বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ব্যস্ততা বেড়েছে ছাপাখানায়

মুহাম্মদ নূরে আলম : নির্বাচন মানেই জমজমাট প্রচার। জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে তো কথাই নেই। দিনভর মাইকিং, বড় বড় জনসভা, অলিগলি-সড়ক ছেয়ে ফেলা পোস্টারে- ব্যানারে। আর পোস্টার মানেই ছাপাখানার ব্যস্ততা। আগামী এক মাসেরও বেশি সময় ধরে যে ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সে জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছে ছাপাখানাগুলো। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ছাপাখানাগুলোতে বেড়েছে ব্যস্ততা। নতুন বছরের ক্যালেন্ডার, ডাইরি, পাঠ্যপুস্তক, একুশের বইমেলা উপলক্ষে সৃজনশীল বই ছাপানোর কাজের চাপে এমনিতে ছাপাখানাগুলো ব্যস্ত থাকে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসায় চাপ আরও বেড়েছে। নির্বাচন ঘিরে ইতিমধ্যে একদফা পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন তৈরি করে সাঁটানো কিংবা টানানো হয়েছে। কাগজ, কালিসহ বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করে রেখেছেন। এ সুযোগে বাজারে এসব উপকরণের দামও বেড়ে গেছে। এদিকে প্রেসে মুদ্রিত পোস্টার, ব্যানারের পাশাপাশি এবার ডিজিটাল পোস্টার, ব্যানারও বেশ চলছে। এ কারণে প্রেস মালিকরা ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে এসেছেন। তারা এখন ডিজিটাল ও সাধারণ সব ধরনের কাজই করতে পারছেন। রাজধানীর নয়াবাজার, মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, নীলক্ষেত, আজিমপুরের ছাপাখানাগুলোর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
শুধু পোস্টার ছাপানোই নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু জড়িত। এ প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে ছাপখানাগুলো। পোস্টার বাঁধার সুতলি, কাগজ, প্যাকেট, পলিথিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। ছাপার মেশিনের যন্ত্রাংশ সারাই, এমনকি নতুন ছাপা মেশিনও স্থাপন করেছেন অনেক ব্যবসায়ী। সম্প্রতি রাজধানীর পল্টন, ফকিরাপুল, নীলক্ষেত ও বাংলাবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নিয়মিত কাজের পাশাপাশি ছাপাখানাগুলোয় বিরাজ করছে অন্য আমেজ। আগামী দিনগুলোয় যে তুমুল ব্যস্ততার মৌসুম আসছে, সে জন্য প্রস্তুতিও চলছে সমানতালে। ব্যবসায়ীরা জানায়, শীতের সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, মিটিংসহ নানা ধরনের কাজ বেশি থাকে। বিয়ে ও অন্যান্য উৎসবও এ সময়ে বেশি হয়। এ জন্য নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এমনিতেই বাড়তি চাপে থাকে ছাপাখানাগুলো। এর সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের প্রচারের বিষয়টি যোগ হওয়ায় কর্মব্যস্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে ছাপাখানায়। এখন বই ও নানা ধরনের লিফলেট তৈরির কাজ চলছে। সভা-সমাবেশ, বিয়ে বা জন্মদিনের কার্ডসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের কার্ড বা লিফলেট তৈরির কাজ আগেই করে রাখছে ছাপাখানাগুলো। পাশাপাশি চলছে নির্বাচনী পোস্টার তৈরির চাপ সামলানোর প্রস্তুতি। বর্তমানে সারাদেশে ৭ হাজারের মতো ছাপাখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ছাপাখানাই রয়েছে রাজধানীতে। বছরের শেষদিকে রাজধানীর ছাপাখানাগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই, নতুন বছরের ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি ছাপানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। ফলে নির্বাচনের আগেই এ কাজগুলো সেরে রাখছে তারা। এ ছাড়া বইমেলা উপলক্ষে অর্ডার নিলেও তা জানুয়ারি থেকে ছাপানো হবে বলে জানায় তারা।
নীলক্ষেতের গাউসুল আযম মার্কেটের ব্যবসায়ী আসাদুর রহমান বলেন, নির্বাচনী বছর বলে নতুন প্রিন্টিং মেশিন এনেছি। এবার বিয়ে ও অন্যান্য অর্ডার আগেই নিয়ে ফেলছি। আর বইমেলার অর্ডারগুলো নির্বাচনের পর ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ছাপাখানা মালিকরা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনী অনেক পোস্টার ছাপানো হয়েছে। চূড়ান্ত মনোনয়ন পেলে প্রার্থীদের প্রচারকাজ আরও বৃদ্ধি পাবে। তখন ব্যস্ততাও বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য অন্য কাজ দ্রুত সেরে ফেলা হচ্ছে।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের আগেই মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ব্যানার-পোস্টার ছাপিয়েছে। এখন সাদা-কালো পোস্টারের অর্ডার আসবে। সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় এবার মুদ্রণ খাতে লেনদেন ভালো হবে বলে আশা করছি।
তারা জানান, মনোনয়নের দৌড়ে টিকতে নেতাকর্মীরা আগে থেকেই নিজেদের প্রচারের জন্য এক দফা পোস্টার তৈরি করে প্রচার কার্যক্রম চালিয়েছেন। এখন নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী নেতাদের মনোনয়ন ফরম ক্রয়, জমা ও বাছাইয়ের কাজ চলছে। মানোন্নয়ন প্রক্রিয়া শেষ হলে নির্বাচন কমিশন প্রতীক বরাদ্দ করবে। এরপরই দ্বিতীয় দফা পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন তৈরির নতুন কাজ শুরু হবে। জনসাধারণের কাছে নিজেকে বা নিজের প্রার্থীকে পরিচিত করে তুলতে দুই থেকে তিন মাস আগ থেকেই গ্রাম ও শহরের নেতারা নিজেদের নাম ও ছবি দিয়ে শুভেচ্ছা ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন তৈরি করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টানিয়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে লাগিয়েছেন ছবি সংবলিত স্টিকার। এছাড়া শুভেচ্ছা কার্ড তৈরি করে সেগুলো দিয়েও চলছে প্রচার।
পুরানা পল্টন এলাকার নুরজাহান প্লাজার রনি প্রডাক্টসের মালিক গোলাম সারওয়ার বলেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে পোস্টার তৈরির অর্ডার তত বেশি আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে অনেকে আগাম বুকিং দিয়ে রেখেছেন। দলীয় মনোনয়নপত্র নেয়ার আগে এক দফা পোস্টার বানিয়ে নিয়ে গেছেন নেতাকর্মীরা। তবে নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার পর ও নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর নেতাকর্মীরা নতুন করে পোস্টার অর্ডার করা শুরু করবেন। যেসব নেতা নিশ্চিতভাবে মনোনয়ন পাবেন বলে মনে করছেন, তারা আগেভাগে নির্বাচনী প্রচারের জন্য পোস্টার তৈরির অর্ডার করে গেছেন। সব মিলে নির্বাচন ঘিরে পোস্টার তৈরিতে ছাপাখানায় ব্যস্ততা বাড়তে শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, আমরা মূলত বছরের পুরোটা সময় ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ও বই ছাপার কাজ করি। নির্বাচন বা কোনো দিবসে পোস্টার তৈরির কাজ বেশি আসে। আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ইতিমধ্যে পোস্টার তৈরির জন্য পর্যাপ্ত কাগজ, বিভিন্ন ধরনের রঙ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে রেখেছি। সবকিছু ঠিক থাকলে নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ হলেই পোস্টার ছাপানোর অর্ডার আসতে শুরু করবে।
রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় বাংলাদেশ প্রিন্টার্সের মালিক মোবারক হোসেন বলেন, ফকিরাপুল ও আরামবাগ এলাকার ছাপাখানা ব্যবসায় কয়েক বছর ধরেই মন্দা যাচ্ছে। গত বছর ঈদ ও বৈশাখ ঘিরে কোনো কাজের অর্ডার আসেনি। তবে এবার জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আমরা আশাবাদী। ইতিমধ্যে নেতাদের মনোনয়ন ফরম বাছাই করার আগেই কাজ পেয়েছিলাম। এগুলো শেষ হয়েছে। এবার নতুন করে কাজের অর্ডারের অপেক্ষায় আছি। মনে হচ্ছে এতদিন পর ছাপাখানাগুলোতে কাজের ধুম লেগেছে। একই স্থানের আলিফ প্রিন্টার্সের মালিক রাজু বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে এক প্রকার রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। অস্থির রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে প্রিন্টিং ব্যবসায়। এরপর রাজনৈতিক সংকট কাটলেও রাজনৈতিক কার্যক্রম অনেকটাই থমকে দাঁড়ায়। ফলে রাজনীতিকেন্দ্রিক পোস্টারের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়।
তবে এ বছর জাতীয় নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করায় মনে হচ্ছে ছাপাখানা আবার সচল হবে। ইতিমধ্যে কাজের অর্ডার আসতে শুরু করেছে। এবারের নির্বাচনের বাজার ধরতে আমরাও প্রস্তুত আছি। মনে হচ্ছে সব মিলে ভালো ব্যবসা হবে। আরামবাগ এলাকার এম আর প্রিন্টার্সের মালিক ফারুক বলেন, নির্বাচন ঘিরে এখন পর্যন্ত ৬টি অর্ডার পেয়েছি। ঢাকার বাইরে থেকেও কাজ এসেছে। সব কাজ শেষ করে মাল গ্রাহককে বুঝিয়ে দিয়েছি। এখন নতুন কাজের অপেক্ষায় আছি। সব মিলে এখন বেশ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। ছাপাখানার কর্মীরা বলছেন, এক মাস ধরে কাজের চাপ বেড়েছে। যেখানে এক মাস আগে বিভিন্ন দোকানের ক্যাশমেমো, ভিজিটিং কার্ড বানানোর কাজ করতে হতো, এখন নির্বাচনের জন্য নেতাদের পোস্টার ও স্টিকার বানাতে হচ্ছে। আর নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে কাজ আরও বাড়বে। এতে করে আমরা বাড়তি কিছু টাকা আয় করতে পারব।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ