‘নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে জঙ্গী হামলার শঙ্কা নেই’
স্টাফ রিপোর্টার : শ্রীলঙ্কার হামলা যে বাংলাদেশের জন্য কতটা বিপদের, তা তুলে ধরলেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স নাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গীরা প্রতিবেশী দেশটির হামলা থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজতে পারে।
ইস্টার সানডের দিন রোববার শ্রীলঙ্কায় একযোগে হামলা হয় তিনটি গির্জা এবং কয়েকটি হোটেলে। এতে ৩৫ বিদেশীসহ তিন শতাধিক মানুষ নিহত এবং চার শতাধিক আহত হয়। হামলার জন্য একটি ইসলামী দলকে শ্রীলঙ্কা সরকার সন্দেহ করলেও তাদের পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো গোষ্ঠী রয়েছে বলেও তাদের ধারণা। হামলার দুদিন পর আইএসের নামে দায় স্বীকারের বার্তা এসেছে।
গতকাল মঙ্গলবার আইএসের নামে বার্তার খবর প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা আগে ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে ক্রাইম রিপোর্টার্স ইউনিটির আয়োজনে ‘মিট উইথ মনিরুল ইসলাম’ শিরোনামে অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন মনিরুল, যাতে শ্রীলঙ্কায় হামলার প্রসঙ্গটি আসে।
শঙ্কা প্রকাশ করার পাশাপাশি তিনি বলেন, “বাংলাদেশে কেউ তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে কোনো সহিংস কর্মকান্ড যেন না ঘটাতে পারে, সেজন্য আমরা তৎপর রয়েছি। আমরা, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা সবাই সতর্ক রয়েছি।” বাংলাদেশে জঙ্গীদের এখন বড় ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই বলে দাবি করেন জঙ্গীবিরোধী নানা অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া এই পুলিশ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশে জঙ্গীরা চোরাগোপ্তা বেশ কিছু হামলা চালানোর পর বড় হামলা চালিয়েছিল ২০১৬ সালে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে। ওই হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যা করে তারা। গুলশান হামলার পর আইনশঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গীদের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই ধরা পড়েন কিংবা মারা যান।
বাংলাদেশ থেকে যারা আইএসে যোগ দিতে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল, তাদের ফেরার সম্ভাবনার বিষয়ে মনিরুল বলেন, “বাংলাদেশ থেকে কতিপয় লোক অধিকাংশ আইএসে গেছে ২০১৪ সালের শেষ দিকে।“এদের পাসপোর্টের মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং তারা ফিরতে হলে দূতাবাসে গিয়ে ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করতে হবে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যাচাই-বাছাই করেই ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করতে হবে।”এপ্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, সিরিয়া থেকে সরাসরি বাংলাদেশে আসা যায় না। অন্য দেশের গিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই মারা পড়েছেন কিংবা গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে মনে করেন মনিরুল। “বাংলাদেশ থেকে যারা গেছে যেমন ডাক্তার রোকন, সে সম্ভবত বেঁচে আছে। যারা গেছে, তারা ক্যাপচার, ডিটেইনড অথবা ডেথ। ওইসব এলাকায় বাংলাদেশের কারও আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব নয়, কারণ সিরিয়া বা আশপাশে আইএসের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই।” এরপরও কেউ বাংলাদেশে ফেরত আসতে চাইলে বিমানবন্দরেই ধরা পড়বেন বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
মনিরুল বলেন, শ্রীলঙ্কার পাশের দেশ মালদ্বীপ থেকে বড় একটি সংখ্যায় আইএসে যোগ দিয়েছিল।“মালদ্বীপ থেকে বেশ কিছু সংখ্যক, জনসংখ্যা অনুপাতে ভালো সংখ্যা আইএসে যোগ দিয়েছে। আবার শ্রীলঙ্কা থেকেও কেউ কেউ গেছে, এরকম আমরা শুনেছি। অসমর্থিত সূত্র বলছে ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতেরও ভালো সংখ্যা আইএসের....।”
শ্রীলঙ্কার হামলা কারা চালিয়েছে বলে মনে করেন- সাংবাদিকদের প্রশ্নে মনিরুল বলেন, শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত হামলা চালালেও এর পেছনে আন্তর্জাতিক কোনো সংগঠন যুক্ত বলে তার মনে হচ্ছে। “হামলার ধরন, টার্গেট করার ধরন, ছবি আমরা দেখেছি এবং আমাদের কাছে কিছু তথ্যও ছিল। শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধ চলায় এই ধরনের হামলা চালানোর উপাদান সেখানে থাকলেও বাইরের শক্তির ইন্ধন থাকার কথা মনে করেন বাংলাদেশ পুলিশের এই কর্মকর্তা। “আমরা মনে করি টেরোরিস্টদের ভেতরে তো একটা যোগাযোগ থাকে, সেক্ষেত্রে যোগাযোগটা হয়তবা হয়েছে।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে জঙ্গী হামলার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে ‘শ্রীলঙ্কায় ধর্মীয় উপাসনালয়ে আত্মঘাতী হামলার ঘটনা বাংলাদেশের উগ্রবাদী সংগঠনগুলোকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। তবে সাংগঠনিকভাবে সংগঠনগুলো দুর্বল থাকায় নিকট ভবিষ্যতে তাদের বড় ধরনের কোনো হামলার সক্ষমতা নেই। যদিও অনেক সংগঠন নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে সেটা এই মুহূর্তে আশঙ্কার কারণ নয়।’
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) চলতি বছরের শুরুতে একটি সাময়িকীতে বাংলাদেশে তাদের খলিফা নিয়োগের দাবি করেছিল। এ প্রসঙ্গে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে আইএসের কোনো খলিফা নেই। এমন হতে পারে, প্রবাসী বাংলাদেশি কেউ আইএসে যোগ দিলে তাকে হয়তো খলিফা বানানো হয়েছে। তবে পুলিশের কাছে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।’
মনিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে সারা বিশ্বে ধর্মীয় উগ্র মতবাদের পাশাপাশি বর্ণবাদের কারণেও জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটছে। তাই কেউ যাতে বিকৃত মতবাদে প্রভাবিত না হয়, সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে দেরি হলে তারা সামাজিক নানা অপরাধসহ উগ্রবাদে জড়াতে পারে বলে মনে করেন সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম। তবে, রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা ঠেকাতে গোয়েন্দা সদস্যরা কড়া নজরদারি করছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থেকে গেলে ভবিষ্যতে তারা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে গেলে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কি হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, তারা দীর্ঘদিন এ দেশে থাকলে সোশ্যাল ডিজঅর্ডার সহ নানা কর্মকান্ডে জড়িয়ে যেতে পারে। এজন্য তাদেরকে নিজ দেশে পাঠাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এবিষয়ে দুএকদিনের মধ্যে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসছে। সব হারানোর কারনে তারা ভবিষ্যতে উগ্রবাদের জড়িয়ে পড়তে পারে। তবে আমাদের দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থা তাদের তীক্ষè নজরদারিতে রেখেছে।
কারাগারে জঙ্গীবাদ ছড়ানোর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, এটি একটি গ্লোবাল সমস্যা। যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশে কারাগারে জঙ্গীরা রেডিক্যালাইজড হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারনে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকা। তবে, এই দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে ২টি সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে। তাদের মামলাগুলো নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়াও, কারাগারগুলোতে সব ধরনের সন্ত্রাস বিরোধী আসামিদের মেলামেশার সম্ভাবনা খুব কম।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ক্র্যাবের সভাপতি আবুল খায়ের, সাধারণ সম্পাদক দীপু সারওয়ার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া ও পাবলিক রিলেসন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমানসহ ক্র্যাব নেতৃবৃন্দ ও সিটিটিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।