বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সিটি নির্বাচন ও ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ

ড. মো. নূরুল আমিন : গত ২৮ ফেব্রুয়ারী ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এবং উত্তর দক্ষিণ উভয় কর্পোরেশনের নবগঠিত ৩৬টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শাসক দলের নজিরবিহীন কারচুপি, ভোটারদের ভোট দানে বাধা প্রদান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভোটের আগের দিন ও ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দল ও জোটের প্রার্থীদের অনুকূলে ব্যালট পেপারে সীল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা, বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী ও পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া এবং নির্বাচনী ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করে তৃতীয় মাত্রায় ক্ষমতায় আরোহণের পথ সৃষ্টির পর নতুন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন ছিল জাতির সাথে আরেকটি তামাশা ও প্রহসন। ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারী এবং ২০১৮ এর ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধীদলগুলো এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিল বলে জানা গেছে।
নির্বাচনের দিন এবং তার পরের দিন সামাজিক মাধ্যম এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত ও প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এই নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। রিপোর্ট অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা নির্বাচন শুরু হবার দু’ঘণ্টা পরে রাজধানীর আই.ই.এস ভোট কেন্দ্রে নিজের ভোট দিয়েছেন। ঐ সময়ে ব্যালট বাক্সে কোনও ভোট ছিল না, তারটাই ছিল প্রথম ভোট। এই অবস্থা ছিল প্রায় সকল কেন্দ্রের। এর পাশাপাশি টেলিভিশন লাইভে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কয়েকটি কেন্দ্রে সাজানো ভোটারের দীর্ঘ লাইনও অবশ্য দেখা গেছে। মিরপুরের একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের ভাষ্য অনুযায়ী তার কেন্দ্রের ৪টি বুথের মধ্যে একটি বুথে ২টি, ১টিতে ১০টি ভোট পড়েছে এবং অন্য দু’টি বুথে কোন ভোটই পড়েনি। এই আক্ষেপ অধিকাংশ নির্বাচনী কর্মকর্তার। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে দু’জন ছিলেন প্রধান। একজন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম, অন্যজন জাতীয় পার্টির সাফিন আহমদ।
ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দু’টি কারণের কথা বলেছেন। তার দেয়া একটি কারণ হলো, এই নির্বাচনের মেয়াদ অল্প দিনের ছিল, ফলে ভোটারদের আগ্রহ কম ছিল। দ্বিতীয় কারীট হচ্ছে, এতে সব দল অংশ নেয়নি। ফলে উপস্থিতি কম হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনিও অনেকটা তার ভাষায় কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, মেয়রের মেয়াদ এক বছরের কম, এ জন্য ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। পক্ষান্তরে তার মতে, নারী কাউন্সিলর ও কাউন্সিলর নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি তার যুক্তিটি বুঝা মুস্কিল। মেয়রের উপনির্বাচন ও কাউন্সিলর নির্বাচনের ভোট কেন্দ্র একই ছিল। এর জন্য আলাদা কোন কেন্দ্র ছিল না। কাজেই মেয়র নির্বাচনে কম ভোটার আসা এবং কাউন্সিলর নির্বাচনে বেশি ভোটার আসার বিষয়টি পরিষ্কার নয়।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী সাফিন আহমদ জানিয়েছেন যে, তিনি ৪০টি ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন, কোন কেন্দ্রে ভোটার দেখেননি। বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটের প্রতি জনগণ অনাস্থা দিয়েছে। অর্থাৎ সরকারী দল, বিরোধী দল সকলেই স্বীকার করেছেন যে, ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি খুবই কম ছিল। তবে গণনার ফলাফল অন্য কথা বলে। বলাবাহুল্য, মেয়র নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থী জনাব আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন ৮,৩৯,৩১২ ভোট এবং জাপা প্রার্থী সাফিন আহমদ পেয়েছেন ৫২,৪২৯ ভোট। ভোট পড়ার হার ৩১.৫%। বিদ্যমান অবস্থায় বিশ্লেষকদের অনেকেই এই পরিসংখ্যানকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছেন না। ভোট কেন্দ্রের অবস্থা ও ভোটার উপস্থিতিতে এই তথ্যের সত্যতা মিলে না। তারা একে অতিরঞ্জিত ও কারচুপির অভিব্যক্তি বলে অভিহিত করেছেন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, এই নির্বাচনে যারা ভোট দিতে গেছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগ অথবা ঐ দলের সমর্থক। বোগাস ভোট প্রদর্শন না করলেও এতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতিক জয়ী হতেন। অসৎপন্থায় জালিয়াতির মাধ্যমে বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়ে সৎভাবে মেয়র সাহেব জনসেবা কি করতে পারবেন। দুঃখের বিষয়, বর্তমান শাসক দল এই দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে মানুষকে প্রচণ্ড আস্থা সংকটে নিক্ষেপ করেছেন। এই আস্থা পুণরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক সংকটের উত্তরণের সম্ভাবনা কম।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ প্রসঙ্গে : গত কয়েক দিন ধরে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের খবর গণমাধ্যমের উপভোগ্য বার্তাসমূহের অন্যতম বার্তায় পরিণত হয়েছে। দু’টি প্রতিবেশী দেশের কে কার উপর কত বোমা ফেললো কত হতাহত হলো এই নিয়েই তাদের ব্যস্ততা। কেউ ভারতের পক্ষে কেউ পাকিস্তানের পক্ষে মতামত প্রকাশ করছেন। মধ্যখানে যুদ্ধের কারণে নিষ্পেষিত হচ্ছে কাশ্মীর এবং দু’দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার নিরিহ জনগণ।
ভারতীয় কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামীদের হামলা ভারতীয় সৈন্য নিহত হবার পর সারা ভারতে যেখানে পাও ধরো এবং মারো এই নীতিতে কাশ্মীরিদের উপর মাসাধিকাল ধরে যে নির্যাতন চলেছে সারা বিশ্ববাসী তা দেখেছে। কাশ্মীরিরা মজলুম, গত ৭২ বছর দরে তারা নির্যাতিত হয়ে আসছে। ১৯৪৭-৪৮ সালে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর দেশ ভাগের নীতি লঙ্ঘন করে হিন্দু ভোগরা শাসক কর্তৃক কাশ্মীরকে ভারতের অংশ ঘোষণা করে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের আশা আকাক্সক্ষা নস্যাত করার পর থেকে কাশ্মীর বিভক্ত হয়ে যায়। দু’দেশের যুদ্ধ হয় একাংশ পাকিস্তান দখল করে অন্য অংশ ভারত। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং বিশ্ব সংস্থা সেখানে গণভোটের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান হবে বলে সিদ্ধান্ত দেয়। ভারত এই গণভোট অনুষ্ঠানে গড়িমসি করতে করতে ৭২ বছর পার হয়ে গেছে। আবারো যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। দু’টি দেশই পারমাণবিক শক্তি ধর। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের রিপোর্ট অনুযায়ী এই পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ভারতের তুলনায় পাকিস্তানের বেশি। শোনা যাচ্ছে ইসরাইল দু’দেশের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের উষ্কানী দিচ্ছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার নির্বাচনের খাতিরে জনপ্রিয়তার জন্য এই যুদ্ধের প্রতি সহানুভুতিশীল। বর্তমান যুগে যুদ্ধকে ছেলে খেলা বলা যায় না, একে খাটো করে দেখারও উপায় নাই। আগেই বলেছি দুই দেশের কাছেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে। তারা যদি তাদের অস্ত্রাগারে রক্ষিত অস্ত্র থেকে ৫০টি করে ১০০টি অস্ত্রও ব্যবহার করে তাহলে শুধু দুই দেশ নয় সারা দুনিয়ায় ধ্বংস যজ্ঞ নেমে আসতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিশ্ব বিদ্যালয়, রুজার্স, কলরেডো ও কালিফোর্নিয়া, একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছে যে এই যুদ্ধ মুরুহলে এক সপ্তাহের মধ্যে ২১ মিলিয়ন তথা ২ কোটি ১০ লাখ লোক তেজষ্ক্রিয়তার বিচ্ছুরণ, বোমার বিস্ফারণ ও আগুনের প্রভাব প্রবৃতি কারণে সরাসরি মারা যাবে। এর ফলে সারা বিশ্বের ও জোন স্তরের অর্ধেক ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার পরোক্ষভাবে সারা দুনিয়ার ২ বিলিয়ন তথা ২০০ কোটি লোক আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে (Climate Chanse) খাদ্যাভাবে মারা যাবে। এই অবস্থায় আমি মনে করি যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুধাবনের মতো বহু লোক ভারতও পাকিস্তানে আছেন। ভারত একটি বিশাল দেশ। কাশ্মীরের অংশ বিশেষ না হলেও তারা চলতে পারে। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কাশ্মীরীদের উপর ছেড়ে দিন। তারা স্বাধীনভাবে যে দেশের সাথে থাকতে চায় থাকতে দিন। অথবা তারা যদি আলাদা একটি রাষ্ট্র হিসাবেও থাকতে চায় তাদের সে স্বাধীনতা দেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। ভারত ও পাকিস্তানের জনগণ এক্ষেত্রে তাদের প্রভাবকে কাজে লাগাতে পারেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ