিবাসে আমার সমাধি কমপ্লেক্সে করিও। আমি মৃত্যুর পরও তোমাদের মাঝে থাকতে চাই। জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফখর-উজ-জামান জাহাঙ্গির বলেন, আমরা চাই আমাদের নেতাকে রংপুরের মাটিতেই কবরস্থ করা হউক। রংপুরের মানুষ  সব সময় যেন তার কবর জিয়ারত ও দোয়া কামনা করতে পারে এ জন্য আমরা চাই তাকে রংপুরের মাটতেই দাফন করা হউক। গত ২৮ জুন রংপুরে আসার কথা ছিল এরশাদের। তার সফরে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। বাড়ির নির্মাণ কাজ দেখতেই তিনি রংপুরে আসতেন এবং নির্মাণাধীন বাড়িতেই এবার উঠার কথা ছিল তার। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি রংপুরে আসতে পারেননি। সুস্থ্য হয়ে তার নিজ হাতেগড়া স্বপ্নের ভবন পল্লী নিবাস দেখা আর হল না। দু’রাত অবস্থান শেষে ৩০ জুন এরশাদের ঢাকায় ফেরার সূচি চূড়ান্ত হয়েছিল। শারীরিক অসুস্থতার কারণে হেলিকপ্টারে করে তার আসার কথা ছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে আশা হয়নি। রংপুর শহরে অবস্থিত এরশাদের ব্যক্তিগত আবাস ‘পল্লীনিবাস’। এটি সংস্কার করে তিন তলা ভবন তৈরি করা হচ্ছে। পুরাতন ভবন ভেঙে তিন তলা কমপ্লেক্স করা হচ্ছে। দ্বিতীয় তলায় এরশাদ ও ছেলে এরিকের কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। ভবনটির দ্বিতীয় তলার কাজ শেষ পর্যায়ে এখন চলমান রয়েছে। তৃতীয় তলার ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে। সর্বশেষ এরশাদ রংপুর সফরে এসেছিলেন ৩ মার্চ। তখনও বাড়ির কাজ দেখতেই রংপুরে এসেছিলেন। রোববার সকালে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চির-বিদায় নেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। তাঁর মৃত্যুর কারণে এরশাদের আর পল্লী নিবাস দেখা হল না।
এদিকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদের অবর্তমানে রংপুরের রাজনীতির হাল কার হাতে থাকবে এ নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে এরশাদের অবর্তমানে সদর আসন আর জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেয়া হবে না। অপরদিকে জাতীয় পার্টি মনে করছে সদর আসন জাতীয় পাটির্র আছে ভবিষতেও থাকবে।  ১৯৯১ সাল থেকে এই আসনটি এরশাদের দখলে। জোট গত নির্বাচনের কারণে গত ৩টি নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগ কোন প্রার্থী দেয়নি। ফলে এরশাদই বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছে। জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা মনে করছেন, দলের চেয়ারম্যানের মৃত্যুর কারণে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার নেতৃত্বে দল আরো সু সংগঠিত হবে। দলের চেয়ারম্যানের অবর্তমানে এখানে আওয়ামী লীগ কিংবা অন্য কোন দল সুবধা করতে পারবে না। এদিকে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা মনে করেন, দীর্ঘদিন থেকে রংপুর সদর আসনটি এরশাদ দখল করে  রেখেছেন। তিনি এলাকায় না থাকার কারণে এখানকার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আগামীতে এখানে আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই। এদিকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য ও আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইস্তেহার কমিটির সদস্য রংপুর সদরের মানুষ চৌধুরী খালেকুজ্জামান বলেন, আমি দোয়া করি এরশাদ সাহেবকে আল্লাহ বেহেস্ত নসিব করুক। উপ-নির্বাচন হলে সে ক্ষেত্রে আমি বলবো রংপুর সদর আসনে আওয়ামী লীগের একজন যোগ্য প্রার্থী দেয়া হউক।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ