শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সামষ্টিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে চাপে রয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার : যে কোনও সময়ের তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে চাপে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলে তা আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের ব্যত্যয় ঘটবে।
গতকাল মঙ্গলবার  রাজধানীর সিরডাপে ‘জাতীয় অর্থনীতির পর্যালোচনা ও আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এই মন্তব্য করেন তিনি। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন, সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সংলাপ পরিচালক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফসহ গবেষকেরা উপস্থিত ছিলেন।
 দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার পেছনে অর্থনীতির একটি শক্ত ভিত ছিল। সেই শক্তিতে এখন চিড় ধরেছে। সেই শক্তিতে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। এর অনুষঙ্গ হলো কর আহরণে অপারগতা। তার মন্তব্য, এখন বাংলাদেশের উন্নয়ন একটা অমোচনীয় প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তা হলো প্রথমত রাজস্ব আহরণ, দ্বিতীয়ত ব্যাংকিং খাতের সংস্কার ও তৃতীয়ত টাকার বিনিময় হার অবনমন করা।
 দেবপ্রিয় বলেন, এটা যদি অতিক্রম না করা যায় তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়নের যে অভিলাস, সেই অভিলাসের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করার সুযোগ কমে যাবে। অন্য উৎস থেকে যদি আমরা বিনিয়োগ করার চেষ্টা করি তাহলে সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বল হবে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
এ সময় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের চিত্রের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এ বছর অর্ধেক এডিপি বাস্তবায়ন হচ্ছে মাত্র ৩ মাসে। এটা যে কী এডিপি হবে সেটা আর ব্যাখা করার প্রয়োজন পড়ে না।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত পরিস্থিতিকে সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ার আরও একটি কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমাদের রেমিটেন্স ভালো, রফতানিও ভালো। তারপরও বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি বাড়ছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে ৫ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান যা কয়েক মাস আগেও ছিল ৮ মাসের সমান।
তিনি বলেন, সরকার যেটা করছে- ডলার বিক্রি করে টাকাকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু, টাকাকে আর স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখার যৌক্তিকতা নেই। বাংলাদেশের টাকাকে এখন নিচে নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে, তার প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে চালু রাখতে হলে। এটা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, সরকার যেটা মনে করছে টাকা সস্তা করলে আমদানি ব্যয় বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর একটা প্রভাব পড়বে। আমরা যেটা মনে করি মূল্যস্ফীতির এখন যে অবস্থান আছে, এই হার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে আছে। সেহেতু টাকাকে একটু অবমূল্যায়ন করা হলে তা সহ্য করার শক্তি অর্থনীতির আছে। কিন্তু, অন্য সময় মূল্যস্ফীতি যদি বেড়ে যায়, তাহলে এটা করা জটিল হয়ে পড়বে। সুতরাং টাকার মান পুননির্ধারণ অবশ্যই প্রয়োজনীয়।
ব্যাংক খাতের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। গত তিন-চার বছর ধরে এ বিষয়ে বলতে বলতে এমন একটা অবস্থায় এসেছি অবশেষে ব্যাংক খাতের সংকট সবাই উপলব্ধি করছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে আমরা তার প্রতিফলন দেখি না। বর্তমান সরকার আসার পর যে কয়েকটা পদক্ষেপ নিয়েছে, সবকটি পদক্ষেপ ব্যাংক খাতের জন্য আরও ক্ষতিকর হয়েছে।
এ সময় তিনি কার্ডধারী প্রত্যেক কৃষককে ৫ হাজার টাকা করে প্রণোদনা  দেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, সম্প্রতি কৃষকদের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়েছে। শিল্প ও কৃষির মধ্যে যে বাণিজ্য স্বত্ব থাকে, এই বাণিজ্য স্বত্ব কৃষকের বিপরীতে গেছে। এটা যদি অব্যাহত থাকে আগামী দিনে বাংলাদেশে কৃষকদের টিকে থাকা খুবই কঠিন হবে। তাই কৃষকের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
 কোনও খাতে এমন অব্যবস্থাপনা নেই যা এই কৃষকের সঙ্গে করা হয়নি দাবি করে ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমরা সিপিডির পক্ষে খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি কৃষকরা অবশ্যই সরকারের কাছে আর্থিক ভর্তুকি দাবি করতে পারেন। কার্ডধারী প্রত্যেক কৃষককে ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা করে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। এতে ৯ হাজার কোটি টাকার মতো লাগবে।
এ সময় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে তা আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের ব্যত্যয় ঘটাবে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে- ‘ঘুষ, অনুপার্জিত আয়, কালো টাকা, পেশি শক্তির মাধ্যমে উপার্জন করা, সেগুলোকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা হবে। তিনি বলেন, সরকার নাকি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেবেন। আমি মনে করি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না।
মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির পক্ষ থেকে ১০টি সুপারিশ তুলো ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- রাজস্ব আহরণের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেওয়া। সরকারি ব্যয়ে শৃঙ্খলা থাকা বা অপচয় রোধ করা। কর ছাড় বন্ধ করা ও কর খাতে বিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো ও সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ কমিয়ে আনা। টাকার মান অবনমন করা। ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা ও সুদের হার ও ব্যাংকের তারল্য সংকট মেটিয়ে ফেলা। পুঁজিবাজারে সংস্কারের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠান করা।
ধানের ক্ষতি পোষাতে প্রত্যেক কৃষককে ৫ হাজার করে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। সরকারি প্রতিষ্ঠানে অডিট করে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া এবং সামাজিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানো।
প্রবন্ধে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ব্যাংক খাতে পুঁজির সংকট বাড়ছে, তারল্য সংকট আগামীতে আরও বাড়বে। তিনি বলেন, খেলাপি কমাতে  সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো কোনও কাজে আসছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য আশু পদক্ষেপ নতুন বাজেটে রাখতে হবে। এ জন্য ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার পরামর্শ দেন তিনি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ