শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পোড়াবাড়ি

তাসনীম মাহমুদ : কুকুরের বাচ্চা দুটোকে কোলে তুলে নিলো শিমুল। বাচ্চা দুটোর ‘মা’ ওদেরকে পথে ফেলে পালিয়ে গেছে। খাদ্য আর নিরাপত্তার অভাবে চিৎকার করে গলা ফাঁটাচ্ছিল বাচ্চা দুটো। আর যাই হোক  কিছুটা স্বস্তি মিলল ওদের করুণার বশে হলেও একটি মানুষ একটি আশ্রয় পেল ওরা!

শিমুল একাকী মানুষ। থাকে লবণচরা গ্রামের ঐ পোড়াবাড়িতে। বাড়িটি দেখলে মনে হয়, যেন অনেক আগের পুরানো বাড়ি। বাড়িটির সঠিক ইতিহাস গ্রামবাসীর অজানা । অনেকের ধারণা ওটা অভিশপ্ত একটি বাড়ি; ওখানে প্রেতাত্মারা বাস করে। ভগ্নদশা বাড়িটির চারপাশ বন-জঙ্গলে ভরা। ডাকের মাথায় অন্য কোন বাড়িও নেই; যেন শুন্য-বিরাণ।

বাড়িটিতে কোনো মানুষ বাস করতে পারে একথা বিশ্বাস করা দায়। ফলে গ্রামের কেউ ও বাড়ির পথও মাড়ায় না। এমন একটি বাড়িতে শিমুল যে কিভাবে থাকে এই নিয়েই গ্রামের মানুষের মনে নানান গুঞ্জন-প্রশ্ন। অনেকে মনে করে প্রেতাত্মাদের সাথে শিমুলের কোনো সম্পর্ক আছে। আবার কেউ কেউ মনে করে শিমুল নিজেই মানুষের আকারে সাক্ষাত প্রেতাত্মা? সবাই কেমন যেন ওকে এড়িয়ে চলতে চায়। শিমুলও ওদের মনোভাব বোঝে। একাকী ভাবে, নিররুপায় নিঃস্ব-সম্বলহীন আমি এই বাড়ি ছেড়ে আর কোথায় যাবো। বাড়িটিতে এখন শিমুল একা নয়; কুকুর দুটোও ’ওর’ সঙ্গী। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে ও খেলা করে; বাচ্চা দুটোও ওর পিছু ছাড়ে না। নিজ সন্তানের মতো বাচ্চা দুটোকে পালতে থাকে শিমুল। কুকুর দুটোর নামও রাখে। একটার নাম ‘ভুলু’ আর একটা ‘ভুতু’। ভুলুর গায়ের রঙ সাদা-কালো, বাসের মতো শরীর হয়ে উঠেছে ‘ওর’। আর ভুতুর গায়ের রঙ লাল-সাদা ,সিংহের মতো বুকের পাটা। শিমুলকে ‘ওরা’ দুইজন ভালোবসে। কেমন যেন শিমুলের জন্যই ওদের জীবন-মরণ;ওই ওদের ‘বাবা-মা’। এভাবে একই ঘরের বাসিন্দা হয়ে ওরা বসবাস করতে থাকে।

শিমুলের আর একটা নিরব-নিত্য সঙ্গী একটি বেহালা। রাত গভীর হলে ‘ও ’ ঐ বেহালায় সুর তোলে। বেহালার সুর বাড়িটি থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে আকাশে-বাতাসে মিলিয়ে যায়। সে সুরের যেন থাকে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার মতো চোখের জল, দুঃখ! গ্রামবাসীর অনেকে তখন ভাবতে থাকে, ঐ বুঝি প্রেতাত্মা ভর করেছে শিমুলের উপর। সবাই কেমন ভয় পেতে থাকে কানাকানি করে। গ্রামবাসী আরো ভাবে, ভুলু-ভুতু দুটোও কুকুরের বেশে নিশ্চিত প্রেতাত্মা! নয়তো শিমুলের সাথে থাকবে কেন? গ্রামবাসীর মধ্যে একটা ভাবনাই তেজ দিতে থাকে, যেমন করেই হোক ঐ অভিশপ্ত পোড়াবাড়ির তিন প্রেতাত্মাকে শেষ করে দিতে হবে। না হয় পাছে গ্রামের কারো অনিষ্ট করে বসে ‘ওরা’।

দিনটি ছিল সোমবারের সকাল। শিমুল কুকুর দুটোকে নিয়ে বের হয় পোড়াবাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে কুমকুম বাজারের দিকে। এদিকে গ্রামের কিছু লোক ঠিক করে শিমুলকে শায়েস্তা করবে। শিমুলরা যখন বাজারের কাছে পৌঁছাল লোকগুলো তখন লাঠি-সোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওদের উপর। মনিবের উপর আক্রমণ দেখে ভুলু-ভুতুও হুংকার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকগুলোর উপর। ভুল-ভুতর ভয়ে ওরা পালিয়ে গেল। টলতে টলতে বাড়িটিতে ফিরে এলো আহত শিমুল আর কুকুর দুটো। ভুলু-ভুতুর কপালে খাবার জোটেনি আজ তবু ‘ওরা’ নিরব। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ব্যথায় কাঁতরাচ্ছে শিমুল। ভুলু-ভুতু মুখ কালো করে বসে আছে পাশে। এদিকে ঘরে খাবার বলতে গতরাতের এক বাসন পান্তা মাত্র! এমন সময় পোড়াবাড়ির বারান্দায় এক ভিখারীর কন্ঠ শোনা গেল -‘বাবা’। ঘরে কেউ আছেন; সারাদিন পেটে কোন দানাপানি পড়েনি, কিছু খেতে দেবেন ‘বাবা’? ভিখারীর ডাকে সাড়া দিয়ে কাঁতরাতে কাঁতরাতে ঘর থেকে বের হয়ে এলো শিমুল । ভিখারীকে দেখে ‘ওর’ বেশ মায়া হল। বললো-ভিখারী বাবা’। আমার ঘরে এক বাসন পান্তা ছাড়া আর কিছু নেই, তাছাড়া আমি অসুস্থ। সারাদিন নিজের ভগ্যেও কিছু জোটেনি। ভিখারী বললো-ঐ পান্তাগুলোই আমাকে খেতে দিন ‘বাবা’। আল্ল¬াহ আপনার ভালো করবেন। শিমুল পান্তার বাসনটি ভিখারীর সামনে এনে দিল। পান্তা শেষ করে ভিখারী শিমুলকে জিজ্ঞাসা করলো-‘বাবা’ আপনার কি অসুখ করেছে? শিমুল সকালের ঘটনাটি ভিখারীকে বললো । সব কথা শুনে ভিখারী তার কাঁধে ঝোলান জীর্ণ থলে থেকে স্টিলের একটা গ্ল¬াস আর একটা সাদা গামছা বের করল। ভিখারী গ্লা¬াসটিতে পানি নিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন পড়ে ঐ পানিতে ‘ফুঁ’ দিয়ে পানিটুকু শিমুলকে এক নি:শ্বাসে খেয়ে ফেলতে বললো। শিমুল পানিটুকু খেয়ে ফেলল। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে ‘ওর’ গায়ের ব্যথা সেরে গেল। ব্যাপারটা কেমন ভেলকিবাজির মতো মনে হল শিমুলের । ভিখারীর চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। এরপর ভিখারী গামছাটা হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে আবার বিড়বিড় করে কি যেন পড়ে গামছাটাতে ‘ফুঁ’ দিল। চোখ মেলে গামছাটা শিমুলের হাতে দিয়ে বললো-নেন ‘বাবা’! এই গামছাটা সব সময় কাছে রাখবেন আল্লাহর ইচ্ছায় কেউ আপনার ক্ষতি করতে পারবে না। কথা শেষ করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ভিখারীর অবয়ব। ভোরের পাখি ডেকে উঠল শিমুল টের পেল সকাল হয়ে গেছে। ভিখারীর গামছাটা ওর হাতে আর কথাগুলো কানে বাজছে। এরপর থেকে গামছা ছাড়া ‘ও’ কখনো বাইরে বের হতো না। শিমুল বুঝতে পারলো গ্রামের লোকগুলো কেমন যেন স্বাভাবিক আচরণ করছে ‘ওর’ সাথে। নিত্য কাজ করবে সুযোগ পেয়ে দিনে দিনে শিমুলের দৈন্য ও দূর হয়ে গেল। এখন শিমুল স্বাবলম্বী।

ভুলু-ভুতুর গলায় ঝুলছে দামী চামড়ার বেল্ট। সবকিছুর মধ্যে মাঝরাতে বেহালায় সুর তুলতে শিমুল, কখনো কিন্তু ভোলে না। বেহালার সুর ‘ওকে’ নিয়ে যায় কোথায় কোন নির্জন-একাকিত্বে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন এভাবে কেঁটে গেল। স্বাচ্ছন্দ্যের শিমুল পুরনো পোশাকের গন্ধ ভুলে যাওয়ার মতো ভুলে গেল ভিখারীর কথা-ভুলে গেল গামছার কথা । সবকিছু বদলালেও ঐ পোড়াবাড়িতে থাকা সে বদল করেনি। কেবল দিন দিন বাড়িটি আরো ভঙ্গুর হয়েছে যা।

হেমন্তের এক বিকেল। রোজ দিনের মতো এদিনও শিমুল কুকুর দুটোকে নিয়ে বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে নাজ নদীর পাড় ধরে হাঁটছে। হঠাৎ শিমুল শুনতে পেল, কে যেন ওকে বলছে ‘শিমুল ’ পালা । পিছনে ফিরতেই ‘ও ’ দ্যাখে লবণচরা গ্রামের লোকগুলো হই-হই রবে ধেয়ে আসছে ওর-ই দিকে। ওদের কারো হাতে লাঠি কারো হাতে ছুরি-দা, কারো হতে সড়কি।

ডুবতে থাকা প্রাণের চোখে ঝাপসা স্মৃতির মতো শিমুলের মনে ভেসে উঠলো  ভিখারীর কথা-গামছার কথা। শিমুল ভুলু-ভুতু ঊর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। পিছু নিয়েছে প্রেতাত্মা ধ্বংসের নেশায় উম্মুখ গ্রামবাসী। বাড়িতে  ঢুকে শিমুল পাগলের মতো গামছাটা খুঁজতে থাকে। গ্রামবাসীও ঢুকে পড়ল বাড়ির মধ্যে। শুরু হলো প্রেতাত্মার সাথে মনুষ্যের তুমুল যুদ্ধ। সড়কির ফলা ভুলুর বাঘ্্র গর্জনকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিলে ভুতু ওর সিংহল পাটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো গ্রামবাসীর উপর । কিন্তু ক্ষত-বিক্ষত ভুতু নিরবে পরাজয় মেনে নিয়ে দৌড়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। ভুলুর নিশ্চল দেহ দেখে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে শিমুল । ভুলু-ভুতুকে মারার পর প্রেতাত্মা ধ্বংসের নেশা চরমে উঠলো গ্রামবাসীর। জীবন বাঁচাতে শিমুল পোড়াবাড়ির সবচেয়ে ভঙ্গুর ঘরটিতে ছুটে গেল। খুঁজে পেল গামছাটা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে গামছাটা হাতে নিতেই দা’এর কোপ এসে পড়ল ‘ওর’ দু’হাতে । এরপর ছুরি সড়কির একের পর এক আঘাত। গগন বিদারী চিৎকার খান খান করে বিদীর্ণ করলো পোড়াবাড়ির চির নিস্তব্ধতা। অভিশপ্ত বাড়িটিকে ধিক্কার দিতে দিতে প্রেতাত্মা ধ্বংসের জয়োধ্বনি তুলে গ্রামবাসী বের হয়ে গেল ভূতুড়ে বাড়ি থেকে। সবকিছুই নিরব নিস্তব্ধ। আঁতরে ডুবে যাওয়ার ঠিক এক মুহূর্তে আগে শিমুলের মনে পড়ে ভুলু-ভুতু আর ভিখারীর চেহারা । বেহালার সুরে সুরে ডুবে গেল শিমুল। সকালে কেউ একজন বলল- একটা লাল-সাদা রঙের কুকুর গতকাল সন্ধ্যয় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মরেছে।

কিছুদিন পর এক রাতের কথা। গভীর রাত-জোছনা ভরা পূর্ণিমা। চারিদিকে নিরব-নিস্তব্ধতা। এমন সময় গ্রামবাসী শুনতে পেলো বেহালার সেই সুর। সুরটা যেন কেঁদে কেঁদে বলছে সেই সন্ধ্যায় ধ্বংস হওয়া প্রেতাত্মাদের কথা। গ্রামের কেউ কেউ দাবী করে ঐ বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখেছে। আরো নাকি শুনেছে কারা যেন ঐ বাড়িতে জোরে জোরে সুর করে কাঁদে। প্রেতাত্মাদের ভয় গ্রামবাসীর মনে কাল-কেউটের বিষের মতো বাসা বেঁধে বসলো। দীর্ঘ কয়েক যুগ পরে এসে এখনো জানা যায় পোড়াবাড়িটি তেমনি আছে। আছে গ্রামবাসীর প্রেতাত্মার ভয়। ভয়ে গ্রামের কেউ নাকি ঐ বাড়ির আশপাশের মাটিও মাড়ায় না।  

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ