দখলদারের রোষাণলে কর্ণফুলীর এক মুক্তিযোদ্ধা ও তার বসতভিটা
চট্টগ্রাম ব্যুরো : পেয়ার মোহাম্মদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যার গোয়ালপাড়ার বাসিন্দা। নিজ বাড়িতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সূখে-শান্তিতে বসবাস করছিলেন তিনি। কিন্তু তার সূখে বাধা হলেন এলাকা প্রভাবশালী ব্যক্তি আজিজুর রহমান। জমিজমা নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন আজিজুর রহমান। ২০০৬ সালে বিরোধটি প্রকাশ্যে রূপ নেয়। ওই বছরই আজিজের বাবা মোহাম্মদ হোসেন প্রকাশ বাইশ্যা মাঝি মারা যায়। পেয়ার মোহাম্মদ তার ভাই-বোন ও স্বজনদের নিয়ে বাইশ্যা মাঝির লাশ দাফন করতে বাধা দেয়। তাদের দাবি, তিনি জীবিত থাকাকালিন জমিজমার বিরোধ মিমাংসা করেননি। ওই পরিস্থিতিতে আজিজ এলাকার সমাজপতিদের উপস্থিতিতে কথা দেয় লাশ দাফন করার পর জমিজমার বিরোধ মিটিয়ে দিবেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আজিজুর রহমান তার কথা রাখেননি। বরং প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ওঠেন।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ বিরোধ মিমাংসার বৈঠকের কথা বলে পেয়ার মোহাম্মদের পুকুর দখল করে ফেলেন আজিজ। স্থানীয় আওয়ামীলীগ এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা ওই পুকুর থেকে মাছ লুট করে নিয়ে যায়। পরের দৃশ্যপট আরো ভয়াবহ। ২০১৪ সালে পুরো বাড়ি-ভিটা দখল করে ফেলেন আজিজ। ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট পেয়ার মোহাম্মদকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। লুট করার হয় তার ঘরের মালামাল। এ ঘটনায় পেয়ার মোহাম্মদ (কর্ণফুলী থানা ১২/০৫/২০১৫, কর্ণফুলী থানা সি.আর মামলা-২৭ নং ২০১৭, কর্ণফুলী সি.আর-৩৯/২০১৮ আদালত ২৬০ নং মিছ মামলা ১০০৯ কর্ণফুলী থানা) মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়ের হলেও স্থানীয় প্রশাসন অদৃশ্য কারণে তাকে সহযোগিতা করছেন না বলে অভিযোগ করেন পেয়ার মোহাম্মদ।
বিষয়টি স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নজরে আসে। তিনি কর্ণফুলী থানার ওসিকে মুক্তিযোদ্ধা পেয়ার মোহাম্মদের বসতভিটা ফিরিয়ে দেয়া নির্দেশ দেন। যথারীতি ফিরিয়ে দেয়া হয়। নির্মাণ করে দেয়া হয় ঘর।
সময় সুযোগের অপেক্ষা করছিল সুচতুর আজিজ। ২০১৭ সালে চরলক্ষ্যায় খুন হয় জাফর আলম (৫০)। পুলিশ ও মামলার বাদির যোগসাজসে ওই খুনের সঙ্গে পেয়ার মোহাম্মদ ও তার পরিবারের সদস্যদের আসামী করা হয়। (কর্ণফুলী থানার মামলা নং ৩৭/২০১৭ তারিখ ২৪/৮/২০১৭) ওই মামলায় পেয়ার মোহাম্মদ খুন করেছে এমন স্বাক্ষি না দেয়ায় জাফর আলমকে হাসপাতালে নেয়া সিএনজি অটোরিক্সা চালক আব্দুস সালাম ও আবছার নামে দু’জনকেও আসামী করা হয়! তারা এখন জেল হাজতে আছে। খুনের আসামী হয়ে গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে যায় পেয়ার মোহাম্মদ। ওই সুযোগে আবার পেয়ার মোহাম্মদের বসতভিটা দখল করে নেয় আজিজ গং। জ¦ালিয়ে দেয় তার ঘর। ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ায় উদ্বাস্তু হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন পেয়ার মোহাম্মদের পরিবার।
মুক্তিযোদ্ধা পেয়ার মোহাম্মদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, একদিকে খুনের মামলার হুলিয়া, অন্য দিকে দখলদার আজিজ গং এর ঘোষিত মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু কেন? কী আমার অপরাধ। প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও পাইনি। তারা যেন কথিত আওয়ামী লীগ নেতারই আজ্ঞাবহ। স্বাধীন দেশেও যেন আমি পরাধীন, নির্যাতনের শিকার। এ জন্য কী, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম প্রশ্ন মুক্তিযোদ্ধা পেয়ার মোহাম্মদের। পরিবার পরিজন নিয়ে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভূমিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন দখলদারের রোষাণলে পড়ে পালিয়ে বেড়ানো এ মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধা পেয়ার মোহাম্মদ অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আজিজুর রহমান। তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন পেয়ার মোহাম্মদ যে বসত ভিটা তার বলে দাবি করছে তার কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। ওই বসত ভিটা আমাদের। আমার বাবা তাদের থাকতে দিয়েছিল। তাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য ১০ গন্ডা জমি অন্যত্র দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা কতিপয় লোকের কু-পরার্মশে সমঝোতায় আসেনি। তিনি আরো বলেন, আমরা ব্যবসা করি। বছরে কোটি টাকা কর দিই। বছরে ৫০ লাখ টাকা দান-খয়রাত করি। কারো বসত ভিটা দখলের প্রশ্নই আসে না। পেয়ার মোহাম্মদকে প্রতারক ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলে অবহিত করেন আজিজুর রহমান।
কর্ণফুলী উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী বলেন, পেয়ার মোহাম্মদ ও আজিজুর রহমানের বিরোধ দীর্ঘদিনের। প্রথমে পরিবারটি উচ্ছেদ হওয়ার পর তিনি দায়িত্ব নিয়ে তাদের বসতভিটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের কাগজপত্র যাচাই করিনি- শুধু মানবিক বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ওই ঘটনায় তাকেও বিতর্কিত করা হয়। পরবর্তীতে এলাকায় একটি খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবারটিকে আবার উচ্ছেদ করা হয়। এসব বিষয় থানা-পুলিশ হয়ে আদালতে গড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি তার জানা নেই বলে জানান উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী।