শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পাবনায় পশুর চর্বি ও পাম অয়েল দিয়ে তৈরি হচ্ছে ‘গাওয়া ঘি’

ভেজাল কারখানায় অভিযান

পাবনা সংবাদদাতা : পাবনা জেলার দুধ উৎপাদন প্রধান এলাকাগুলো বিশেষ করে সাঁথিয়া, সুজানগর, বেড়া, ফরিদপুরে দেদারছে তৈরি হচ্ছে ভেজাল দুধ, ঘি ও মাঠা। এক শ্রেণির অসাধু দুধ ব্যবসায়ী (ঘোষ বলে পরিচিত) এসব ভেজাল দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী তৈরি করে তা কয়েকটি বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করছে।
এসব ঘোষ তাদের বাড়িতে অথবা অন্যত্র কারখানা গড়ে তুলে এ ভয়ানক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। বহু প্রতারক এরকম ব্যবসা খুলে দিনমজুর থেকে বছর যেতেই কোটিপতি বনে যাচ্ছে।
এরা বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দুধ ক্রয় কেন্দ্রের এক শ্রেণির কর্মকর্তার সাথে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে খুব সহজেই নকল দুধ ও ঘি বিক্রি করতে পারছে। তবে বেসরকারি দুগ্ধ ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভেজাল দুধ কেনার কথা অস্বীকার করেছে।
জানা গেছে, তৈরি করা ভেজাল দুধের বেশিরভাগই খাটি দুধের সাথে মিলে মিশে চলে যায় রাজধানীতে। আর সামান্য কিছু বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে। স্থানীয় সূত্রগুলোর হিসেবে প্রতিদিন এখন প্রায় ৪০ হাজার লিটার ভেজাল দুধ ও ১৫ শ’ লিটার ভেজাল ঘি বাজারজাত হচ্ছে।
স্থানীয় জনসাধারন জানান, ‘ঘোষ’ নামে পরিচিত দুধ সরবরাহকারীদের প্রতিটি কারখানা ও তাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়েই কেবলমাত্র এ ভেজাল দুধ, ছানা ও ঘি তৈরি বন্ধ করা সম্ভব। তবে ভেজাল বিরোধী অভিযানে কিছু ভেজালকারী ধরাও পড়ছে।
বৃহস্পতিবার (২০জুন) দুপুরে পাবনার সুজানগর উপজেলার নন্দিতাপাড়া গ্রামের একটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাবের একটি দল ভেজাল দুধ, মাঠা ও ঘি প্রস্তুতকারী দুই জনকে আটক করে।
এ সময় দুধ, ঘি ও মাঠা তৈরির বিপুল পরিমাণ ভেজাল উপাদান ও কিছু যন্ত্রপাতি জব্দ করা হয়। আটকরা হলেন, উপজেলার রামজীবনপুর গ্রামের লতিফ প্রামাণিকের ছেলে আলাল প্রামাণিক (২৪) ও কামারদুলিয়া গ্রামের আবুল প্রামাণিকের ছেলে মিঠুন প্রামাণিক (১৮)।
র‌্যাব-১২, সিপিসি-২ এর ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার এসএম জামিল আহমেদ জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তার নেতৃত্বে র‌্যাবের একটি আভিযানিক দল সুজানগরের নন্দিতাপাড়ায় অভিযান চালায়। সেখানে দুলাল ঘোষ নামের এক ব্যক্তির একটি ভেজাল দুধ, মাঠা ও ঘি কারখানায় অভিযান চালিয়ে ওই দু’জনকে আটক করা হয়।
এ কারখানা থেকে ভেজাল দুধ, মাঠা ও ঘি প্রস্তুতের উপাদান পামওয়েল এক হাজার দুইশ’ ষোল লিটার, সয়াবিন তেল ৭৮ লিটার, ভেজাল মাঠা ২৫ কেজি, ভেজাল মাখন ২৭ কেজি, ব্লেন্ডার মেশিন ৬ টি এবং ৭৫ কেজি লবণ উদ্ধার করা হয়।
র‌্যাব আরও জানায়, র‌্যাবের উপস্থিতি টের পয়ে সেখান থেকে কৌশলে কারখানা মালিক দুলাল ঘোষ, তুফাই খাঁ ও কমল ঘোষ পালিয়ে যান।
স্থানীয়রা দুলাল ঘোষের ব্যাপারে জানান, তিনি কয়েক বছর আগেও দিনমজুরি ও বাজারে মাছ বিক্রি করতেন। নকল দুধ, মাঠা ও ঘি তৈরি ও বাজারজাত করে গত কয়েক বছরে ৫তলা একটিসহ ৩টি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এখন তিনি কয়েক কোটি টাকার মালিক।
এর আগে গত ২৬ মে সুজানগর উপজেলার আহম্মদপুর ইউনিয়নের চরগোবিন্দপুর বাজারে নকল ঘি তৈরির কারখানার মালিক সুনিল কুন্ডুর কারখানায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ৫০ মণ নকল ঘি এবং ঘি তৈরির মেশিনসহ অন্যান্য মালামাল জব্দ করেছিল ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই সময় নকল ঘি তৈরির কারখানার মালিক সুনিল কুন্ডু পালিয়ে গিয়েছিল।
 গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমিনপুর থানা পুলিশের সহযোগিতায় যৌথভাবে ওই অভিযান পরিচালনা করেছিলেন সুজানগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুজিৎ দেবনাথ এবং জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে এম হাসান। পরে জব্দকৃত নকল ঘি ডাস্টবিনে ফেলে নষ্ট করা হয়েছিল।
সুজানগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজিৎ দেবনাথ জানান, মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকারক বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে এই কারখানায় নকল ঘি তৈরি করে আসছিল সুনিল কুন্ডু। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। জব্দকৃত প্রায় ৫০ মণ নকল ঘি বাজারে প্রায় ২০ লাখ টাকায় বিক্রি হত।
তিনি জানান, তারা দীর্ঘদিন ধরে নকল ঘি তৈরি করে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তা পাঠাতো। বিভিন্ন কেমিক্যাল দ্বারা এ ঘি তৈরি করা হত। জব্দকৃত ঘি’য়ের মধ্যে দুধের কোনো অস্তিতই নেই। অথচ রাজধানীর মানুষ পাবনার খাটি গাওয়া ঘি বলে কিনে খেয়ে আসছিল।
চরগোবিন্দপুর গ্রামের স্থানীয় জনসাধারণ জানান, প্রায় ৮ মাস ধরে বিভিন্ন কোম্পানিতে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ মণ করে এ নকল ঘি বিক্রি করে আসছিল গ্রামের সুনিল কুন্ডু।
তারা জানান, ১ বছর আগেও সে স্থানীয় বাজারে তরিতরকারি বিক্রি করত। অথচ অবৈধভাবে নকল ঘি’র ব্যবসা করে স্থানীয় বাজারে আইসক্রিম ফ্যাক্টরি, খাবার হোটেলসহ নওগাঁ জেলায় ধানের মিল প্রতিষ্ঠা করেছে এই সুনিল কুন্ডু।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সুজানগরের সুনিল কুণ্ডু, মিলন উৎপাদন প্রধান এলাকায় অনেক ছানা তৈরির কারখানায় প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার ভেজাল দুধ তৈরি হচ্ছে। এসব কারখানায় ছানা তৈরির পর ছানার পানি ফেলে না দিয়ে তা মজুদ করে রাখা হয়। পরে ওই ছানার পানি দিয়ে তৈরি করা হয় ভেজাল দুধ।
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা এলাকার বাসিন্দা মোকারম হোসেন জানান, দুই এক বছর আগে ডেমরা বাজারে যারা দিনমজুরি করত তারা অনেকেই এখন ভেজাল ঘি তৈরি করে কোটিপতি হয়ে গেছে।
সম্প্রতি প্রতারণার কাজ ছেড়ে দেয়া ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাঁথিয়ার এক কারিগর (কথিত কেমিস্ট) জানান, প্রতি মণ ছানার পানিতে ২ কেজি ননী, লবণ, খাবার সোডা, সামান্য ইউরিয়া, ১ কেজি চিনি ও দুধের কৃত্রিম সুগন্ধি মিশিয়ে ভেজাল দুধ তৈরি করা হয়।
এছাড়া এক মণ ফুটন্ত পানিতে ১ কেজি দুধের ননী, আধা কেজি স্কিমড মিল্ক পাউডার, বাটার অয়েল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, এক ফোটা ফরমালিনসহ নানা উপকরণ মিশিয়েও ভেজাল দুধ তৈরি করা হয় বলে তিনি জানান। রাসায়নিক পরীক্ষা ছাড়া শুধু ল্যাকটোমিটার দিয়ে এ ভেজাল দুধ আসল না নকল তা বোঝার উপায় থাকে না বলে তিনি জানান।
সাবেক ওই কারিগর আরও জানান, ভেজাল ঘি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় সয়াবিন, পামঅয়েল, পশুর চর্বি, ভেজিটেবল ফ্যাট, আলুর পেস্ট, রাসায়নিক দ্রব্য, রং ও ফ্লেভার। রোজা বা ঈদ সামনে রেখে এ ভেজাল ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে বলেও তিনি জানান।
পাবনা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলায় ছোট-বড় প্রায় ১৫শ’ দুগ্ধ খামার রয়েছে। এই দুগ্ধ অঞ্চলকে টার্গেট করে মিল্কভিটার পাশাপাশি প্রাণ ডেয়ারি, আকিজ ডেয়ারি, আফতাব ডেয়ারি, ব্রাক ডেয়ারি ফুড (আড়ং), আমো ফ্রেস মিল্কসহ বেশ কিছু বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করতে তাদের আঞ্চলিক দুগ্ধ সংগ্রহশালা স্থাপন করেছে। এর ফলে তরল দুধের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
জানা গেছে, চাহিদার তুলনায় দুধ উৎপাদন কম হওয়ায় ছানা উৎপাদক এবং এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী গোপনে নকল দুধ তৈরি করে তা আসল দুধের সাথে মিশিয়ে বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানে সিংহভাগ ও কিছু স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করে কালো টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তবে বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভেজাল দুধ তৈরি, ক্রয়-বিক্রয় ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কথা অস্বীকার করেছে।
এ প্রসঙ্গে আড়ংয়ের আতাইকুলা চিলিং সেন্টারের কর্মকর্তা ও প্রাণ ডেয়ারি লি. বেড়ার কর্মকর্তারা জানান, তারা বর্তমানে আধুনিক যন্ত্র দ্বারা পরীক্ষা করে দুধ সংগ্রহ করেন।
বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি হাসিব খাঁন তরুণ জানান, মিল্কভিটায় বিশ্বের সর্বাধুনিক মিল্ক টেস্টিং মেশিনের সাহায্যে পরীক্ষা করে দুধ সংগ্রহ ও পরীক্ষা করার পর তা বাজারজাত করা হয়। তাই মিল্ক ভিটায় কেউ ভেজাল দুধ সরবরাহ করতে পারে না।
তিনি জানান, দু’একজন ভেজাল দেয় বলে সবাই তা করে তা কিন্তু নয়। তিনি জানান কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য এ অঞ্চলের দুধের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এতে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এদিকে স্থানীয় জনসাধারণ জানান, ‘ঘোষ’ নামে পরিচিত দুধ সরবরাহকারীদের চিহ্নিত করে তাদের প্রতিটি কারখানা ও বাড়িতে অভিযান চালিয়েই কেবলমাত্র এ ভেজাল দুধ, ছানা ও ঘি তৈরি বন্ধ করা সম্ভব।
তারা জানান, এসব ঘোষদের সাথে দুধ ক্রয় কেন্দ্রগুলোর কিছু অসাধু কর্মকর্তার কমিশন বাণিজ্য রয়েছে। তাই কেন্দ্রগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা চান না ওই ‘ঘোষ’রা ধরা পড়ুক। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের আরএমও এবং বিএমএ পাবনার সেক্রেটারি ডা. আকসাদ আল মাসুর আনন জানান, বিষাক্ত দুধ পান করলে মানব দেহে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
ফরমালিন মেশানোর ফলে লিভার রোগ, কিডনি রোগ, ক্যান্সার, স্কিমড মিল্ক পাউডার খাওয়ার ফলে মানবদেহে হাড়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে শরীরের পেছনের অংশে ব্যথা, চর্মরোগ, হজমে সমস্যা, পেটের পীড়াসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ