শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং-এর ছত্রিশ বছরের অগ্রযাত্রায় সৃষ্ট সমস্যা এবং উত্তরণের উপায়

-এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম প্রধান, এমএম (ডাবল হাদীস, তাফসীর), বিএসএস (সম্মান) এমএসএস (রাষ্ট্র বিজ্ঞান), এলএলবি
[তিন]
ইসলামী ব্যাংকিং এর সফল অগ্রযাত্রার মাঝে ব্যাংকের শুভাকাঙ্খীদের কিছু খটকা এবং প্রশ্ন : ১৯৮৩ সালের ১২ ই আগষ্ট যেদিন ঢাকার মতিঝিলের রাস্তায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল।  সে সময়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র ছিলাম। সৌভাগ্যবশত ঐ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার থাকার সুযোগ হয়েছিল। তার আগে ১৯৮৩ সালের ৩০ শে মার্চ যেদিন মতিঝিলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর প্রথম শাখা কার্যক্রম শুরু করেছিল সেদিন আমার অনেক প্রিয় এবং পরিচিত ভাইয়েরা দুঃসাহস করে ইসলামী ব্যাংকে যোগদান করেছিল। আমার ব্যক্তিগত ভাবে নিজের ঐ ধরনের কোন সাহস ছিল না। যেসব ভাইয়েরা সেদিন বা তার পরবর্তীকালে ইসলামী ব্যাংকে যোগদিয়ে ব্যাংকটিকে অভাবনীয় অগ্রগতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছেন বা অনেকেই বিদায়ের দ্বারপ্রা্েন্ত রয়েছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা থাকবে চিরদিন। আজকের আলোচনা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর ইতিহাস বর্ণনা বা ঈর্ষণীয় সাফল্য তুলে ধরা নয়। বরং ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ধারণ করে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড বা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকসমূহ নির্ভেজাল, অবিকৃত ইসলামী অর্থনীতির অনুসরনে তাদের ব্যাংক সমূহকে পরিচালিত করতে সক্ষম হচ্ছে কি না সে বিষয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা। যাতে করে ইসলামী ব্যাংক সমূহ তাদের আগামীর পথ চলায় ইসলামী শরীয়তের নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরনের জন্য  বিষয়টি সম্পর্কে কিছু সমালোচনা শুনে নিজেদেরকে শরীয়ার আলোকে শুধরে নিয়ে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারে। আর যে সব আমানতকারী বা ব্যাংকের সেবা গ্রহণকারী মানুষ বা প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র শরীয়া ভিত্তিক এবং সুদমুক্ত লেনদেন করার আশায় বা ইসলামী শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যবস্ াকরবেন সে আশায় ইসলামী ব্যাংক সমূহের সাথে নানাভাবে যুক্ত হয়েছেন তারা যাতে হালাল পানির সাথে হারাম পানি পান করতে বাধ্য না হন সেই প্রত্যাশায় আজকের এই লেখা।
বাংলাদেশে যেসব ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে তাদের সবার সাইনবোর্ড মনোগ্রাম প্রকাশিত ডায়েরী, ক্যালে-ার বা যে কোন প্রকাশনায় একটি বাক্য দৃশ্যমান তাহলো শরীয়াহভিত্তিক পরিচালিত অথবা ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক পরিচালিত। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে শরীয়াহ বলতে অবশ্যই ইসলামী শরীয়তকে বোঝানো হয়েছে। আমার এই আলোচনায় আমি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর উপরেই আমার গবেষণা সীমাবদ্ধ রেখে আলোচনা করবো। বাংলাদেশের অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকগুলোর পরিচালনা বা শরীয়াহ প্রতিপালনের বিষয়ে আমার কোন অভিজ্ঞতা নাই। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর যাত্রাপথে আমি লক্ষ্য করেছি যে, ব্যাংকটির যাত্রা শুরুর সময় থেকে প্রত্যেকটি শাখায় এবং প্রধান কার্যালয়ে যথাসময়ে ফরজ নামাজ সমূহ জামায়াত সহ আদায় হতো। নামাজ শেষে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বা কর্মচারী, কর্মকর্তাগণ ব্যাংকের বিভিন্ন সমস্যাদি আলোচনা করে যৌথভাবে দোয়া মুনাজাত করতেন। সেবার মান ছিল খুবই জনমুখী। কোন গ্রাহককে সেবার জন্য দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয় নি। ব্যাংকটির শাখা রাজধানীর বিভিন্ন  এলাকায় এবং বিভিন্ন জেলা ও অন্যান্য স্থানে বিস্তৃতিকালে অনেকস্থানে ব্যাংকটির বিদ্বেষীদের দ্বারা হামলা ও বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিল। বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় মানুষ ব্যাংকটিকে নিজের পরিবারের সদস্যদের ন্যায় সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দিয়ে ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। সে ইতিহাস ব্যাংকের বর্তমান কর্মকর্তা কর্মচারী বা নীতি নির্ধারকগণ মনে রাখতে পেরেছেন কি না জানি না। অবশ্যই সে ইতিহাস ভোলার মতো বিষয় নয়। এক সময় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডাইরেক্টর বা এমডি সহ উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ ব্যাংকের অধস্তন শাখা সফরে এসে ব্যাংকের গ্রাহকদের সাথে খোলামেলা কথা বলতেন। সমস্যা শুনতেন এবং যাবতীয় সমস্যা নিরসনের আশা দিতেন। সেই সাথে কখনো কখনো তারা সাধারণ জনগণ যারা ব্যাংকের গ্রাহক ছিলেন না তাদের সাথেও কথাবার্তা বলতেন। পরিদর্শনে আসা উল্লেখিত ব্যক্তিগণ ব্যাংকের কর্মচারী কর্মকর্তাগণ সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেন কি না সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিতেন। প্রতিদিন শাখা ব্যবস্থাপকগণ সকল নামাজের জামায়াতের তদারক করতেন এবং কর্মচারী কর্মকর্তাগণের নামাজের জামায়াতে উপস্থিতির তদারক করতেন। একসময়ে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর গ্রাহক সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে বাস্তব কারণে নামাজের জামায়াত সহ নামাজ শেষে কোরআন ও হাদিসের বিষয়ে দরস কার্যক্রম ক্রমে ভাটা পরা শুরু হয়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর মুখে বলতে শুনেছিলাম ইসলামী ব্যাংকিং এর কাজ জিহাদের মতো। জিহাদের ময়দানে নামাজ দেরিতে পড়লে গুনাহ হয় না। লক্ষ্য করেছি যে, ফরজ নামাজ শেষে সম্মিলিত মুনাজাত করার বিষয়টি বিদআত বলে ইসলামী ব্যাংকে বেশ আগে পরিত্যাগ করা হয়। এখনও ইসলামী ব্যাংকে নামাজের জামায়াত টিকে আছে। আগে নামাজে ইমামতির জন্য কর্মচারী কর্মকর্তাগণের মধ্যে সবচেয়ে ভাল কুরআন পাঠককে খুঁজে বের করা হতো এবং তাদের পোশাক পরিচ্ছদ বাংলাদেশের আলেম সমাজের অনুরূপ হতো। এখন আর সেরকম কড়াকড়ি নেই। হঠাৎ একজন ইসলামী ব্যাংকের কর্মচারী বা কর্মকর্তা যাদের পোশাক আলেম সমাজের মতো নয় তারাও ইমামতি করছেন। তাদের অনেকের কিরআত শুদ্ধ নয়। গ্রাহকগণ যেহেতু সরলপ্রাণ মুসলমান। তারা এ ধরনের ব্যক্তির পিছনে নামাজ পড়ে স্বস্তি পাচ্ছেন না। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইসলামী ব্যাংকের কর্মচারী কর্মকর্তাগণের একটি অংশ সরকারের তরফ থেকে ইসলামী ব্যাংকের দীর্ঘদিন চলে আসা ইসলামী ঐতিহ্য সমূহ ধরে রাখার ক্ষেত্রে ভীতির কথা প্রচার করে। আমার জানামতে ইসলামী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার এক মহান ব্রতকে সামনে রেখে ইসলামী ব্যাংকিং এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। দেশবাসী আশা করেছিল যে, ইসলামী ব্যাংকের কর্মচারী, কর্মকর্তারা হবেন ইসলামী আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তারা ব্যাংকিং সেবাদান কারার পাশাপাশি গ্রাহকদের মাঝে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার বা তুলে ধরবেন। ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ সাড়া দুনিয়ার সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ ইসলামের সুমহান আদর্শের একটা বাস্তব ধারনা বা নির্র্দেশনা লাভ করবে। আমার একথা বিশ্বাস হয় না যে, ইসলামী ব্যাংকের কর্মচারী কর্মকর্তাগণ আন্তরিকভাবে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন সহ প্রতিপালন করেন বা ইসলামের সুমহান বাণী গ্রাহকদের কাছে তুলে ধরেন তাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের বাধা আসবে। এখন কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগে সবচেয়ে মেধার কদর করা হচ্ছে অথচ ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা একটি ইসলামী অর্থব্যবস্থা হওয়ায় মেধার সাথে নৈতিকতা বা ধার্মিকতার বিষয়টি সদাসর্বদা বিচেনায় রাখা উচিৎ। তা না হলে সরকার কর্তৃক পরিচালিত সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, বেসিক ব্যাংক লিমিটেড, সম্প্রতি ফার্মাস ব্যাংক লিমিটেড এর যেভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে সেরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া অসম্ভব নয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ