শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

চলতি বছর চালুর কথা থাকলেও হচ্ছে না ॥ কবে হবে নিশ্চিত নয়

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : রাজধানীতে চলমান তীব্র যানজটের কারণে দিনে নষ্ট হচ্ছে গড়ে ৮৩ লাখ কর্মঘণ্টা। এমনটিই গবেষণায় উঠে এসেছে। এই যানজট নিরসনের লক্ষ্যে এই মেট্রো রেল ও বিআরটির মতো বড় দু’টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। মেট্টোরেল প্রকল্পের কাজ মিরপুর থেকে উত্তরা অংশের কাজ চলতি বছরেই শেষ হবার কথা থাকলেও এখনো অর্ধেক কাজ বাকি রয়েছে। অনেক স্থানে এখনো পিলার বসানোর কাজই শেষ হয়নি। এ ছাড়া ২০২০ সালের মধ্যে পুরো মেট্টো রেলের কাজ শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু সেই আশায়ও গুঁড়েবালি। কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে সেটি নিশ্চিৎ করে কেউই বলতে পারছেনা।
২৬ জুন ২০১৬। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মিলনায়তন। সারি সারি আসনে বসে আছেন আমন্ত্রিতরা। কৌতূহলী চোখ অনুষ্ঠানমঞ্চের দিকে। অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১০টা ২০ মিনিট পার হতেই প্রধানমন্ত্রীর হাত স্পর্শ করল সুইচ। সঙ্গে সঙ্গে উদ্বোধন হলো মেট্রো রেল ও বিআরটির কর্মযজ্ঞের। পাশেই হাসিতে উজ্জ্বল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শুধু সড়কমন্ত্রী নন, কর্মযজ্ঞ শুরুর আনন্দ তখন মিলনায়তনে সবার চোখেমুখে। সড়কমন্ত্রী বললেন, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, বিআরটি, কর্ণফুলি টানেলের মতো প্রকল্প প্রধানমন্ত্রীর সাহসী নেতৃত্বের সোনালি ফসল। ২০.১০ কিলোমিটার মেট্রো রেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়া যাবে ৩৮ মিনিটে। ২০.৫০ কিলোমিটার বিআরটিতে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চলাচল করা যাবে ৫০ মিনিটে।
এমন স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যেই দুই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কর্মযাত্রা শুরু হলো। ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার মেট্রো রেল স্থাপন করা হবে। পুরো কাজ শেষ হবে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে। তবে এর আগে ২০১৯ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে ফার্মগেট অংশ চালু হবে। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর এমন আশ্বাসে সবাই খুবই খুশি হলো। কিন্তু কাজের অগ্রগতির খবর নিয়ে সে রকম আশাবাদী হওয়া যাচ্ছেনা। চলতি বছরেই মিরপুর থেকে উত্তরা অংশের কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও এখনো অর্ধেক কাজ বাকি রয়েছে। অনেক স্থানে এখনো পিলার বসানোর কাজই শেষ হয়নি। এছাড়া ২০২০ সালের মধ্যে পুরো মেট্টো রেলের কাজ শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু সেই আশায়ও গুঁড়েবালি। কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে সেটি নিশ্চিৎ করে কেউই বলতে পারছেনা। গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীর যানজটে বছরে ক্ষতি হচ্ছে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। দিনে নষ্ট হচ্ছে গড়ে ৮৩ লাখ কর্মঘণ্টা। যানজট নিরসনের লক্ষ্যে এই মেট্রো রেল ও বিআরটির মতো বড় দু’টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে দেশের প্রথম মেট্রো রেল চালু হবার কথা ছিল। কিন্তু এখনো কোথাও খুঁটি তোলার জন্য মাটি খোঁড়া হচ্ছে। এক্সকাভেটর দিয়ে রাস্তার ওপরের পিচ তোলা হচ্ছে কোথাও। উত্তরায় তৃতীয় পর্বে ডিপো উন্নয়ন করা হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে ভায়াডাক্ট। আগারগাঁও অংশে এক সপ্তাহের মধ্যে আকার পাবে আরো একটি ভায়াডাক্ট। আগারগাঁও থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত মূল সড়কের মধ্যাংশ বন্ধ করে দিন-রাত চলছে কাজ। রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে দেশের প্রথম মেট্রো রেল নির্মাণ প্রকল্পের এখন কর্মোৎসব চলছে। দিয়াবাড়ী, পল্লবী, তালতলা, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও সর্বত্রই পথচারী ও যাত্রীদের চোখ কাড়ছে কর্মযজ্ঞ। মিরপুর-১০ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যানজট যেন নিত্যদিনের দৃশ্য। এখন মতিঝিলের দিকে কাজ চলছে। ফলে ফার্মগেট থেকে মতিঝিলের এই রাস্তায়ও যানজট লেগেই থাকে। বলা হয়েছিল, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার রেলপথ ডিসেম্বরে চালু হতে যাচ্ছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে মেট্রো রেল পথ বসানো ও তা চালু করা সম্ভব হবে। তবে এখন পর্যন্ত প্রথম অংশটিই কবে চালু হবে তা বলা যাচ্ছেনা।
জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ হবে খুঁটির ওপর। তাতে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রেলস্টেশন থাকবে ১৬টি। মেট্রো রেলে থাকবে ১৪ জোড়া ট্রেন। প্রতি ট্রেনে থাকবে ছয়টি করে বগি। আর প্রতি ট্রেনে ৯৪২ জন যাত্রী বসে এবং ৭৫৪ জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারবে। চার মিনিট পর পর ট্রেন ছেড়ে যাবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল চলাচলে সময় লাগবে ৩৭ মিনিট। মেট্রো রেলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা যাবে। জাপান থেকে ট্রেনের ইঞ্জিন-কোচ ও রেল ট্র্যাক কেনার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এতে ব্যয় হবে চার হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। ট্রেন হবে লাল-সবুজের। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকার আর্থিক সহযোগিতায় নেওয়া এই প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক জানান, প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি হয়েছে আশানুরুপ। মাটির ওপরে প্রকল্পের কাজ দৃশ্যমান হয়েছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালু করতে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালুর পর অন্যান্য অংশে তা বিস্তৃত করা হবে। ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে কাজ এগিয়ে চলেছে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশে স্থানে স্থানে পিলার উঠে যাবে আগামী জুনের মধ্যে। তবে সেটি চলতি ডিসেম্বরেও সম্ভব কিনা সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, দিয়াবাড়ীতে ২২ ও ২৩ নম্বর পিয়ারে ভায়াডাক্টের ‘প্রিকাস্ট সেগমেন্ট বক্স’ বসানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, ভায়াডাক্ট পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতে ও নিজস্ব শক্তিতে দাঁড়াতে সময় লাগবে। মিরপুর-১২ থেকে মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, তালতলা, আগারগাঁওয়ের খুঁটি বা পিলার বসানোর কাজ এখনো চলছে। মিরপুর থেকে বিজয় সরণির দিকে যেতে যেতে চোখে পড়ে সড়কের মধ্যাংশ বেষ্টনী দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আড়াআড়ি পথচারী চলাচলের জন্য কোথাও সরু রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বেষ্টনী দেওয়া অংশে কোথাও এক্সকাভেটর দিয়ে রাস্তার ওপরের অংশ, কোথাও মাটি তোলা হচ্ছে। ভারী ট্রাকে মাটি তুলে অন্যত্র সরানো হচ্ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নগরী ঢাকা। কর্মসংস্থানের বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষের স্রোত ঢাকার অভিমুখে। ৭৫ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানা, বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল ঢাকা ও এর আশপাশে। চাকরি ছাড়াও বিচার ও প্রশাসনিক কাজ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে ঢাকায় দিনে যোগ হচ্ছে এক হাজার ৭০০ মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে বছরে ১.৪৭ শতাংশ হারে মানুষ বাড়ছে। ঢাকা মেগাসিটিতে বাড়ছে ৩.৮২ শতাংশ হারে। ২০ বছরে মহানগরে জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। ক্রমবর্ধমান মানুষ বা যাত্রী পরিবহনে ঢাকায় যেখানে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা প্রয়োজন সেখানে আছে মাত্র ৭ শতাংশ। প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ সড়কে প্রতিদিন গণপরিবহন নামছে না। এর বদলে নিয়মিত যোগ হচ্ছে মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিসংখ্যান মতে, সাত বছরে ঢাকায় নিবন্ধিত গাড়ি দ্বিগুণের বেশি বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ৫০ হাজার। ঢাকার সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) বলা হয়েছে, ১৭ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা ৫৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। দৈনিক যাতায়াত বাড়বে ৭১ শতাংশ। যানজট বেড়ে হবে দ্বিগুণ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, যানজটে রাস্তায় আটকে থেকে গড়ে দিনে নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। ২০৩৫ সাল নাগাদ ঢাকার উন্নয়ন সম্ভাবনা নিয়ে গত ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক তথ্য উপস্থাপন করে বলেছে, এখন ঢাকায় গাড়ি চলে ঘণ্টায় সাত কিমি বেগে; ২০২৫ সালে চলবে চার কিমি গতিতে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা নিয়মিত সমীক্ষা ও গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে বলছে, ঢাকা বসবাসের অনুপেযোগী হয়ে পড়ছে। নিউ ইয়র্কভিত্তিক পরামর্শ সেবাদানকারী সংস্থা মার্সারের গবেষণা মতে, বিশ্বের ২৩০ শহরের মধ্যে বসবাসের দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান ২১৪ নম্বরে। শীর্ষস্থানে আছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। ভিয়েনা বসবাসের যোগ্য হওয়ার কারণ সুগঠিত নগর কাঠামো ও নিরাপদ রাস্তাঘাট। আরএসটিপির তথ্য মতে, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ, যা ২০৩৫ সালে হবে দুই কোটি ৬৩ লাখ। এ সময় ট্রিপের সংখ্যা দুই কোটি ৯৮ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে পাঁচ কোটি ১১ লাখে। তবে সরকার ঢাকাকে যানজটমুক্ত রাখতে গত সাড়ে নয় বছরে ছয়টি বড় ফ্লাইওভার ও ওভারপাস উদ্বোধন করেছে। একটি মেট্রো রেল, একটি বিআরটি, দুটি এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। অচল ঢাকা সচল করতে পাঁচটি পথে হবে মেট্রো রেল। এতে বিনিয়োগ দরকার হবে এক লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। মেট্রো রেলের এ পাঁচটি রুটের মধ্যে বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে। নির্মাণকাজের খোঁড়াখুঁড়িতে অনেক ভোগান্তি সইতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ