বর্ষায় এবারো ডুববে রাজধানী ঢাকা
মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: সারা বছর খবর না থাকলেও বর্ষা মওসুম শুরুর আগে এবারো সরব হয়ে উঠেছে ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি কর্পোরেশন। ঢাকা উত্তরের নব নির্বাচিত মেয়র শপথ নেয়ার দুইদিন পরই বললেন, এবার রাজধানীতে পানিবদ্ধতা থাকবেনা। একই বক্তব্য দিচ্ছেন দক্ষিণের মেয়রও। বসে নেই ঢাকা ওয়াসাও। তারাও পানিবদ্ধতা দূরীকরণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বৃষ্টিতে পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধারসহ যেসব কাজ আগে করা উচিৎ সেগুলো না করে শুধু বক্তৃতা বিবৃতি দিলে কোনো কাজ হবেনা। চলতি বর্ষায়ও যে রাজধানীবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হবে তার প্রমাণ এরই মধ্যে দেখা গেছে।
সূত্র মতে, সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে এবার বসন্তের শুরুতে রাজধানীসহ সারাদেশেই হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হয়েছে। বজ্রসহ বৃষ্টিও কম হয়নি। এর শুরু হয়েছিল গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে। থেমে থেমে চলেছে ২৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর ও বিকেল পর্যন্ত। সামাণ্য এ বৃষ্টিতেই রাজধানী মহানগরীর অবস্থা কিন্তু শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। মাত্র তিন-চারদিনের হাল্কা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিতেই রাজধানীর বিভিন্নস্থানে বিরাট এলাকাজুড়ে রাজপথে পানি জমেছিল। রামপুরা, বাসাবো, ধানমন্ডি, গুলিস্তান, মিরপুর, সদরঘাট এবং বংশালসহ কোনো কোনো এলাকার প্রধান সড়কগুলোতে এমনকি হাঁটু পর্যন্ত পানি জমেছিল। অনেক এলাকায় সৃষ্টি হয়েছিল পানি আবদ্ধতার। ফলে অফিসগামী চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাও বিপদে পড়েছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের এই সাময়িক বিপদের জন্য শুধু নয়, ভীতি ও আশংকার সৃষ্টি হয়েছে আসন্ন বর্ষাকালের পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, মাস দু-তিনেকের মধ্যেই দেশে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবে। চলবেও কয়েক মাস ধরে। মাত্র তিন-চারদিনের বৃষ্টিতেই রাজধানীতে যেখানে পানি আবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে সেখানে বর্ষাকালে যখন দিনের পর দিন ধরে মূষলধারে বৃষ্টি শুরু হবে তখন প্রচন্ড পানি আবদ্ধতার সৃষ্টি তো হবেই, অনেক এলাকার সড়কে এমনকি চলাচলও অসম্ভব হয়ে পড়বে। নগরবিদরা বলছেন, এভাবেই চলে আসছে বিগত কয়েক বছর ধরে। দুই সিটি কের্পারেশন ও ঢাকা ওয়াসা শুধু উদ্যোগ নিয়েই বসে থাকে। তাদের মধ্যকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক কাজই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনা। এছাড়া এবার মেট্রোরেল নির্মাণের কাজের জন্য বহু এলাকায় অনেকদিন ধরেই রাজপথ সরু ও সংকীর্ণ অবস্থায় আছে। তার ওপর আবার অনেক গভীর পর্যন্ত মাটি খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সৃষ্টি হয়েছে বিপদজনক অসংখ্য গর্তেরও। এজন্যই সামান্য বৃষ্টিতেই সবস্থানে পানি আবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছেÑ বর্ষাকালে যা মানুষের জন্য মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠবে।
নগরবিদরা বলছেন, দায় নিয়ে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের টানাপড়েন, একক ও সমন্বিত কর্তৃপক্ষ না থাকায় রাজধানীবাসী পানিবদ্ধতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পানি নিষ্কাশনের জন্য অধিকাংশ খালই দখল ও ভরাট হয়ে আছে। ৯টি বড় বক্স কালভার্ট খুলে আগের অবস্থায় খালগুলো নেওয়াও সম্ভব হয়নি। ড্রেন ও নর্দমা নির্মাণ ও পুরনো নর্দমা পরিষ্কারের কার্যকর কর্মসূচিও তেমনভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না।
গত বছর জুলাই মাসের মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর পানিবদ্ধতা দূর করতে বক্স কালভার্টগুলো খুলে দিয়ে এগুলোর ওপর দিয়ে উড়াল সেতু করা যায় কি না তা ভেবে দেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধারের নির্দেশও দিয়েছিলেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও এসব কাজে সমন্বয় ও অগ্রগতি চোখে পড়ে না। এমনকি তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরপরই প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর খালগুলো উদ্ধার করার নির্দেশ দেন। এমনকি সর্ব্বোচ্চ আদালতও খাল উদ্ধারের নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু এসব কোন কিছুই কাজ দিচ্ছেনা।
জানা গেছে, আড়াই বছরে দুই সিটি কর্পোরেশনে পানিবদ্ধতা নিরসনে সহায়ক ও সড়ক উন্নয়নে দুই হাজার ৬১২ কোটি টাকার সাতটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তবে এসব উন্নয়ন ও সংস্কারকাজের সুফল দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বৃষ্টি হলেই মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও অলিগলিতে উপচে পড়ে পানি। দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার সড়ক দফায় দফায় ভেঙে পড়ছে। পিচের সড়কে তিন দিন পানি জমে থাকলেই তা ভেসে যায়। গত প্রায় এক যুগ ধরেই রাজধানীতে দফায় দফায় পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। আগে যেসব স্থানে হাঁটু পানি দেখা যেত গত কয়েকবছর সেখানে কোমর পানি দেখা গেছে। অনেক স্থানে চলেছে নৌকা ও ভেলা।
জানা গেছে, খাল রক্ষণাবক্ষণের দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশন হাত গুটিয়ে বসে আছে কয়েক বছর ধরে। এ অবস্থায় যতবার পানিবদ্ধতার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, ততবারই শুধু আশ্বাস বাণী শুনতে হয়েছে রাজধানীবাসীর।
বিশিষ্ট নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকার সার্বিক সমস্যা সমাধানে একটা সুপার অথরিটি থাকা দরকার। সুশাসন, পরিচালন ও সমন্বয়ের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষমতার কর্তৃপক্ষ হবে এটি। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে একজন উপপ্রধানমন্ত্রীকে এ ধরনের কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের এখানে এটা করা যাবে না আইনগত কারণে। তবে প্রবীণ কোনো মন্ত্রীকে প্রধান করে এ ধরনের কর্তৃপক্ষ করা যেতে পারে। অথবা দুই মেয়রকে দায়িত্ব ভাগ করে সমন্বয়ের কাজটা করানো যায়। পানিবদ্ধতা নিরসনে কী কী বিষয় প্রাধান্য পাবে তা এ কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে, সমন্বয় করবে।
ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, খাল উদ্ধার, পরিষ্কার ও ড্রেন পরিষ্কার করা পুরোপুরি ওয়াসার দায়িত্ব। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ওয়াসার নীতিনির্ধারিত মহলকে এ ধরনের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এখন তারা কতটুকু করছে, তা দেখবে সরকার। আমরা ডিএসসিসির পক্ষ থেকে ওয়াসা ও ঢাকা জেলা প্রশাসনকে পত্র দিয়ে খাল উদ্ধারের জন্য অবহিত করেছি।
ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে খাল আছে ৪৩টি। এসব খালের মালিকানা জেলা প্রশাসনের। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা রক্ষণাবেক্ষণ করছে ২৬টির। তার একটি কালশী খাল। মিরপুরের পল্লবীর পূরবী সিনেমা হলের কাছে এক হাজার ৩০০ মিটার দীর্ঘ কালশী নতুন সড়কটি নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অধীনে। সড়কটি নির্মাণের পর সংযোগ ঘটেছে জিল্লুর রহমান উড়াল সেতুর সঙ্গে। সেতুর ওপর দিয়ে রাজধানীর উত্তর অংশের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয়েছে পশ্চিম অংশের। এ সড়ক নির্মাণের আগে এটি সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধ হয়ে পড়ত। ছোট-বড় অসংখ্য গর্তে পানি জমে থাকত। ফেঁসে যেত গাড়ির চাকা। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে নতুন সড়ক নির্মাণের পর সড়কটি গর্তহীন হয়ে ওঠে। কিন্তু কালশী সড়কের দুটি বড় অংশই বৃষ্টির পানিতে ডুবে যান চলাচল বন্ধ থাকে। কারণ পাশের খাল উপচে পানি উঠে যায় সড়কে। বৃষ্টি হলেই হাঁটু বা কোমরপানির ওপর দিয়ে যেতে হবে বলে মিরপুর-১২ নম্বর সড়ক দিয়ে চালকরা গাড়ি চালায়। মিরপুরের পল্লবী থেকে কালশী হয়ে জিল্লুর রহমান উড়াল সেতু পার হয়ে বিমানবন্দর সড়ক ধরে উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গাড়ি চলাচল করে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সেখানে কোমরপানি জমে যায়, যা ১২ ঘণ্টায়ও নিষ্কাশন হয় না।
বৃষ্টি হলেই রাজধানীর শান্তিনগর ও আশপাশ পানিতে পুরোপুরি তলিয়ে যেত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন-ডিএসসিসি প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ড্রেন ও নর্দমা নির্মাণে প্রকল্প নেয়। কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সামাণ্য বর্ষণ শুরু হলে সেখানেও পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। ডিএসসিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ড্রেন দিয়ে পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, মতিঝিল, ফকিরাপুল, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, রাজারবাগের পানি নিষ্কাশন হয় বাসাবো খালের মাধ্যমে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, খিলগাঁ জোড়পুকুর মাঠের পাশ থেকে নন্দীপাড়া পর্যন্ত খালটি। খালের ওপরে উঠেছে ঘরবাড়ি, ভরে গেছে পলিথিনসহ ময়লা-আবর্জনায়। এ খাল উদ্ধারে ওয়াসা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অনুসন্ধানে সবচেয়ে বেশি দখলদার পাওয়া গেছে নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খালে। এটি ধলপুর খাল থেকে হয়ে মা-া, রাজারবাগ, নন্দীপাড়া মৌজার ভেতর দিয়ে নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী সড়কের পাশ দিয়ে উত্তরে প্রবাহিত হয়েছে। এটি নাসিরাবাদ-নন্দীপাড়া খালের সঙ্গে ত্রিমোহনীতে মিলেছে। খালের ওপর দখল নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন দোকান, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়। রামচন্দ্রপুর খাল রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুরে। খালের অংশে অবৈধভাবে দেখা গেছে বিভিন্ন হাউজিং প্রতিষ্ঠান। ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্রের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, খালের ৩.২৪ একর জায়গা দখল করে একটি কবরস্থান করা হয়েছে। কাঁটাসুর খালের বেশির ভাগও দখল হয়ে গেছে। কামরাঙ্গীরচর খালও টিনের ছাপরা তৈরি করে অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে বিভিন্নজন। মিরপুর-১৪ নম্বরে ইব্রাহীমপুর খালও দখলে-দূষণে মুমূর্ষু। দুই পারেই অবৈধ স্থাপনা আছে। ধোলাইখাল বর্তমানে ধোলাইখাল রাস্তা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বাসাবো খালে জলাশয় ভরাট করে প্রথমে টিঅ্যান্ডটির এক্সচেঞ্জ অফিস স্থাপন করে। পূর্ব দোলাইরপাড়ে কুতুবখালী খালের একাংশ ভরাট করে দনিয়া রোড চওড়া করছে ডিএসসিসি। কুতুবখালী খালে দোলাইরপাড়ের দনিয়া রোডে ওয়াসার পানির পাম্প পর্যন্ত কুতুবখালী খালের ১২ থেকে ১৫ ফুট বাঁশ ও টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও খাল ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এ ছাড়া আবাসিক এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া খালে প্লট আকারে বরাদ্দ দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিছু জায়গায় খাল ভরাট করে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। বাসাবো, নন্দীপাড়া, খিলগাঁও, রামচন্দ্রপুর, কাঁটাসুর, সেগুনবাগিচা, ধোলাইখাল, বেগুনবাড়ী, রূপনগর, বাউনিয়াসহ মোট ১০টি খাল সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে অস্তিত্ব হারাচ্ছে।
জানা গেছে, বৃষ্টির পানি সরাতে ‘পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন-১৯৯৬’ নামের নির্দিষ্ট আইন আছে। তাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, পানি নিষ্কাশনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে ড্রেনেজের দায়িত্ব পায় ঢাকা ওয়াসা। তাদের এ ক্ষেত্রে কাজ করার জনবলও তৈরি করা হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য ঢাকা ওয়াসার বেশ কিছু উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মেশিন ও সরঞ্জাম রয়েছে। কিন্তু বর্ষা মওসুমে তাদের কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক সৃষ্টি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় পানিবদ্ধতা এবং সেই সঙ্গে সড়ক সংস্কার-উন্নয়নের জন্য সাতটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৬১২ কোটি টাকা। আড়াই বছরের মধ্যে এসব প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে একনেক। ডিএনসিসিতে এক হাজার ৫০৬ কোটি টাকার তিনটি ও ডিএসসিসিতে এক হাজার ১০৬ কোটি টাকার চার প্রকল্প রয়েছে। ২০১৫ সালের ৫ মে গুলশান-বনানী ও বারিধারার অবকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এসব এলাকার জলাবদ্ধতা ও বনানী লেকের দূষণ কমানো এবং যানজট হ্রাস করা ছিল প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছিল ১৯৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নসহ নর্দমা ও ফুটপাত নির্মাণ প্রকল্পের নামে এক হাজার ২৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়। তবে পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি মেলেনি। এ ছাড়া ঢাকা শহরের খালগুলো পুনরুদ্ধার এবং রক্ষণাবেক্ষণ, পয়োনিষ্কাশন ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য এক হাজার ১০০ কোটি টাকার সমন্বিত প্রকল্প হাতে নিয়েছিল ওয়াসা। বিশ্বব্যাংকের এই টাকার বেশির ভাগই ব্যয় করা হয়েছে খালের পেছনে। এ বিপুল অর্থ ব্যয়ে খালের কী ধরনের কাজ হয়েছে তা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট সন্দেহ।
জানা গেছে, চলতি বর্ষা মওসুমে রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল পুনঃখনন ও পরিষ্কারে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধরেছে ঢাকা ওয়াসা। এ জন্য সরকারের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাত থেকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের (এলজিআরডি) কাছে অর্থ বরাদ্দ চেয়েছে ঢাকা ওয়াসা। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা ওয়াসা গতবছর ১৭টি খাল পুনঃখননে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় করে। এবারো খাল পুনঃখনন ও পরিষ্কারে ৬০ কোটি টাকার চাহিদা পাঠায় এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে। ওই চাহিদা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠালে তারা জানায়, ওয়াসার নিজস্ব অর্থায়নে যেন খাল উন্নয়নের কাজ করে। পরে ওয়াসা ফের চাহিদা পরিবর্তন করে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে চাহিদাপত্র এলজিআরডিতে পাঠালে তা অর্থ মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠানো হয়। জানা যায়, পানিবদ্ধতা দূর করতে মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় পেলেই খাল পুনঃখনন ও পরিষ্কারের কাজ শুরু করবে ওয়াসা।
ওয়াসার সংশ্লিষ্টরা জানান, খাল পুনঃখনন, খালের রেলিং, স্টর্ম ওয়াটার, পাম্পিং স্টেশন মেরামত ও কিছু যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এই অর্থ পেলে বর্ষা মওসুমে পানিবদ্ধতা দূর করা সম্ভব হবে। তবে ঢাকা ওয়াসা খাল পুনঃখনন ও পরিষ্কার করার কাজে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, সেই পরিমাণ সুফল মেলেনি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এ প্রতিবেদককে বলেন, গত বছর অল্প বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। যদি ভারী বৃষ্টি হয় পুরো ঢাকার রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ গত বছর বর্ষা মওসুমের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চলতি বছরে ওয়াসার কাজের গতি যেভাবে বাড়ানোর কথঅ ছিল সেটি ঞয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহ আলম খান বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, জলাশয় ভরাট ও অবৈধ দখলদারিত্বই পানিবদ্ধতার বড় কারণ। পানি নিষ্কাশনের জন্য রাজধানীতে দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এক. ভূ-গর্ভে পানি শোষণ করে নেয়া এবং দুই. খাল, বিল ও ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া। ঢাকায় এ দুটি পথের একটিও কার্যকর নেই। এ কারণে প্রতিবছর পানিবদ্ধতা বাড়ছে। এ থেকে উত্তরণে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
এদিকে পানিবদ্ধতা নিরসেন তৎপর হয়ে উঠেছে সিটি কর্পোরশেনও। গত ১২ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) নতুন মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম ডিএনসিসি এলাকায় পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এরকম ৪টি স্থান পরিদর্শন করেন। স্থানগুলো হচ্ছেঃ কসাই বাড়ি, শায়েস্তা খাঁ এভিনিউ, উত্তরা; আশকোনা; বনানী মাছরাঙা টিভি ভবনের সামনের সড়ক; এবং সুতিখাল, উত্তর বাড্ডা। পরিদর্শনে গিয়ে আতিকুল ইসলাম দেখতে পান যে, কসাই বাড়ি এলাকায় ড্রেনের উপর অবৈধভাবে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করায় পানিবদ্ধতা তৈরি হয়। তিনি এসকল স্থাপনা সরিয়ে ফেলার জন্য সময় দেন। আশকোনা এলাকায় মূল সড়কের পানিবদ্ধতা তিনি স্বচক্ষে দেখতে পান। পরিদর্শন শেষে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। এই শহরকে আমরা সবাই ভালোবাসি। ভালোবাসার শহরের উন্নতির লক্ষ্যে জনগণকে সাথে নিয়ে আমি সম্ভাব্য সব কিছু করবো। আগামী বর্ষায় জনগণের ভোগান্তি লাঘবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। জনগণকে সচেতন হতে হবে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, আমরা প্রতিবারের ন্যায় এবারো পানিবদ্ধতা নিরসনে সর্বাত্বক চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আবারো সেই পুরনো কথাই বলছি, অতিবৃষ্টি হলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না।