সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব সন্ধানে নেমেছে দুদক
তোফাজ্জল হোসেন কামাল : নতুন বছরের শুরুতেই দুর্নীতি বিরোধী অভিযান বিগত দিনগুলোর চেয়ে দৃশ্যমান হবে-এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। এ ঘোষণার পরপরই গত তিন সপ্তাহের মধ্যেই দুর্নীতি বিরোধী ওই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কটি পদক্ষেপও নিয়েছে,অভিযানও চালিয়েছে। যার ফলে সাম্প্রতিক কর্মকান্ড নিয়ে দুদক এখন আলোচনায়। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তাদের অভিযানটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
এছাড়া, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব সন্ধানে নেমেছে দুদক। কয়েকটি অধিদপ্তর ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পদবিবরণী পেয়ে তারা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করেছে। এতেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নড়েচড়ে বসেছেন তারা। বিবেকহীনের মতো যে সম্পদ গড়েছেন, তা-ই এখন কারও কারও জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমন অবৈধ অঢেল সম্পদধারী কেউ কেউ দুদকের নোটিস পেয়েছেন। অনেকের জন্যই অপেক্ষা করছে নোটিস। বিপদ বুঝে অনেকে নিজেকে বাঁচানোর মিশনেও নেমেছেন বলে জানা গেছে।
কিন্তু, কোনো তদবিরই এবার কাজে আসছে না। কারণ, টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে কর্মকর্তাদের সাফ জানিয়েছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের নীতি জিরো টলারেন্স। তিনি এও বলেছেন, ‘আমরা যে হারে বেতন বাড়িয়েছি, পৃথিবীর কোনো দেশেই এমনটি নেই। সব চাহিদা আমরা পূরণ করছি, তারপরও কেন দুর্নীতি করতে হবে?’
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এই বার্তা আপনারা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে দিবেন। দুর্নীতি করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যেখানে দুর্নীতি, সেখানেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা।’
এদিকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবার সাঁড়াশি অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ শুরু করেছি। প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, এবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলবে।
রাজধানীতে ৫টি বাড়ি, গাজীপুর ও কুমিল্লায় নিজের ও স্ত্রীর নামে একরের পর একর জমি, শেয়ারবাজারে নামে-বেনামে বিপুল বিনিয়োগের তথ্য পেয়ে সম্পদের ‘কুমির’খ্যাত ঢাকা পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী মো. রমিজ উদ্দিন সরকারকে গত সোমবার সম্পদের বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে দুদক। এর আগে গত ১০ জানুয়ারি দুদক কার্যালয়ে ডেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাব কর্মকর্তা মো. আবজাল হোসেনকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদকের উপ-পরিচালক (ডিডি) সামছুল আলম।
জানা গেছে, আবজাল দম্পতির জ্ঞাত সম্পত্তিকে টাকার অঙ্কে আনতে হিমশিম খাচ্ছেন দুদকের কর্মকর্তারা। এই দম্পতি প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিক। মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে অঢেল সম্পদ এবং স্ত্রীর নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে অর্থ আত্মসাত করেছেন আবজাল।
এই দম্পতি বছরে ২০-২৫ বার বিজনেস ক্লাসে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ৮ জানুয়ারি পুলিশের ইমিগ্রেশন শাখায় চিঠি দেয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত আবজালের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছে।
একইসঙ্গে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারীর অন্যতম হোতা লুৎফর রহমান বাদল ও তার স্ত্রী সোমা আলম রহমানের নামে থাকা সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের করা সম্পদ জব্দ করার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ জানুয়ারি এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৮ মে দুদকের উপ-পরিচালক শেখ আবদুস সালাম বাদী হয়ে আইএফআইসি ব্যাঙ্কের সাবেক পরিচালক লুৎফর রহমান বাদলের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর ঠিক পরদিন ২৯ মে তার স্ত্রী সোমা আলম রহমানের নামে রমনা থানায় মামলা দায়ের হয়। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়।
শুধু ব্যক্তি বা কর্মকর্তা নন, দপ্তর-সংস্থার কাজে গাফিলতি ও দুর্নীতি খুঁজে দেখছে দুদক। জানা গেছে, সোমবার দেশের ৮টি জেলার দুদকের ১০টি টিম আকস্মিকভাবে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে অভিযান চালায়। এ সময় চিকিৎসকদের ৬২ শতাংশ অনুপস্থিতি পেয়েছেন তারা।
এর মধ্যে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অভিযানকালে জরুরি বিভাগের এক কর্মচারী (স্ট্রেচার বিয়ারার) দায়িত্বরত অবস্থায় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণকালে ধরা পড়েন। পরে দুদকের সুপারিশে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
দুদকের এই জাল থেকে সরকারি- বেসরকারি কেউই ছাড় পাবেন না। এমনকি এমপি-মন্ত্রীও না। ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চ মহল থেকে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রীদেরও সাবধান করে বলা হয়েছে, ‘ কেউ নজরদারির বাইরের নন। সতর্ক হয়ে কাজ করবেন।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার সরকারের নতুন মন্ত্রিসভাও। তারা নিজেদের অধীনস্ত সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও বিভাগগুলোকে সেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন।
দুর্র্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলবে- দুদক চেয়ারম্যান
দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবার সাঁড়াশি অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেন, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ শুরু করেছি। প্রতিদিন কাজ করে যাচ্ছি। আমি মনে করি, এবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলবে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে দুদক কার্যলয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান এ মন্তব্য করেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতি নিয়ে সতর্কবার্তা দেওয়ার কিছু নেই। আজও আপনারা দেখেছেন, কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। দুদকের অভিযান স্বাভাবিক অন্যান্য কার্যক্রমের মতোই চলছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির মানে হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের পলানোর আর কোনো জায়গা নেই। দুর্নীতিবাজরা আর কোনো ছাড় পাবে না। পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।
এর আগে, গতকাল মঙ্গলবার আসামীদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ ও অনুসন্ধানের তথ্য ফাঁস করার অভিযোগে দুদকের পরিচালক ফজলুল হককে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘খারাপ কাজ করলে তো বহিষ্কার হবেই। সে তো সদ্য পদোন্নতি পেয়েছে, এরপরও তো কোনো মাফ নেই।’