শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ধুলায় আচ্ছন্ন রাজধানী ঢাকা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : কামরুজ্জমান হিরু। পেশায় একজন সংবাদকর্মী। রাজধানীর ফকিরাপুলেই স্থায়ীভাবে পরিবারের সাথে বসবাস তার। পেশার প্রয়োজনে নানা জায়গায় যেতে হয়। তীব্র যানজটের কারণে অনেক সময় বাধ্য হয়েই হাঁটতে হয় তাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অবস্থা এমন যে, হাঁটাও যেন মারাত্বক ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। যে বিষয়টি তাকে মারাত্বকভাবে নাড়া দিয়েছে সেটি হচ্ছে রাজধানীতে অত্যধিক মাত্রায় ধুলার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। ধুলার পরিমাণ এতটাই বেশি যে, মনে হয় শীতের সকালে ঘন কুয়াশায় হাঁটছি। গতকাল এ প্রতিবেদকের সাথে এভাবেই ধুলার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর অধিকাংশ এলাকাই ধুলায় আচ্ছন্ন। ধুলায় দূষণের জন্য সিটি কর্পোরশেনের পক্ষ থেকে পানি ছিটানোর কথা থাকলেও সেটিও কার্যত অচল। যে সব এলাকায় ঢাকা ওয়াসা, মেট্টো রেলসহ বিভিন্ন কাজে খোড়া খুড়ি চলছে সে সব রাস্তায় ধুলার পরিমাণ খুবই বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরিক্ত বায়ু দূষণের কারণে যক্ষাসহ নানা রোগ হচ্ছে। এছাড়া দূষণজনিত রোগে প্রতিবছর খোদ রাজধানীতেই ৮০ হাজা মানুষের মৃত্যু ঘটছে।
রাজধানীর ধুলা দূষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সামনে আয়োজিত এক মানববন্ধন করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরামসহ (নাসফ) সমমনা বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, শুষ্ক মওসুমে ঢাকা মহানগরীতে ধুলা দূষণের প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। এ মওসুমেই হাজার হাজার ইটভাটায় ইট প্রস্তুত ও পোড়ানোর পাশাপাশি মহানগরীতে অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ড্রেনেজ এবং রাস্তাঘাট উন্নয়ন, মেরামত ও সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় রাস্তা-ঘাট খোঁড়াখুঁড়ি বেড়ে যায়। মেট্রোরেলসহ অন্যান্য মেগাপ্রকল্পের জন্য রাস্তা ও আশপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি, গ্যাস-পানি, বিদ্যুতের লাইন স্থাপনের সময় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, মাটি, বালি, ইটসহ নির্মাণসামগ্রী ট্রাকে করে শহরে পরিবহন করা, ড্রেন পরিষ্কার করে রাস্তার পাশে স্তূপ করে রাখা, দোকানপাট ও গৃহস্থালীর আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে রাখা, মেরামতহীন ভাঙাচোরা রাস্তায় যানবাহন চলাচল, পাকা ভবন নির্মাণের সময় মাটি, বালু, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী রাস্তা-ফুটপাতে ফেলে রাখা, পুরাতন ভবন ভাঙা, মেশিনে ইট ভাঙা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ধোঁয়া ইত্যাদি ধুলা দূষণের অন্যতম উৎস।
এসব উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ধুলা বাতাসে মিশে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, খোঁড়াখুঁড়ির মাটি ও অন্যান্য আবর্জনা দ্রুত অপসারণের জন্য পৃথক খাতে খরচ হয়। কিন্তু বিধি মোতাবেক কাজটি হয় না। এ ছাড়াও ড্রেনের ময়লা আবর্জনা রাস্তার দু’পাশে দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয়। ফলে যানবাহন চলাচলের সময় ধুলাবালি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় শীতকালে ধুলা দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ধুলা দূষণে যক্ষা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানী, এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধুলা দূষণে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে তেমনি আর্থিক ও পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে ধুলা দূষণ বন্ধে চাই জরুরি কার্যকর পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ধুলা দুষণের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুন্দর ঢাকা দেখতে চান। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আমি সুন্দর, সুস্থ, পরিচ্ছন্ন, সচল এবং গতিময় ঢাকা গড়ে তুলতে চাই। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে আমাকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তার সেই দিকনির্দেশনা মোতাবেক আমি কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, নানা কারণে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ধুলার পরিমাণটা খুবই বেশি। এটি সাময়িক। আমরা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে পানি ছিটানোর যে ব্যবস্থা রয়েছে সেটি করে যাচ্ছি।
নগর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকাকে একটি বসবাসযোগ্য শহরে পরিণত করতে চাইলে সবার আগে প্রয়োজন পরিবেশ। সেই পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে সবার আগে। যানজট, পানিবদ্ধতা এসব মানুষের সয়ে গেছে। তবে এখন যেটি মারাত্বক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি হচ্ছে ঢাকার বায়ু দূষণ। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছে যে, ঢাকায় বায়ু দূষণমাত্রা কত তা নির্ণয় এবং বায়ু দূষণমাত্রা কমানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে অগ্রগতি জানাতে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালককে তলব করেছেন হাইকোর্ট। তাকে আগামী ১০ এপ্রিল আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখা জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত এক রিটের ওপর দেয়া আদেশের অগ্রগতি প্রতিবেদনের শুনানিতে হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল হাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন।
আদালতে রিট আবেদনকারী এডভোকেট মনজিল মোরসেদ জানান, বায়ুদূষণের দিক থেকে রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় শহর। আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদি সংগঠন ‘গ্রিনপিস’ ও বৈষিক বায়ুর মান নির্ধারণকারী সংস্থা ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’র এই প্রতিবেদনে সন্দেহপোষণকারী পরিবেশ অধিদফতরের ‘বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগ’র পরিচালক জিয়াউল হককে তলব করেছেন হাইকোর্ট। কেন তিনি এ দুটি সংস্থার প্রতিবেদন নিয়ে সন্দেহ করছেন, এ বিষয়ে ব্যাখা দেয়ার জন্য আগামী ১০ এপ্রিল তাকে আদালতে হাজির হতে হবে। এ ছাড়া ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতর কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তার একটি প্রতিবেদনও সেদিন আদালতে দিতে হবে এই পরিচালককে। এর আগে গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকা শহরে বায়ুদূষণকারীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতর ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে কয়েক দফা নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে প্রকাশিত খবর ও প্রতিবেদন যুক্ত করে গত ২৭ জানুয়ারি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইইচআরপিবি) পক্ষে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি করা হয়।
‘বাংলাদেশে পরিবেশগত বিশ্লেষণ ২০১৮’ শিরোনামের বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশে পরিবেশ দূষণজনিত রোগে প্রতিবছর ৮০ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এক বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন রোগে বা চিহ্নিত কারণে যত মৃত্যু হয়, তার ২৮ শতাংশই হয় পরিবেশ দূষণজনিত রোগে, যা প্রতিবছর বৈশ্বিক দূষণজনিত মৃত্যুহারের (১৬) চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভল্যুশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের ওই প্রতিবেদনে প্রায় কাছাকাছি সময়ের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হলেও মৃতের সংখ্যার ব্যবধান ৪২ হাজারের বেশি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটির তথ্য ২০১৫ সালের আর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা দুটির তথ্যও  ২০১৫-১৬ সালের। তবে পরিসংখ্যানগত ব্যবধান থাকলেও উভয় প্রতিবেদনেই দেশে পরিবেশ বা বায়ুদূষণজনিত রোগের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে বাংলাদেশে পরিবেশদূষণের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে বায়ুদূষণ। আবার বায়ুদূষণের বড় অংশ হচ্ছে ধুলা।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. শাহেদুর রহমান খান বলেন, ঢাকায় জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে বায়ুদূষণ। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের প্রকোপ দ্রুত বেড়ে যাওয়ার জন্য বায়ুর সঙ্গে মিশে থাকা নানা রাসায়নিক দূষণকেই দায়ী করা হয়। এ ক্ষেত্রে সড়কগুলোতে যানজটের সময় দূষণের মাত্রা থাকে সবচেয়ে ক্ষতিকর পর্যায়ে। এ ছাড়া রয়েছে আশপাশে ইটের ভাটা, কলকারখানার মাধ্যমে পরিবেশ বা বায়ুদূষণ। তিনি বলেন, বায়ুর সঙ্গে থাকা ক্ষতিকর উপাদানগুলো চোখে দেখা না গেলেও মানুষের শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, চোখের সমস্যা, সর্দি, কাশি, যক্ষ্মা, হৃদরোগ, জন্ডিস, অ্যাজমা, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া পরিবেশ থেকে বিভিন্ন দূষিত বা বিষাক্ত উপাদান খাদ্যচক্রে মিশে তাও মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশদূষণজনিত রোগে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতি বছর যত সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে, তার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের পরে আছে ভারত ২৬.৫, পাকিস্তান ২৫.৮ এবং নেপালে ২৫.৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন রোগ ও কারণ চিহ্নিত করা মৃত্যু হয়েছে আট লাখ ৪৩ হাজার মানুষের। যার মধ্যে দুই লাখ ৩৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে পরিবেশদূষণজনিত রোগে, যা ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের চেয়ে দশ গুণ। ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২১ হাজার ২৮৬ জন।
অন্যদিকে হেলথ ইফেক্টস ও হেলথ মেট্রিকসের যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আগে বায়ুদূষণে সবার ওপরে ছিল চীন। গত দুই বছরে (২০১৫ ও ২০১৬ সালে) চীনকে টপকে স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। চীন ও ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। অবশ্য গত বছর ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর তা মানতে চায়নি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষণ ও পরিবেশ ক্ষয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে নারী, শিশু ও দরিদ্র শ্রেণি। মনুষ্য সৃষ্ট বর্জ্য ও ইলেকট্রনিক বর্জ্য নারী, শিশু ও দরিদ্র শ্রেণিকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। শহরের দশ লাখ দরিদ্র শ্রেণির মানুষ সিসাদূষণের কারণে এখন মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। এসব কারণে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে (আইকিউ) ও স্নায়বিক ক্ষতি হতে পারে এবং গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বাড়তে পারে। ঢাকায় ভারী ধাতবদূষিত স্থানগুলোতে অধিকাংশই দরিদ্র মানুষের বসবাস।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, পরিবেশদূষণের মধ্যে মূলত বায়ু, ধোঁয়া ও ধুলাজনিত দূষণের ফলেই এ দেশে মানুষের সবচেয়ে বেশি বিপদ বয়ে আনে। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, যক্ষ্মা, হাঁপানি, চক্ষুরোগ, ব্রংকাইটিস রোগের জীবাণু ছড়ায়। এ ছাড়া দূষণজনিত কারণে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ দেখা দিতে পারে। এমনকি ডায়রিয়ার পেছনেও পরিবেশদূষণজনিত কারণ রয়েছে। পরিবেশদূষণ থেকে পানিও দূষিত হয়। রাস্তার পাশের বা ফুটপাতের দোকানে রাখা খাবারও ধোঁয়া-ধুলায় দূষিত বা বিষাক্ত হয়ে পড়ে। এসব খেয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে অন্য সময়ের (এপ্রিল-অক্টোবর) চেয়ে শীতের সময় (নভেম্বর-মার্চ) বায়ুদূষণের মাত্রা (পার্টিকেল ম্যাটার বা পিএম ২.৫-এর নিরিখে) বাড়ে প্রায় পাঁচ গুণ। এ সময় বাতাসে সবচেয়ে ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকতা অস্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। অপেক্ষাকৃত স্থূল বস্তুকতা পিএম-১০-এর মাত্রাও অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের সময়েই ‘নির্মল বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ’ প্রকল্পের আওতায় ৪৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরে বায়ুদূষণ পরিবীক্ষণের জন্য ১১টি সার্বক্ষণিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
দ্রুত এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে রাজধানীসহ দেশের শহরগুলোতে বায়ু এবং পানি দূষণ বাড়ছে। শুধু বায়ু দূষণের ফলে বছরে যে ক্ষতি হচ্ছে তার আর্থিক পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) এক শতাংশের সমান। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শহরের দূষণ বৃদ্ধির ফলে শিশুদের আইকিউ বা মেধার বিকাশ কমে যাচ্ছে, স্নায়বিক অসুখের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশের অবস্থা মূল্যায়ন করে এক খসড়া প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে শহরের বায়ু এবং পানি দূষিত হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, মাত্র এক টন কাপড়ের রং এবং ফিনিশিং এর জন্য কারখানাগুলো প্রায় ২০০ মেট্রিক টন তরল বর্জ্য নদীতে ফেলছে। এর ফলে দরিদ্র্র এবং নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ছোট-বড় সব ধরনের শহরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, পাবনা শহরে জলাভূমি ১৯৯০ সালের পর অর্ধেক হারিয়ে গেছে। শুধু রাজধানী ঢাকা শহরে দূষণের ফলে প্রায় ৬ লাখ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সাবেক পরিবেশ ও বন মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের জিডিপির ৪ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্নীতির কারণেও ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির ৩ শতাংশ। এটা অবশ্যই উদ্বেগের। তিনি বলেন, পরিবেশে নিয়ে আমাদের একটি জাতীয় কমিটি রয়েছে। যে কমিটির প্রধান হলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এর সমন্বয় করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
পরিবেশবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পরিবেশ সুরক্ষা ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না। শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশকে পরিকল্পিতভাবে পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করতে হবে। বর্তমানে ৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষ শহরে বাস করছে। ২০১৫ সালের হিসাবে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূলের ৫৩ লাখ মানুষ।
ধুলা দূষণ রোধে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ‘ওয়াটার থেরাপি’র ব্যবস্থা করা হয়। তবে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন বলেন, ধুলা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না করে শুধু পানি ছিটিয়ে লাভ হবে না। এতে কিছু সময়ের জন্য ধুলা দূর হতে পারে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান হবে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ