বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

প্রবাসী আয়ের সুফল মিলছে না

* রেমিটেন্সের দুই তৃতীয়াংশ চলে যাচ্ছে ভারতে
* চাকরির উচ্চপদগুলোও ভারতীয়দের দখলে
মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : প্রবাসী আয়ের সুফল মিলছে না। প্রবাসীরা যে পরিমাণ অর্থ পাঠাচ্ছেন ভারতের অল্পসংখ্যক শ্রমিক তার অধিকাংশই নিয়ে চলে যাচ্ছেন। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের দুই তৃতীয়াংশই চলে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ভারতের বেড়াজালে আটকা পড়েছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ অর্থ এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রায় এক কোটি বিশ লাখ শ্রমিকের কাছ থেকে। প্রবাসীদের পাঠানো এ বিপুল পরিমান অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে অবদান রাখার কথা ছিল বাস্তবে তা রাখতে পারছে না। এ অর্থ দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে ব্যবহার করতে পারছে না সরকার। কেননা প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্সের সিংহভাগই নিয়ে যাচ্ছে ভারত। গত অর্থবছরে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় শ্রমিকরা বাংলাদেশ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার তাদের দেশে পাঠিয়েছে। আর ভারত এ বিপুল অর্থ নিয়ে গেছে বাংলাদেশে কর্মরত মাত্র ১০ লাখ শ্রমিকের মাধ্যমে। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো এ অর্থের পরিমান প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো ৮০ লাখ শ্রমিকের সমান। বৈধ পথে যে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ পথেও প্রায় সমপরিমাণ টাকা ভারতে চলে যাচ্ছে। অবৈধ পথে যে টাকা যায় তা বিবেচনায় নিলে মোট পরিমাণ দ্বিগুণ হবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রাবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতিতে যে অবদান রাখার কথা প্রকৃতপক্ষে তা রাখতে পারছেনা। কেননা প্রবাসী বাংলাদেশীরা যে পরিমান রেমিটেন্স দেশে পাঠাচ্ছেন তার বেশিরভাগ অর্থই খরচ করতে হচ্ছে অল্প কিছু বিদেশীদের পিছনে। দেশে টেকনিক্যাল পারসন না থাকায় এ লোকসান গুনতে হচ্ছে। সরকারের উচিত হবে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে দেশের টাকা দেশেই রাখা। তাহলে প্রবাসীদের অর্থে দেশের কাঙ্খিত উন্নতি করা সম্ভব হবে। শোনা যাচ্ছে এবার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমান বাড়বে। কিন্তু তাতে কি লাভ। যদি সে অর্থ দেশের উন্নতিতে কাজে না লাগে। যে পরিমান অর্থ পাঠাবে তার অধিকাংশ নিয়ে যাবে অল্প কিছু বিদেশীরা। ফলে হতাশ হওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই। 
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনশক্তি উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন (এক হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। এরপর থেকেই মূলত বাংলাদেশে রেমিটেন্স আসার পরিমান কমতে শুরু করে। সে ধারা এখনো অব্যহত রয়েছে। রেকর্ড পরিমান জনশক্তি রফতানি হলেও আয় বাড়েনি। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের জিডিপিতে ১২ শতাংশ অবদান রাখে প্রবাসীদের পাঠানো এই বিদেশি মুদ্রা। এতো বিপুল পরিমান রেমিটেন্স দিয়ে দেশের কোনো কল্যাণ করতে পারছে না সরকার। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এ অর্থের অধিকাংশই চলে যাচ্ছে ভারতে। ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ভারতের বেড়াজালে আটকা পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ রেমিটেন্সের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রায় এক কোটি ২০ লাখ প্রবাসী এক হাজার ৪৯৮ কোটি (১৪.৯৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এর আগরে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক হাজার ২৭৭ কোটি (১২.৭৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রেকর্ড গড়ার পর তিন বছর ধারাবাহিকভাবে রেমিটেন্স কমছিল। দেশের রেমিটেন্সের অর্ধেকের বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, কুয়েত ও বাহরাইন থেকে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারত রেমিটেন্স নিয়ে যায় ৩.৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৭ সালে ঠেকেছে ১০ বিলিয়ন ডলারে যা গত ৫ বছরে বেড়েছে ২.৭ গুন বেশি। বাংলাদেশের যে ভারত তোষণ নীতি তাতে এই পরিসংখ্যান কোথায় গিয়ে ঠেকবে তাসহজে অনুমেয়। দুর্নীতির এই দেশ থেকে অবৈধ পথে যে কত টাকা পাচার হচ্ছে তা আমাদের ধারণারও বাইরে। সেই হিসেবে ভারতের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আয়ের উৎস এখন বাংলাদেশ। তারা বলেন, অন্যদেশ থেকে বাংলাদেশে আসা রেমিটেন্সের পরিমান কমলেও বাংলাদেশ থেকে ভারতে টাকা যাওয়ার পরিমান হু হু করে বাড়ছে। ভারত বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ এ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বর্তমানে ৬০ লক্ষাধিক শিক্ষিত বেকার। অথচ চাকরির উচ্চপদগুলোও ভারতীয়দের দখলে। যেখানেই (তথাকথিত দক্ষ) ভারতীয় এডমিনিস্ট্রেশন সেখানেই অযোগ্য ভারতীয়দের উচ্চ বেতনে নিয়োগ আর বাংলাদেশীদের অবমূল্যায়ন। এ বিষয়টি হয়তো সরকারের জানা থাকার কথা। কেননা বাংলাদেশে বিদেশীদের ওয়ার্ক পারমিট বিদেশী কোন এ্যাম্বাসি দেয় না। দেয় বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট। এর কিছু প্রসেস আছে। খাতা কলমে যার মধ্যে একটা হচ্ছে, সেই বিদেশী টেকনিশিয়ান বা অফিসার তার বিকল্প লোকবল তৈরি করে দিবে। এর জন্য নির্দিষ্ট সময় ধরে দেয়া আছে। কিন্তু এই কাজটা কেউ করে না এবং কোন এক অদৃশ্য ইশারায় নিয়োগ দেয়া কোম্পানি নিজেও এটা চায় না। যে কারণে নিয়োগ দাতা কোম্পানি বছরের পর বছর ভারতীয়দের স্ব-ইচ্ছায় নিয়োগ দিয়ে রাখতে নিজ উদ্যোগে ওয়ার্ক পারমিট এবং ভিসা রিনিউ করে বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টকে ম্যানেজ করে। এমনকি নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মচারীর আয়কর অনেক কোম্পানি নিজে বহন করে এবং যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, বেতনটা কোম্পানি নিজ উদ্যোগে ভারতে পাঠিয়ে দেয় বা ভারত থেকে যাতে সে টাকাটা হাতে পায় তার ব্যাবস্থা করে দেয়। এমন অভিজ্ঞতার কথাও জানান এই বিষয় নিয়ে কিছুদিন কাজ করা একজন গবেষক।
সম্প্রতি ভারত তাদের প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে। তারা অফিসিয়ালী জানিয়েছে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত তাদের শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমান ১০ বিলিয়ন ডলার। আর এটা তারা আয় করেছে খুব কম সংখ্যক শ্রমিকের মাধ্যমে। যা অন্য কোনো দেশ থেকে সম্ভব হয়নি। তাদের হিসাবে দেখা যায়, সদ্য বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছর ভারত বাংলাদেশে বসবাসরত দেশটির নাগরিকদের মাধ্যমে ১০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। তবে অফিসিয়াল এ হিসেবের বাইরেও অবৈধভাবে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকরা আরো অনেক বেশি অর্থ তাদের দেশে পাঠিয়েছেন। তাদের অধিকাংশই টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং থেকে যান। অন্তত ১০ লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে অবৈধ্যভাবে কাজ করছেন। এর আগের বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় নাগরিকরা তাদের আয়ের ৮.৩২০ বিলিয়ন ডলার ভারতে পাঠায়। ২০১৪ সালে এর পরিমাণ ছিল সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার। তাদের সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স পাঠানো দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। এই ছোট্ট বাংলাদেশ শত কোটি জনসংখ্যার ভারতকে ১০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স দিচ্ছে যা ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ। এক, দুই, তিন এ থাকা আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্যও খুব সামান্য। এই তিনটি দেশ থেকে তাদের রেমিটেন্স এসেছে যথাক্রমে ১২.৫৭, ১০.৬৫ ও ১০.২২ বিলিয়ন ডলার।
এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশ থেকে হুন্ডি বা অবৈধ চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে পাঠালেও দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক বিষয়টি রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছে। বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়া বা অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশ থেকে এধরনের অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ থাকলেও হরহামেশা ভারতীয় নাগরিকরা তা করে থাকেন। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন।
বাংলাদেশে লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক অবৈধভাবে বসবাস করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে ২০০৯ সালে অন্তত ৫ লাখ ভারতীয় নাগরিক বিনা কাগজপত্র বা অবৈধভাবে বাংলাদেশে বাস করছিলেন। এনজিও, গার্মেন্টস, বস্ত্র, তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে ভারতীয় নাগরিকদের সংখ্যা এখন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা হুন্ডির মাধ্যমে তাদের আয়ের এক বিরাট অংশ ভারতে পাঠাচ্ছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশে অবৈধভাবে ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন অর্গানাইজেশন সূত্রে এমন আভাস পাওয়া গেছে। বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি’র সাম্প্রতিক এক সাংবাদিক সম্মেলনেও এধরনের তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। ভারতের পশ্চিম বাংলা, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও মিজোরাম থেকেই সবচেয়ে বেশি ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে আসেন। শুধু ২০১৬ সালের জুলাই মাসে বন্যায় ৪ হাজার ভারতীয় নাগরিক পশ্চিম বাংলা থেকে লালমনিরহাটে এসে আশ্রয় নেন।
২০১২ সালে ভারত যে সব দেশ থেকে বেশি রেমিটেন্স পেয়ে থাকে তার মধ্যে বাংলাদেশ ছিল পঞ্চম অবস্থানে। ওই বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় নাগরিকরা ৩.৭ বিলিয়ন ডলার তাদের দেশে পাঠায়। বর্তমানে তা বাড়িয়ে চতুর্থ স্থানে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ এখন তাদের চতুর্থতম আয়ের দেশ। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এভাবে চলে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে স্থবিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। ২০১৬ সালে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩৩ বিলিয়ন ডলার হলেও পরের তিন বছর তা বৃদ্ধি পায়নি। রফতানি আয় ৭ ভাগ বৃদ্ধি পেলেও একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমেছে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ভারতীয়দের বিষয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত ও দক্ষ বাংলাদেশীদের চাকুরীর অধিকার ও যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যকীয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান জানান, বাংলাদেশে কাজ করা ভারতীয় নাগরিকেরা বছরে প্রতিবছর বৈধ পথে যে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ পথেও প্রায় সমপরিমাণ টাকা ভারতে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ অবৈধ পথে যে টাকা যায় তা বিবেচনায় নিলে মোট পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। সে হিসাবে প্রতিবছর ব্যাপক অর্থ নিয়ে যাচ্ছে ভারতের কর্মীরা। তিনি বলেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কর্মবাজারের কোনো সংযোগ নেই। এ কারণে দেশে শিক্ষিত তরুণেরা বেকার থাকে। আবার বিদেশ থেকে কর্মী এনে কাজ করাতে হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে দক্ষতার উন্নয়নের ব্যবস্থা নিতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ