শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

শিক্ষকদের নৈতিকতার অবক্ষয় : শিক্ষাঙ্গনের বিপর্যয়

মো. আখতার হোসেন আজাদ : বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। শাস্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জ্ঞান সৃষ্টি, আহরণ ও বিতরণ কেন্দ্র। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় বিচরণ করে নিজেদের সৎ, যোগ্য, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহারলাল নেহেরু বলেছিলেন, একটি দেশ ভালো হয়, যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়। বর্তমান সময়ে অবশ্য এই উক্তিটি জাদুঘরে স্থান পেতে চলেছে। খুব লজ্জার স্বরে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্রের যে অধঃপতন শুরু হয়েছে তা দেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদন্ড। আর সে মেরুদন্ড গড়ার কারিগর হলেন শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের কর্ণধার ভাবা হয়। সুশিক্ষা, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলবেন, এটিই শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আজ শিক্ষক সমাজের চরিত্রেই যেন ঘুণে ধরেছে। একজন আদর্শবান শিক্ষক একটি সমাজকে আলোকিত করতে পারেন আবার একজন চরিত্রহীন শিক্ষক একটি সমাজকে ধ্বংসও করে দিতে পারেন। আগেকার দিনে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হতো শিক্ষার্থীদের নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয়, কারণ-প্রতিকার শিরোনামে। আজ শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন নিয়ে লিখতে হচ্ছে বলে চরম লজ্জাবোধ করছি।
শিক্ষকরা সমাজের আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তি। কিন্তু সেই আদর্শনীয় কোনো ব্যক্তি নীতি আর নৈতিকতার মুখোশে মুখ ঢেকে রেখে দিনের বেলার চরিত্র একরকম ও রাতের চরিত্র ভিন্নরকম করে থাকেন এবং তা যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সমাজ তথা পুরো দেশের কাছে কতটা ঘৃণিত হন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যখন ঘুষ নেবার অভিযোগ প্রমাণিত হয়, যখন নিজ কিংবা অন্য বিভাগের কোনো শিক্ষার্থীর সাথে আপত্তিকর ফোনালাপ কিংবা ভিডিও সকলের কাছে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেই শিক্ষকের কর্মকান্ড কেবলমাত্র সেই বিভাগ বা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলঙ্কিত করেনা, বরং তা পুরো শিক্ষকসমাজকে কলুষিত করে। সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষকের বিবাহিত এক ছাত্রীর সাথে আপত্তিকর ছবি প্রকাশ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া নিয়োগ বাণিজ্যে কিছু শিক্ষকের জড়িত থাকা ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক বিভাগের শিক্ষকের ছাত্রীর সাথে আপত্তিকর ফোনালাপ প্রকাশ হওয়ায় হতবাক হয়েছে সারা দেশের মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন কার না থাকে! কিন্তু সেই স্বপ্নের চূড়ায় পৌঁছাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় জ্ঞানপাপী কতিপয় শিক্ষক। অর্থের কাছে নিজের নৈতিকতা ও আত্মমর্যাদা বিক্রি করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যখন ১৮ কিংবা ২০ লাখ টাকায় কাউকে শিক্ষক বানানোর মতো ঘৃণিত কাজ করেন, তখন শুধুমাত্র তিনি একটি অপরাধই করেন না বরং আরেকটি মেধাবী ও যোগ্যতম প্রার্থীকে বঞ্চিত করেন। রাজনৈতিক পরিচয়, অর্থের বিনিময়, পারিবারিক সম্পর্কই যেন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবার মাপকাঠি। অর্থই যদি প্রধান হয়, তবে এতো কষ্ট করে পড়ালেখা করার কি প্রয়োজন! তাঁরা ঘোষণা দিবেন, যে ২০/২৫ লাখ টাকা দিতে পারবে তাকে আমরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিব। এতে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হবার পর থেকেই অর্থ সংগ্রহে মনোযোগ দিবে আর পাশাপাশি কোনোরকমে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করবে।
এইবার আসি অন্য দিকে। ছোট বেলায় শিক্ষকরা বারবার শিখিয়েছেন, পরীক্ষার খাতায় বহুবার লিখেছি এই বিখ্যাত প্রবাদটি- ‘If money is lost, nothing is lost. Health is lost, something is lost. But character is lost, everything is lost.’ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের চরিত্র নিয়েই শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করতে হয়। মাদ্রাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যৌন হয়রানি আজ যেন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজ বিভাগের ছাত্রীকে বেশি নাম্বার পাইয়ে দেবার প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক কার্য সম্পাদন করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকের যেন এখন নিত্যদিনের কাজে পরিণত হয়েছে। প্রায়ই পত্রিকায় শিক্ষক-ছাত্রীর কু-কর্মের কথা প্রকাশিত হয়। এতে একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েকে পড়তে পাঠিয়ে তাদের অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন এই ভেবে যে তার মেয়ে সম্ভ্রম নিয়ে বাড়িতে ফিরতে পারবে কি না অপরদিকে এখন যেসব মেয়েরা কলেজ কিংবা স্কুল পর্যায়ে পড়ছে, তাদের অভিভাবকেরা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন। ফলে দেশের নারী শিক্ষার হার যেভাবে অগ্রগতি ছিল, তাতে ভাটা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এইসব অপরাধের জন্য তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কখনও বা সেই তদন্ত কমিটি হারিয়েও যায়। আবার কখনও বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ও প্রশাসনের দ্বারা শাস্তি নিশ্চিত হলেও উচ্চ আদালতে রিট করে অভিযুক্তরা আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে পার পেয়ে যান। শুধু তাই নয়, বরং বন্ধ হওয়া ইনক্রিমেন্ট, বেতন-ভাতাদি, প্রমোশন সবই পান সুদে-আসলে।
ভিন্নমতের রাজনীতি চর্চা করার অধিকার যেকোনো শিক্ষার্থীরই আছে যদি তা দেশ বা সমাজবিরোধী সংগঠন না হয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় হলো উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। কিন্তু শিক্ষার্থী শিক্ষকের বিরোধী মতের রাজনীতি চর্চা করে বলে তার কোর্সে কম নম্বর দেওয়া এমনকি ফেল করিয়ে দেবার মতোও অভিযোগ পত্রিকার পাতায় আমাদের দেখতে হয়েছে। কষ্ট হলেও বলতে হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সামনে ধূমপান করা কতিপয় শিক্ষকের একটি স্বাভাবিক বিষয়। সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের মুখের উপর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে যেন সঙ্কোচের ছোঁয়াও লাগেনা তাদের।
আরেকটি দুঃখজনক বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। কোনো কোনো শিক্ষক সকাল ৯ টায় ক্লাস নেবার শিডিউল থাকলেও তিনি যদি শিক্ষার্থীদের অপেক্ষায় রেখে ১১ টায় ক্লাস নেন, তাতেও কোনও অপরাধ নেই। কিন্তু তার ক্লাসে প্রবেশের ৫ মিনিট পরে যদি কোনও শিক্ষার্থী প্রবেশের অনুমতি চায়, তাতেই ঘটে বিপত্তি। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে অপদস্ত করতেও ছাড়েন না তখন। আবার ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার নামে প্রোজেক্টরে দীর্ঘদিনের পুরোনো স্লাইডেই ক্লাস নিতে থাকেন বছরের পর বছর। 
শিক্ষকতা সমাজের সর্বোপরি মর্যাদাপূর্ণ পেশা ছিল। সে মর্যাদায় যেন এখন যেন পচন ধরেছে এবং তা শুধু কেবলমাত্র কতিপয় পশুরূপী শিক্ষকের জন্য। আমাদের সমাজে এখনও অনেক সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক রয়েছেন। কতিপয় শিক্ষকের কু-কর্মে তারা প্রতিনিয়ত অপমানবোধ করছেন। এখনই সময় রুখে দাঁড়ানোর। যারা শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে কলুষিত করছে তাদের সাময়িক নয়, আজীবন বহিষ্কার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এইজন্য সরকারের সু-দৃষ্টি প্রয়োজন। রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে যেন কোনও অপরাধী পার পেয়ে যেতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর রাষ্ট্রকে রাখতে হবে। এছাড়াও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পাঠদানের পদ্ধতি, ব্যক্তিত্ব, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন বিষয় ভিত্তি করে জরিপ চালানো যেতে পারে। এতে বেরিয়ে আসবে আরও নিত্য নতুন তথ্য। দেশের জন্য শিক্ষকদের রয়েছে প্রশংসনীয় ভূমিকা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের এর গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বই-এর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা ছিল অনবদ্য ও অতীব প্রশংসনীয়। তাদের নেতৃত্ব, দিক-নির্দেশনা থেকে তখন ধাপে ধাপে জাতির বিভিন্ন শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তি লাভ করেছিল। তাদের এই সম্মানকে কখনও ধূলিসাৎ করতে দেয়া যাবে না। একজন ছাত্রকে উচ্চশিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করে আদর্শ চরিত্রবান মানুষরূপে গড়ে দেশসেবায় নিয়োজিত করতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও সেই কারিগরদের নৈতিকতায় যদি কালিমা লেগে যায়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ কান্ডারিদের কি হবে সেটি প্রশ্ন থেকেই যায়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ