শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বিরল রোগে আক্রান্ত নজরুলের জীবন ক্রমান্বয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে

খুলনা অফিস : পরিবারের বড় সন্তান মো. নজরুল ইসলাম (৩০)। তার ছোট আরও ৫ ভাই-বোন রয়েছে। তার ওপর বৃদ্ধ মা-বাবা। জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসাবে পরিবারের হাল ধরার কথা ছিল তার। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। দুরারোগ্য এক বিরল ব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। ডান পায়ের পাতা থেকে কোমর পর্যন্ত ফুলে প্রচ- ভারি হয়ে গেছে। দেখতে অনেকটাই হাতির পায়ের মত। যার প্রভাবে শরীরের ডান দিকের অংশে বুক, কান এবং মাথাও আক্রান্ত হতে শুরু করেছে। ফলে কোনো কাজকর্ম করা বা চলাফেরাও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
নজরুল ইসলাম খুলনা মহানগরীর দক্ষিণ টুটপাড়া বড় খালপাড় সংলগ্ন ৬০/১১, ওয়েস্ট সার্কুলার রোড এলাকার ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। তার পিতার নাম রস্তুম আলী।
চিকিৎসকরা বলছেন, রোগের নাম ‘ফেলারিয়াসিস’। তবে, পা ফুলে হাতির পায়ের মত দেখা যায় বলে রোগটি ‘ফাইলেরিয়া অ্যালিফ্যান্ট’ নামেও পরিচিত। মশা বা এ জাতীয় বিষাক্ত কোনো প্রাণির কামড়ে এ রোগ দেখা দিয়েছে। তার সুস্থতার জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের চিকিৎসা ও প্রচুর অর্থ। কিন্তু তার দরিদ্র পরিবারের পক্ষে অর্থের সংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে টগবগে যুবক নজরুল ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে পড়ছে। একদিকে নিজের অক্ষমতা, অন্যদিকে অসুস্থ মা-বাবার চিকিৎসা এবং ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়া ও সংসার পরিচালনায় কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে না পারার বেদনায় জীবন ক্রমান্বয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠছে তার।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নজরুলের বয়স যখন ৭-৮ বছর, তখন কোনো বিষাক্ত প্রাণির কামড়ে হঠাৎ করেই তার ডান পায়ের পাতা ফুলতে শুরু করে। সঙ্গে ব্যথাও। প্রথমে স্বাভাবিক মনে করে ওষুধ সেবন করলেও নিরাময় হয়নি। নিরাময় হচ্ছে, হবে- এ আশায় কেটে যায় প্রায় দশ বছর। কিন্তু ততদিনে হাঁটু পর্যন্ত ফুলে যায়। পা ভারি হতে থাকে। এক পর্যায়ে পায়ের প্রতিটি শিরায় প্রচন্ড যন্ত্রণা, পানি ঝরা, খিঁচুনি এবং বমিসহ বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। যে কারণে লেখাপড়া পঞ্চম শ্রেণির গ-ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় রিকশার গ্যারেজে কাজ নেয় নজরুল। ভারি পা ও অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রচ- মনোবলের সঙ্গে কখনও কখনও রিকশা চালিয়েও সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করে সে। কিন্তু এখন আর সেটি সম্ভব হয় না। এখন বাড়তে বাড়তে কোমর পর্যন্ত ফুলে গেছে। দেখতে অনেকটাই হাতির পায়ের মত। এছাড়া এ রোগের প্রভাবে তার বুকের ডান অংশে চাকাচাকা অনুভব হচ্ছে। ডান কানেও ঠিকমত শুনতে পাচ্ছে না। মাথায়ও প্রচ- যন্ত্রণা হচ্ছে। ভারি কাজ বা বোঝা বহন ও জোরে হাঁটা-চলা করলে নানান সমস্যা দেখা দেয়। বর্তমানে নজরুল খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মো. রেজাউল মোমিনের তত্ত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা প্রহণ করছেন। তবে, অর্থাভাবে প্যাথলজি পরীক্ষা এবং ওষুধ কেনা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
যৌন ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. আখতার-উজ-জামান বলেন, এ রোগের নাম ‘ফেলারিয়াসিস’। তবে, পা ফুলে হাতির পায়ের মত দেখা যায় বলে রোগটি ‘ফাইলেরিয়া অ্যালিফেন্ট’ নামেও পরিচিত। মশা বা এ জাতীয় বিষাক্ত কোনো প্রাণীর কামড়ে মাইক্রো ব্যাক্টেরিয়ার ফলে এ রোগ হয়ে থাকে। প্রথম দিকে রি-কনসটেকটিভ সার্জারী করা সম্ভব হলে এ রোগ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বিরল ব্যাধিতে আক্রান্ত নজরুল ইসলাম তার অসহ্য যন্ত্রণা এবং দুর্বিষহ জীবনের অসহায়ত্বের কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে অন্য দশজনের মত তারও অনেক স্বপ্ন, আশা ছিল। কিন্তু এ রোগের কারণে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রতিবন্ধীর চেয়েও অসহায় জীবনযাপন করতে হচ্ছে। অর্থের অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেননি। তার এ অসহায়ত্ব দেখে অনেকেই আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু মেলেনি কোনো সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা। এখন তিনি তার চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সহায়তার আশায় অপেক্ষা করছেন। আবেদন জানিয়েছেন সুস্থ জীবন ফিরে পেতে সামান্য সহানুভুতির।
যুবক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ দেশেরই কারও সন্তান, কারও ভাই। আমিও সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাই। নিজের সংসার, মা-বাবা ও ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনা করতে চাই। ভিক্ষা করে নয়, কাজ করে খেতে চাই। কিন্তু এই ভারি পা নিয়ে আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী অনেক অসহায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি আমারও দায়িত্ব নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে কৃতজ্ঞ হতাম’।
নজরুলের বাবা রুস্তুম আলী ও মা হনুফা বেগম তাদের বড় ছেলের এ দুরারোগ্য ব্যাধির বিষয়ে চরম হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার। এর মধ্যে ছোট দু’ ছেলে-মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী। সেঝ ছেলে সুমনও হার্টের রোগী। একমাত্র মেঝ ছেলে আল-আমিনের সামান্য চায়ের দোকান থেকে উপার্জিত অর্থে এতবড় সংসার চলছে। বড় ছেলের দুরারোগ্য ব্যাধির কোনো চিকিৎসা করাতে পারছি না। ছেলের চিকিৎসার সহায়তার জন্য বৃদ্ধ এ মা-বাবা প্রধানমন্ত্রীসহ সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ