শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

একটি মৃত্যুর সংবাদ যেন কোটি মজলুমের আর্তনাদের ধ্বনি প্রতিধ্বনি

এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম প্রধান : ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারিত কিছু গান আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তার একটি ছিল-“শোন একটি মজিবরের কন্ঠস্বরের থেকে লক্ষ মজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রনি। বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ”। এটা সত্য যে অনেক সময় একটি কন্ঠে অনেক সময় লক্ষ মানুষের কন্ঠের স্বর ধ্বনিত হয়। আমার নিকট প্রতিবেশী রংপুরের পীরগঞ্জ পৌরসভার বাসিন্দা স্থানীয় পীরগঞ্জ দাখিল মাদরাসার প্রভাষক উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর এর দায়িত্ব পালনকারী মাওলানা গোলাম মোস্তফা বিগত ১০ জানুয়ারী/২০১৯ ভোর রাত ৪ ঘটিকার সময় তাঁর পীরগঞ্জের ছোট নিবাসে ইন্তিকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাহি রাজিউন)। বয়স কতই হবে বায়ান্ন বা তিপ্পান্ন। ২০১১ থেকে ২০১৮ টানা আট বছর তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রী, তিন স্নেহময়ী আদরের কন্যা এবং সবার ছোট স্নেহের পুত্র সন্তানের সাথে নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারেন নি। প্রতিদিনই সন্ধার পর রাতের আঁধার নামার সাথে সাথে তাকে রাত কাটানোর জন্য একটি আশ্রয়ের খোঁজে বের হতে হতো। কত করুন ছিল জীবনের সেই ফেলে আসা দিনগুলো। প্রতিরাতে শুভাকাঙ্খী আর আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে রাত কাটানোর জন্য সে একজন করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। গ্রেফতার আতংকে ৮ বছরে তার মাথার চুলগুলো ঝড়ে পড়েছিল। শরীরের হাড়গুলো মাংসের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল। সামান্য একটা মাদরাসার চাকরির ওপর চলতো তাঁর সংসার। চাকরির বাইরে তার সংসারের আয়ের উৎস বলে কিছু ছিল না। মহান রাব্বুল আলামিন জানে তিনি কীভাবে মরহুম গোলাম মোস্তফার বিধবা স্ত্রী, ইয়াতিম তিনটি কন্যা এবং একটি পুত্র সন্তানকে রিজিক দান করবেন। গোলাম মোস্তফা আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। পুলিশ আর তাঁকে গ্রেফতারের জন্য কোনো দিন খুঁজে পাবে না। মরহুমের জানাযায় গিয়ে তাঁর লাশটি শেষ বারের মত দেখার সুযোগ হয়েছে। দেখলাম আল্লাহর একজন নেক্কার বান্দাহ যিনি জীবনে কারো সাথে রাগ বা অভিমান করেন নি। যিনি ছিলেন সদাহাস্য, তিনি আজ দুনিয়ার টেনশনমুক্ত হয়ে এক দীর্ঘ নিদ্রায় চলে গেছেন। তাঁর আইনজীবী হিসাবে জানি তাঁকে গত আট বছরে প্রায় দশটি মিথ্যা মামলায় আসামী করা হয়েছিল। সর্বশেষ তাঁকে পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ৬০ মাইল উত্তর-পশ্চিমের জনপদ রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে হিন্দু বাড়িতে রহস্যজনক অগ্নিসংযোগ এর দুটি মামলায় আসামী করে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ঐ দুটি মামলায় পীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজন মানুষকেও গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। মনে পড়ে ঐ দুটি মামলায় গ্রেফতারকৃত একজন আসামী গোলাম রসুলকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। যে কিনা অগ্নিসংযোগের ঘটনার তারিখের পূর্বদিন ইতিপূর্বেকার কয়েকটি মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর মহামান্য হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। ৬০ মাইল দূর থেকে পীরগঞ্জের আসামীরা কীভাবে অগ্নিসংযোগে অংশ নিয়েছিল তা ভাবতে অবাক লাগে। মাওলানা গোলাম মোস্তফার বাড়ি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শ্বশুর বাড়ি এবং নির্বাচনী এলাকা রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় ছিল। যা এখন মাননীয় স্পীকারের নির্বাচনী এলাকা। বিগত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পীরগঞ্জ উপজেলার কোথাও বিএনপি জামায়াতের কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। মিছিল, মিটিং, পিকেটিং, অবরোধ কোনো ধরনের, কোনো কর্মসূচি বিরোধীরা পালন করেনি। যার বাস্তব স্বাক্ষী স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। পীরগঞ্জ থানার বাসিন্দাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ জামায়াতকে সমর্থন করেন মাত্র। তা সত্ত্বেও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা মাননীয় স্পীকারের অজ্ঞাতসারে পীরগঞ্জ থানার শতাধিক আলেম, ইমাম, মুয়াজ্জিন, মাদরাসার ছাত্র এবং কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মানুষকে গ্রেফতার করে আসামী বানিয়ে দিয়েছেন। মামলা গুলোর কারণে আসামীদেরকে মাসের পর মাস ধরে হাজতবাস করতে হয়েছে। যার মধ্যে মরহুম মাওলানা গোলাম মোস্তফাও ছিলেন একজন। পীরগঞ্জ থানার আসামীদের মত সারাদেশের লক্ষ লক্ষ বিরোধি দলীয় নেতা-কর্মী সহ অসংখ্য নির্দলীয় সাধারণ মানুষও মিথ্যা এবং কল্পিত অভিযোগের আসামী হয়ে দিনের পর দিন হাজতবাস করেছেন এবং করছেন। এ সব মানুষের মামলায় জড়িত হওয়ার কারণে তাঁদের সাথে পারিবারিকভাবে সংযুক্ত কোটি কোটি মানুষ জুলুম হয়রানী এবং আতংকের শিকার হয়েছেন। এসব পরিবারের সদস্য আসামীর মা, বাবা, স্ত্রী, শিশু সন্তানরা অনেক সময় অনাহারে অর্দ্ধাহারে দিন কাটিয়েছে। আসামীর জামিনের খরচ যোগাতে অনেকেই জমি জমা, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রয় করেছেন। টাকা ধার কর্জ করে পরিবারগুলো ঋণগ্রস্ত হতে বাধ্য হয়েছেন। গোটা দেশে গত বছরগুলোতে কয়েকশত মানুষ অপহরণের পর গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেককে মাসের পর মাস গুম করে রাখার পর কাউকে হয়ত কোনো একসময় দয়া করে মামলায় গ্রেফতার দেখানোর মাধ্যমে আদালতে হাজির করা হয়েছে। আবার অনেকের আর কোনদিন পরিবারের প্রিয়জনের কাছে ফিরে আসা ভাগ্যে জোটেনি। এসব কাল্পনিক মোকদ্দমার আসামীরা জামিন পেলেও কোনদিনই পরিবারের সদস্যদের সাথে নিজ বাড়িতে আর কোনো দিনই ঘুমাতে পারেনি। এসব আসামীরা প্রতি রাতেই প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনের গলগ্রহ হয়ে রাতের পর রাত অতিক্রম করে চলেছে। পরিবারগুলোর ভেতরে যে কি পরিমাণ দারিদ্রতা, অশান্তি আর অস্থিরতা বিরাজ করছে চিন্তা করলে গা শিউরে উঠে। বিগত ৭/৮ বছরে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ গ্রেফতার হয়েছে। তাদের অনেকের ভাগ্যে জুটেছে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক আর অমানুষিক নির্যাতনের আধুনিক কলাকৌশল। যেসব মামলায় আসামীর নাম থাকেনা সেসব মামলাও আরো ভয়ংকর রূপে দেশের মানুষের আতংকের কারণ হতে দেখা গেছে। কারণ এসব মামলায় পুলিশের অবাধ স্বাধীনতা আছে। যাকে খুশি তাকে গ্রেফতার করার ও রিমান্ড নেয়ার। বিভিন্ন অভিযুক্ত রাজনৈতিক দলের নেতারা অভিযোগ করেছেন যে, গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে বা গ্রেফতার হলে রিমান্ডে নেয়ার ভয় দেখিয়ে নাকি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য বিশাল অংকের গ্রেফতার বাণিজ্য করেছেন। গত ৮ বছরে আদালতের ডকে, আদালতের আসামী রাখার ব্যারাকে কত দাড়ি, টুপি পড়া বয়স্ক ব্যক্তিকে দেখলাম তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। আদালতের নির্দেশে এসব মানুষের অনেকেই মাসের পর মাস হাজতবাস করেছেন। জামিন লাভের পর প্রতিমাসে হাজিরা দিয়ে চলেছেন। অনেকের মামলা সংখ্যা ত্রিশ চল্লিশও ছাড়িয়ে শতকের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে। যার ফলে জামিন লাভের পরও প্রতিদিনই এসব আসামীদের আদালত অঙ্গনে বিচরণ করতে হচ্ছে। মুসা (আঃ) জন্মকালীন সময়ের ফিরআউনের পুলিশ বাহিনীর কথা মনে পড়লো। ফিরআউনের রাজ জোত্যিষিরা ভবিষ্যত বাণী করেছিল যে মিসরে বসবাসকারী বণি ইসরাঈল জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের বংশে একটি পুত্র শিশুর জন্ম হবে। যে শিশুটির হাতে জালিম ফিরআউনী রাষ্ট্র শক্তির পতন হবে। ফিরআউন তাঁর পুলিশ বাহিনীকে বণি ইসরাঈল জাতিগোষ্ঠীর লোকদের বস্তি এলাকায় মোতায়েন করেছিল। যাঁরা বণি ইসরাঈল জাতিগোষ্ঠীর লোকদের বাড়িঘরে প্রতিদিনই হানা দিত। সেখানে কোনো মায়ের কোলে পুত্র সন্তানের দেখা পাওয়ামাত্র সন্তানটিকে মেরে ফেলত আর কন্যা সন্তানদের জীবিত রাখত। আমাদের সরকারেরতো ফিরআউনের সরকারের মতো কোনো সমস্যা নেই। কারণ আমাদের দেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এদেশের পুলিশ, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কেন প্রতি রাতেই দেশের একটি জনগোষ্ঠীর মানুষের বাড়িঘরে হানা দিয়ে গ্রেফতার আতঙ্কে রাখছে বা গ্রেফতার করে কোন মিথ্যা মামলায় আসামী করছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আচরণ তো হওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মতো। আদর্শ স্থানীয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে এদেশের সাধারণ মানুষের মনে নিরাপত্তা বোধ সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন আমরা কি দেখছি? এখন পুলিশ বা র‌্যাপিড এ্যাকশন বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে মানুষ আতঙ্কিত হয়। এটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। এসব বাহিনীর সদস্য ভাইয়েরা এদেশেরই সন্তান। তাদের হতে হবে এদেশের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি বা প্রতীক। আর চোরাকারবারী, মাদকব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী এবং যেকোন ধরনের চোর, ডাকাত এবং দস্যু আর নারী নির্যাতনকারীদের আতঙ্ক। গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি দেশের কোনো এক প্রান্তে, কোনো একটি রাজনৈতিক সন্ত্রাস বা হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটলে ঐ ঘটনাস্থলের আশেপাশে থানা ও জেলায় অনেক সাধারণ লোকদের গ্রেফতারের হিড়িক পড়ে যায়। আশেপাশের উপজেলা, জেলার গ্রেফতার হওয়া লোকজন বুঝতেই পারেনা যে কেন তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো। মনে পড়ছে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ এলাকার আওয়ামী লীগ দলীয় একজন এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন তাঁর নিজ বাড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। ঐ ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকাসহ গাইবান্ধা ও রংপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭৬ জন মানুষকে বিনা কারণে গ্রেফতার করা হয়। পরে তদন্ত কর্মকর্তাগণ মোকদ্দমাটি তদন্ত শেষে দেখতে পান যে, ঐ এলাকার জাতীয় পার্টির সাবেক একজন এমপি তাঁর নিজস্ব প্রশিক্ষণ দেয়া সন্ত্রাসীদের দিয়ে এমপি লিটনকে হত্যা করায়েছিল। যাতে তিনি ভবিষ্যতে নির্বিঘেœ ঐ এলাকায় এমপি নির্বাচিত হতে পারেন। তাহলে যে ৭৬ জন লোককে এমপি লিটন হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল বা যাদেরকে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করা হয়েছিল তাদের সেই জুলুমের বিচার কে করবে? মনে পড়ে কারাবন্দী জামায়াত নেতা মাওলানা দেলোওয়ার হোসেন সাঈদীর তাফসির শুনেছিল এমন কিছু ভক্তের কথা। জামায়াতের দলীয় রাজনীতি করতো না বা এখনও করে না এমন লক্ষ লক্ষ জামায়াত ভক্ত তার বিরুদ্ধে আনীত যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতে নেমে এসেছিল। সাঈদী সাহেব জেলখানা থেকে ঐ ধরনের কোনো নির্দেশ তার ভক্তদেরকে দেন নি। সাঈদীর রায়ের তারিখে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা সদরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ৭ জন সাঈদীভক্ত নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিল। যারা কেউই ঐ উপজেলার জামায়াত শিবিরের মুখ চেনা কোনো নেতাকর্মী ছিল না। পরে ঐ ঘটনার মামলায় পুলিশ যে ধরনের অভিযোগ সাজিয়েছিল তা বরই বিস্ময়কর। একজন আইনজীবী হিসেবে আমার এজাহার দুটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। তাতে দেখেছিলাম এজাহারে বলা হয়েছিল- জামায়াত শিবিরের লোকজনই নাকি মিছিলের মধ্য থেকে ঐ ৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল। ঐ ৭ জন নিরীহ মানুষের পরিবার কি অবস্থায় আছে তাঁর খোঁজ নেয়ার মতো লোক আর দেখছি না। সারাদেশের সকল মহানগর, জেলা সদর, উপজেলা সদর এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সরকারি দলের বিরোধী মতের লক্ষ লক্ষ মানুষকে আসামী করে মামলার জালে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। আসামীদের বিরাট একটি অংশ রাজনীতির সাথে জড়িত নন। তাঁদের অনেকেই গরিব দিন মজুর, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক। জামায়াত শিবির এর সমর্থক বা নেতা বা পরিবারের সদস্য হিসাবে পরিচিত এবং বিএনপি, ছাত্র দলের সদস্য হিসাবে পরিচিত লক্ষ লক্ষ মানুষকে হাজার হাজার মিথ্যা মামলায় সংযোগ করে রাখা হয়েছে। এ সকল মামলায় জড়িয়ে দেয়া মানুষেরা রাতের বেলায় বছরের পর বছর ধরে নিজের ঘর-বাড়িতে ঘুমাতে পারে না। অনেকেই দীর্ঘদিন যাবৎ এলাকা ছেড়ে ভিন্ন এলাকায় বসবাস করছে। বাংলাদেশের সংবিধানে এদেশের জনগণকে প্রজাতন্ত্রের মালিক ঘোষণা করেছে। সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকের বাক স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, কর্ম বেছে নেয়ার স্বাধীনতা, বিচার পাওয়ার স্বাধীনতার গ্যারান্টি দিয়েছে। তাহলে প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের বিরাট এই অংশটি কেন বছরের পর বছর তাঁদের মৌলিক নাগরিক অধিকার ভোগ করা থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছেন? পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো অদৃশ্য মহলের ইঙ্গিতে যখন খুশি যাকে তাকে গ্রেফতার করছে এবং অনেক সময় অনেক আসামীর দীর্ঘদিন হাজতবাস করার পর আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্তির তারিখে পুনরায় তাকে জেল গেট থেকে গ্রেফতার হয়ে হাজতে যেতে হয়েছে। এই জুলুম নির্যাতনের কি কোন সমাপ্তি নেই? লেখাটা শুরু করেছিলাম মাওলানা গোলাম মোস্তাফার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে। তাঁর মৃত্যু সাধারণ চোখে স্বাভাবিক মৃত্যু মনে হলেও এটি স্বাভাবিক ছিল না। তার ওপর সার্বক্ষণিক মানুষিক জুলুম নির্যাতনের মাধ্যমে তাঁকে মৃত্যুর দিকে অনিবার্য ভাবে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। কাউকে সরাসরি আঘাতের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটানোর চেয়ে বিভিন্ন প্রকার শারীরিক মানুষিক নির্যাতন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া সাধারণ হত্যার চেয়ে কোনো ধরনের কম অপরাধ নয়। অনেকেই বলবেন যে, আল্লাহর হুকুমেই মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। আমিও একথার সাথে একশতভাগ একমত পোষণ করি। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, হত্যাকারী যাকে খুন করে ঐ নিহত ব্যক্তির মৃত্যুর বিষয়েও আল্লাহর হুকুম কার্যকর থাকে। তাহলে কেন একজন হত্যাকারীকে বিচারের সম্মুখীন করা হয় বা তাকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। কেন আখিরাত দিবসে আল্লাহ সব ধরনের বিচারের আগে হত্যাকারীর বিচারকার্য শুরু করবেন? যে গানটি দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম গানের প্রথম দুটি লাইনের সুরের মতো বাংলাদেশে যখন কোনো এ ধরনের নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তার মৃত্যুর খবর বা তার মৃত্যুমুখ আমাদের হৃদয়ের কানে বাংলাদেশের লক্ষ কোটি নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত করে। দেশের আকাশ-বাতাস নির্যাতিত, নিপিড়িত মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে আছে। হৃদয়ের কান খুললেই এ সকল মানুষের আর্তনাদই শুনতে পাওয়া যায়। হামলা-মামলার ভারে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষগুলো এদেশেরই নাগরিক। যারা তাঁদেরকে নির্যাতন করছে তারাও এদেশের নাগরিক। এসব নির্যাতিত পরিবারে জন্ম নেয়া ভবিষ্যত প্রজন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলকেই তাদের এই দুর্ভোগের জন্য দায়ী করে এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে উঠছে। এই নেতিবাচক মনোভাব নতুনভাবে বেড়ে উঠা প্রজন্মকে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান এবং মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন করে তুলতে পারে। যা মোটেও অভিপ্রেত নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশের মানুষের যে অংশটি স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধীতা করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করেছিল তাঁদের মধ্যে যারা খুন, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ এবং লুটপাটের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত ছিল না তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁরই রক্তের উত্তরাধীকার। তিনি এবং তাঁর দল আর তারই আদর্শের উত্তরাধীকারিত্ব বহন করবে এটাই কাম্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চতুর্থবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি এবারে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেয়ার পর ঘোষণা করেছেন-তিনি দেশের সকল মানুষের প্রধানমন্ত্রী। আমরা তাঁর এই বক্তব্যে আশাবাদী হয়েছি। আমরা এদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ আশা করবো যে তিনি এবং তার নতুন সরকার এবং নতুন জাতীয় সংসদ, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটিলিয়ানসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিচার প্রশাসন এবং সিভিল প্রশাসন সবাই এদেশের সকল নাগরিকের বন্ধু হয়ে উঠবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে সাড়া দেশের যে সকল নিরীহ মানুষ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গেছেন তাদের ঐ ধরনের মামলা থেকে মুক্ত করে দিবেন। ঐ সকল মামলা জটে পড়া লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি তাদের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ জীবন ফিরে পায় তারাও দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। নতুবা দেশের মানুষের একটি বড় অংশের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দিয়ে দেশের কোনো টেকসই উন্নয়ন বা সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না। এ ব্যাপারে সরকারি দল, বিরোধীদলকে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজন উভয় পক্ষের সদিচ্ছা ও সৎ উদ্যোগ। আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সুরা আন নিসার ১১২ নং আয়াতে বলেন- “যে ব্যক্তি স্বয়ং কোনো পাপ বা অপরাধমূলক কার্য করে অতঃপর তা অন্য কোনো নির্দোষ ব্যক্তির ওপর তা আরোপ করে সেতো মিথ্যা আর পাপের একটি বোঝা নিজের কাধে তুলে নিল।” আসুন আমরা কুরআন বিশ্বাসী মুসলমান হিসাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের বিবেককে জাগ্রত করি। আর মিথ্যা মামলার জালে জড়ানো দেশের কয়েক লক্ষ নাগরিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের এহেন জুলুম ও হয়রানী থেকে নিস্কৃতি দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দরবারে এবং বিশ্ব এবং বাংলাদেশের সকল বিবেকবান মানুষের নিকট দায়মুক্ত হই। ভারতের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পি ভুপেন হাজারিকার গাওয়া একটি গানের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি-
‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে।
মানুষ মানুষকে পণ্য করে
মানুষ মানুষকে জীবিকা করে,
পুরোনো ইতিহাস ফিরে এলে
লজ্জাকি তুমি পাবে না ও বন্ধু?
মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে...’
বল কি তোমার ক্ষতি, জীবনের অথৈ নদী পার হয়
তোমাকে ধরে দুর্বল মানুষ যদি।’
বল তোমার কি ক্ষতি।
মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে...
মানুষ যদি না হয় মানুষ, দানব কখনো হয় না মানুষ।
যদি দানব কখনও হয় মানুষ ও বন্ধু লজ্জা কি তুমি পাবে না?
মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে...
ইমেইল : [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ