বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

নৈতিক সমাজ গঠনে রোযার ভুমিকা

মোঃ মোহিব্বুল্লাহ আজাদ : ভূমিকা : ইসলামী শরীয়তের অন্যতম একটি রোকন হচ্ছে রোযা। রমযানে রোযা রাখা প্রত্যেক প্রাপ্ত রয়স্ক, সুস্থ মুসলিম নর-নারীর উপর  ফরয। তাই রমযান মাস আসলেই আমাদের উপর যে দায়িত্ব বর্তায় তা হলো তাকওয়া অর্জন, পারলৌকিক উন্নতি ও সফলতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য গুরুত্বের সাথে রোযা পালন করা। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি, চরিত্র গঠন ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে রোযা একটি অপরিহার্য ইবাদত। ব্যক্তির সার্বিক জীবনে তাকওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণের নিমিত্ত ইসলামী শরীয়তে রোযার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- “হে মুমিনগন ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে করে তোমরা মোত্তাকী হতে পার।” (সূরা বাকারা : আয়াত নং-১৮৩)। সুতরাং রোযা মানুষকে মুত্তাকী বানানোর পাশাপাশি নৈতিক সমাজ গঠনেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রোযা : রোযা ফারসি শব্দ। এর আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘সাওম’। আর ‘সাওম’এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ক. কাজ থেকে বিরত থাকা, খ. কঠোর সাধনা করা, গ. অবিরাম প্রচেষ্টা, ঘ. আত্মসংযম ঙ. খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, ‘সাওম’ তথা রোযা হলো সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা।
নৈতিক সমাজ গঠনে রোযা : আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি,চরিত্র গঠন ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পাশাপাশি রোযা নৈতিক সমাজ গঠনেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিম্নে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে এতদসংক্রান্ত আলোচনা তুলে ধরা হলো-
১. আদর্শ সমাজ গঠন : রোযা পালন বা  সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ রিপুর তাড়না থেকে পরিত্রাণ পায়। যার ফলে লোভলালসা, কামনা বাসনা, ক্রোধ, নেশা, মিথ্যা, প্রতারণা এবং অশ্লীলতার চর্চা থেকে পূতপবিত্র হয়ে সে একটি সুন্দর ও আদর্শ জীবন লাভ করে। এ জীবনের প্রভাব যে সমাজে পড়ে, সে সমাজ একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ হিসেবে গড়ে ওঠে। সুতরাং আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সিয়াম বা রোযার গুরুত্ব অপরিসীম।
২. নৈতিক বিকাশ সাধন : রোযার মাধ্যমে মানুষের নৈতিকতার বিকাশ সাধিত হয়। একজন রোযাদার ব্যক্তি সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণে থাকে। সে কোনো অন্যায় অশ্লীল কাজের প্রতি হাত বাড়াতে ভয় পায়।
৩. ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি : রোযার মাধ্যমে মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। ধনী ব্যক্তি উপবাসের মাধ্যমে গরিবের দুঃখ অনাহারের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে। একে অপরের সুখ দুঃখ উপলব্ধির মধ্য দিয়ে পরস্পরের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ এবং সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়।
৪. ঝগড়াবিবাদ থেকে মুক্তি : রোযাদার যাবতীয় ঝগড়াবিবাদ থেকে নিজেকে সংযত রাখে। রোযার কল্যাণজনিত এ সংযমের ফলে সমাজ অনেক দ্বন্দ¡কলহ থেকে পরিত্রাণ পায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ “কেউ যদি তাকে গালি দেয় কিংবা আঘাত করতে আসে সে যেন বলে আমি রোযাদার।”
৫. নৈতিকতার প্রশিক্ষণ : রোযা নৈতিক চরিত্রের এক বিরাট প্রশিক্ষণস্বরূপ। রোযাদার ব্যক্তির অন্যায়ের প্রবণতা হ্রাস পেয়ে ভালো কাজের স্পৃহা বৃদ্ধি পায়। রোযাদার কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি রিপুগুলো নিয়ন্ত্রণ করে সত্যিকার নৈতিকতার উচ্চ শিখরে উপনীত হতে সক্ষম হয়।
৬. নিয়মানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ : সিয়ামসাধনা রোযাদারকে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষা দেয়। রোযা নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া-দাওয়া করা, ইফতার করা, তারাবীহ নামায আদায় করা ইত্যাদি নিয়মানুবর্তিতার প্রশিক্ষণ দেয়। ফলে সে সময়ের মূল্য অনুধাবন করে দৈনন্দিন কার্যাবলি ঠিকমতো পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।
৭. সহনশীল করে তোলে : রোযা রোযাদারকে ধৈর্য ও সহনশীলতার শক্তি যোগায়। সকল প্রকার পানাহার ও সুন্দরী স্ত্রী কাছে থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর ভয়ে রোযাদার সঙ্গম থেকে বিরত থাকে। এ থেকে বোঝা যায়, রোযা মানুষকে কত ধৈর্যশীল ও সহনশীল করে গড়ে তোলে।
৮. সহানুভূতি ও সহমর্মিতা : সিয়ামসাধনার মাধ্যমে একজন বিত্তশালী নিরন্নের ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুধাবন করতে পারে। ফলে তার মাঝে গরিবদের প্রতি সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ “রমযান মাস সহমর্মিতার মাস।”
৯. সাম্য প্রতিষ্ঠা : ইসলাম যে সাম্যের ধর্ম রোযার মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়। ধনী দরিদ্র, আমির ফকির সবাই একসাথে তারাবীর নামায পড়ে, ইফতার করে। এতে বিরাট সাম্যের ছবি ভেসে ওঠে।
১০. সদ্ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ : রোযা সমাজের অবহেলিত, দিনমজুর ও নিঃস্ব মানুষদের প্রতি উদারতা ও সদ্ব্যবহারের শিক্ষা দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে শ্রমিকের কাজ কিছুটা হালকা করার নির্দেশ দিয়ে বলেনÑ “যে ব্যক্তি রমযান মাসে তার শ্রমিকের কাজ হালকা করে দেয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।”
১১. পরিচ্ছন্ন জীবনের প্রতিশ্রুতি : সিয়ামসাধনার মধ্য দিয়ে রোযাদারের লোভলালসা ও অন্যায় অনিয়মের পরিবর্তে সততার ওপর ভিত্তি করে জীবনযাপন করতে হয়। এতে প্রতীয়মান হয়, সিয়াম বা রোযাই পরিচ্ছন্ন জীবনের প্রতিশ্রুতি।
উপসংহার : নৈতিক সমাজ গঠনে সাওম বা রোযার ভূমিকা অপরিসীম। এর মাধ্যমে মানুষের মাঝে আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষ বিভিন্ন পাপাচার থেকে দূরে থেকে সৎকাজের প্রতি ধাবিত হয়। আমাদের প্রত্যেকের উচিত, রোযার এ মহান শিক্ষাকে উপলব্ধি করা। তাই রোযার প্রতি সকলেরই যতœবান হওয়া অপরিহার্য।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক, ঢাকা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ