শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ব্যবহারে মুমিনের পরিচয়

হাবিবা বিনতে নুরুন্নবী : সেদিন এক স্কুল বালকের কন্ঠে হঠাৎ বাংলা গালাগালের দুয়েক শব্দ শুনেই মনে হতে লাগলো আমরা যেন সহসাই নৈতিক অধঃপতনের এক অদ্ভুত অচেনা রাজ্যে এসে সানন্দে  প্রবেশ করেছি। কয়েক দশক পূর্বের জাহেলী সমাজে এ জাতির পিছে সরে আসা নিতান্ত সহজ কথা নয় এমনটা ভেবে যেন বুকে নিঃশ্বাসটা আটকে গেলো। একসময় পাশ্চাত্য সমাজের মানুষের আচরণশৈলী নিয়ে হাসতাম। সেখানে ছোট বড় সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকাকে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পরিপন্থী মনে করতাম। কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন দেখছি আমরা মুসলিম সভ্য জাতি হয়েও, এতসব সম্মানীত শব্দাবলী, পরস্পরকে সম্বোধন করার এতসব পরিচয়, নাম, শব্দ রেখে নিজেরা নিজেদের অসম্মানিত করার, ছোট করার সবরকম কৌশল, শব্দাবলী চর্চা করার নোংরা পন্থায় অভ্যস্ত হচ্ছি। বিগত কয়েক বছরে জনগন রাস্ট্রীয় অন্যায় নীতি ও দলীয় হায়েনাদের ভীড়ে নিজেদের কোনমতে কুড়ে পাওয়া জীবন রচনায় মানুষ যেমন অদ্ভুতভাবে ন্যায় অন্যায় মানিয়ে চলতে শিখেছে তেমনি নিজেদের অশান্তি, রাগ, ক্ষোভ প্রকাশে নোংরা শব্দগুলো ব্যবহার খুব ভালভাবেই রপ্ত করেছে। ফেসবুকের কল্যানে  আবালবৃদ্ধবনিতারা এসবের সংস্পর্শে আসছে ভয়ানকভাবে। এ নোংরা ভাষা আজ যেন জাতির সাধারণ ভাষায় পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, নাটক, সিনেমা, উপন্যাসে, ফেসবুকের পোস্ট এবং কমেন্টে, বন্ধুদের আড্ডায়, কলিগদের সাথে আলোচনায়, চায়ের দোকান হতে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সংসদ ভবন পর্যন্ত কোথাও এ শব্দগুলি থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছেনা। মা বাবা বংশ ধরে গালগাল যেন পান্তাভাত এখন ছেলেমেয়েদের কাছে। আপনার কোমলমতী সন্তান যে ফেসবুক ও চারপাশের অসুস্থ পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে কতটুকু অসুস্থ ও অনৈতিক চিন্তার ও কাজের অধিকারী হয়ে যাচ্ছে তা আপনিও কল্পনা করতে পারবেননা। এ অধঃপতনের ফলাফল অত্যন্ত করুণ হবে বর্তমান ও ভবিষৎ জেনারেশনের জন্য। অসুস্থ মানুষের কু-চিন্তা মনন যে এখন এসব শব্দ ও বাক্যের মাধ্যমে সাধারণদের মাঝে ভাইরাসের মত ছড়াচ্ছে তা চিন্তা করতেই অসহ্য লাগে। আপনি আমি কজন বিবেকবান মানুষ এগুলো এভয়েড করলেও অধিকাংশই কৌতুহলের বশে, নতুনত্বের মজায় এসব আহরণ করছে। এহেন ন্যাক্কারজনক অবস্থায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজনীতি, মানুষের মূল্যবোধ এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে মৌখিক ও বাস্তবিক উভয় দৃষ্টিকোন থেকেই মানুষ নোংরা স্বভাবের, নোংরা চরিত্রের হয়ে পড়ছে।
মানুষকে আল্লাহ বিবেক দান করেছেন। এ নেয়ামতের কোন প্রয়োজন মানুষ তখনই মনে করবেনা যখন রাষ্ট্রে এসবের চর্চায় বাধাগ্রস্ত ও জীবিকার পথ, জীবন যাত্রা পরিচালনার দিক খর্বিত হয়ে পড়ে। ঠিক তেমনি আমরা দেখি নিরাপরাধ মানুষ যখন জেলে ডুঁকরে কাঁদে তখন চাঁদাবাজরা লুটপাটে ব্যস্ত। সুবর্নচরের গৃহীনির ধর্ষনের বিচার না হলেও এখন পতিতার সম্মান রক্ষার্থে আন্দোলন হয়। মানুষ এগুলো বুঝে কিন্তু চেয়ে থাকে কারণ ঐ যে কোটা আন্দোলনের ভাইদের চাকরি না পাওয়া, অধিকার না পাওয়ার কষ্ট। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের ছোট্ট ছেলেগুলো কি আর চেয়েছিল? তাদের ওপর হামলে পড়ার কারণ কি? ঐ যে, এত ন্যায় নীতি এদেশে সহ্য হবেনা। রাষ্ট্রের চলতে হবে শকুনীদের নীতিতে যারা শুধু ভক্ষণ করতেই জানে, লুটপাট করতেই জানে। সমাজের মানুষ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তাই অন্যায়ের সাথে আপোষ করে কোন মতে স্রোতের বানে ভেসে চলে।অথচ এ স্রোত যে অবশেষে জাহান্নামের অগ্নিকুন্ডে  ঝাঁপিয়ে পড়বে সে অনুভব নির্জীব এ লোকদের হয়না। নিজেকে টিকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে সে সকলের ক্ষতি সাধনে রাজী হয়ে যায়। মানুষের মাঝে চরম অসন্তোষ, বিভক্তির বোমা ফেটেছে। মানুষের প্রতি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব তো ছাড় এখন স্ত্রী স্বামীকে ছয় টুকরা করে, ঐশীর পরতো আরো কত ঐশীর কাহিনী শুনলাম, স্বামী তার তিন বাচ্চা ও স্ত্রীকে গলায় রশি ঝুলিয়ে নিজেও ঝুলে পড়ার মত ঘটনা এখন আর অদ্ভুত লাগেনা। এই যে চরম অসন্তোষ, অধৈর্য হয়ে যাওয়া অতঃপর নোংরা শব্দের বিচ্ছুরণ এসকল কিছু যেন একটি আদর্শচ্যুত জাতির একটি নৈতিক আদর্শের চরম প্রয়োজনীয়তাকেই মনে করিয়ে দেয়। যে আদর্শ কোন নির্দিষ্ট জাতি গোত্রের দলের নয়, সকল মানবতার। যে আদর্শ এরচেয়েও কোন এক জাহেলী যুগে পৃথিবীর বুকে প্রশান্তির বায়ু বয়ে এনেছিল।
আসুন জেনে নেই মানুষের মাঝে মানুষের সম্পর্ক ও নোংরা শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে সে আদর্শে কি বলে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সওয়াসাল্লাম বলেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকে সে হবে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে এর কোন একটি স্বভাব থাকবে, তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকের একটি স্বভাব থেকে যায়।
১/ আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে
২/ কথা বললে মিথ্যা বলে
৩/ চুক্তি করলে ভঙ্গ করে এবং
৪/ বিবাদে লিপ্ত হলে অশ্লীল গালি দেয়।
সহীহ বুখারী (ই.ফা.): হাদিস-৩৩।
নবী (স.) বলেন, মুমিন কখনো দোষারোপকারী, অভিশাপকারী, অশ্লীল ও গালিগালাজকারী হয় না। [তিরমিজি ২০৪৩]
রাসূল (স.) বলেছেন, “তোমরা ভাষায় মিষ্টভাষী হও, আচরণে সংযমী হও।”
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাক এক টুকরা খেজুর দিয়ে হলেও। যদি তা না পাও তা হলে মধুর ভাষা বিনিময়ে। সহীহ বুখারী (ই.ফা.): হাদিস-৫৫৯৮।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন- আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদের) ধুলি ও জাহান্নামের ধোঁয়া কোন বান্দার মধ্যে কখনো একত্র হতে পারে না। অনুরূপভাবে মনের সংকীর্ণতা ও ঈমান কখনো একত্র হতে পারে না। (নাসাঈ, ইবনে মাজা)।
সামুরা (রা.) বলেন, নবী (স.) বলেছেন-তোমরা পরস্পরকে আল্লাহর অভিশাপ, আল্লাহর ক্রোধ এবং আগুনের দ্বারা অভিসম্পাত করো না। (তিরমিজি, আবু দাউদ)।
আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) বলেন- যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা বলে এবং তা প্রচার করে তাদের উভয়ে সমান পাপী। (আদাবুল মুফরাদ)
“যেসব লোক ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের বিনা কারণে কষ্ট দেয় তারা একটা অতি বড় মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট গুনাহের বোঝা নিজেদের মাথায় উঠিযে নেয়।” (সূরা আহযাব : আয়াত-৫৮)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলিমকে গালি দেয়া গুণাহের কাজ এবং তার সাথে মারামারি করা কুফুরী। মুসলিমঃ (হাদীস একাডেমী -১২৪,১২৫ ই.ফা.-১২৫)। বুখারী : তাওহীদ প্রকাশনী -৪৮।
“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কোনো দল যেন অপর কোনো দলকে উপহাস না করে। কেননা, যাদের উপহাস করা হল তারা উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং নারীরা যেন অপর নারীদের উপহাস না করে। কেননা, যাদের উপহাস করা হল তারা উপহাসকারীনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরকে দোষারোপ করো না এবং মন্দ নামে ডেকো না। ঈমানের পর ফুসূক অতি মন্দ। যারা তওবা করে না তারাই যালেম।” (সূরা হুজুরাত : আয়াত-১১)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে চারটি বিষয় হলো জাহিলী বিষয়, এগুলোকে লোকেরা (পুরোপুরিভাবে) ছাড়বে না :
(ক) মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করে কাঁদা
(খ) বংশ তুলে গালি দেওয়া,
(গ) রোগ সংক্রমিত হওয়ার ধারনা, এটি উটে চর্ম রোগ হলে একশটি উটে তা সংক্রামিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রথমটিকে কে চর্ম রোগে আক্রান্ত করল....?
(ঘ) আর নক্ষত্র ও রাশিচক্রের (প্রভাব) মান্য করা, (তারা বলে) অমুক, অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে আমাদের বৃষ্টি হলো। তিরমিযী (ই.ফা.): হাদিস-১০০১।
নবী (স.) বলেন, “তুমি হক কথা বলো যদিও তা তিক্ত হয়’। তিনি আরো বলেন- “সুন্দর ভাষা জান্নাতে পৌঁছায় আর দুর্ব্যবহার দোযখে পতিত করেণ” (বুখারী)।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন- মুমিন ব্যক্তি চিন্তাশীল, গম্ভীর ও ভদ্র প্রকৃতির হয়ে থাকে। আর পাপিষ্ঠ ব্যক্তি প্রতারক, ধোঁকাবাজ, কৃপণ, নীচ ও অসভ্য হয়ে থাকে। (আবু দাউদ)।
আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) কখনো অশ্লীলভাষী, অভিশাপকারী বা গালি বর্ষণকারী ছিলেন না। অসন্তুষ্ট হলে তিনি বলতেন- তার কি হলো? তার কপাল ধূলিমলিন হোক। (বুখারী)
আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, “ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ে তোল, সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং মুর্খ জাহেলদের কাছ থেকে দূরে থাকো।” [ সুরা আরাফ: ১৯৯ ]
অন্য আয়াতে এসেছে, “রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে ন¤্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মূর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম।” (সুরা ফোরকান : ২৫:৬৩)
হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সেই প্রকৃত মুসলমান যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।
এসব আয়াত ও হাদীস থেকে বুঝা যায় ইসলাম এসেছে মানুষকে সভ্য-ভদ্র-ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, নৈতিকতার অসম শিখড়ে পৌঁছার জন্য, ব্যবহার দিয়ে বিশ্ব জয় করবার জন্য। অথচ এ আমাদেরর ব্যবহারে আজ আমরাই নির্যাতিত। আসুন তাই ইসলামী চেতনার অধিকারী হয়ে নিজেদের জীবন সৌন্দর্যমন্ডিত করি। আল্লাহর ভালবাসায় বুকের যমীন পরিতৃপ্ত করেই একমাত্র তা সম্ভব।
রাষ্ট্রের, সমাজের অন্যায় নীতি, অপসংস্কৃতি থেকে নিজেদের দূরে রাখি, অন্যকেও বুঝাই। এ জীবন ক্ষণস্থায়ী, ডায়েরীর পাতার মত। আপনার জীবন যদি অসুস্থ পথে কাটান তাহলে সে জীবনের ডায়রি কি আপনি আপনার প্রিয়জনদের দেখাতে পারবেন? জীবনের পাতা যত সুন্দর হবে আপনার ডায়েরী অবলিলায় মানুষের অবলোকনে আসবে ও অনুসরণযোগ্য হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি উভয় চোওয়ালের মধ্যভাগ (জিহবা) ও দুই রানের মধ্যভাগ (লজ্জাস্থান) হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করে আমি তার জন্য জান্নাতের দায়িত্ব গ্রহণ করি। [বুখারী: ৬৪৭৪]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ