বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

জলরাশি ও সবুজের আলপনায় অপরূপ চলনবিল

শাহজাহান তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) থেকে : সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর এই তিনটি জেলার প্রায় নয়টি উপজেলায় বিস্তৃত ছোট বড় অনেক বিস্তৃত ডোবা খাল জলাশয় নিয়ে চলনবিল গঠিত। বর্ষাকালে যে দিকে চোখ যায় শুধুই জলরাশি। জলরাশি জুড়ে ঢেউয়ের খেলা। আবার শুস্ক মৌসুমে দিগন্ত রেখায় সবুজের আলপনা। চলনবিল প্রাণ ফিরে পায় বর্ষাকালে। তাই ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য এই মৌসুমে চলনবিল হতে পারে উপযুক্ত গন্তব্য। সিরাজগঞ্জের তাড়াশের আশ-পাশে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী,খালবিল। এসবই বয়ে গেছে চলনবিলের উপর দিয়ে। বর্ষায় চলনবিলে যেন জলে থৈই-থৈই চারিদিকে পালতোলা নৌকা চলেছে। দেখতে অসাধারণ এক দৃশ্য। আকাশ কখনো মেঘলা কখনো সাদা রং ধারণ করে। আত্রাই, গুড় নদী, বরনাই নদী, বড়াল নদী, তুলসী নদী, চেচুয়া নদী, ভাদাই নদী, গুমানী নদী এসব নদীগুলো বয়ে গেছে চলনবিলের ওপর দিয়ে। মেঘ গর্জন করলেই-অঝর ধারায় নেমে পড়ে বর্ষনধারা। এমনই এক ঐতিহাসিক চলনবিল, যা বাংলাদেশের বড় বিলগুলোর মধ্যে একটি। এর ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমানা বিশাল।
দেশ বিদেশে পরিচিত এই বিলকে পর্যটকদের জন্য মোটেল সুবিধাসহ কয়েকটি দর্শনীয় স্পটকে অবকাঠামো উন্নয়ন করলেই এটি দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকায় পরিনত হবে বলে মনে করছেন চলনবিলবাসি। সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, নাটোর জেলার সিংড়া, গুরুদাসপুর, ও পাবনা জেলার বনয়ারীনগর ফরিদপুর, চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলা মিলে গঠিত চলনবিল প্রায় ১২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের। বিল এখন অনেক ছোট হয়ে এসেছে বলে জানা গেছে। এখানে পর্যটকদের আকর্ষন করার মতো প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বহু প্রাতœতাত্বিক এতিহাসিক স্থানও রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে, তাড়াশে দর্শনীয় স্থানগুলোর অন্যতম আকর্ষন হলো-রাধা গোবিন্দ মন্দির, শিব মন্দির, মথুরাদিঘী, বড় কুঞ্জবন, উলিপুরের দিঘী, শিশু পার্ক, বৌদ্ধ বিহার। এ সব ঘুরে ঘুরে দেখতে খুব ভাল লাগবে। শরতের শেষের দিকে শুরু হয় দুর্গাপুজা। তখনতো এখানকার গোবিন্দ মন্দিরে বাজে অবিরাম ঢোল-বাদ্য, আকাশে ওরে রঙ্গিন ফানুষ। কীর্তন গানে মূখরীত পুরো এলাকার আকাশ-বাতাস। আর তাড়াশে চারিদিকে ফুটে থাকে কত না কাশফুল। তাড়াশে বিখ্যাত কপ্লিশ্বের শীব মন্দির, দেবী মন্দির, বাসুদেব ও গোপীনাথ বিগ্রহের মন্দির এর কাহিনী। তাড়াশের রাজ বংশের পুর্ব পুরুষ বলরাম প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি মন্দির, থানা রোডে কুঞ্জবন নামক সর্ববৃহৎ জলাশয় ও তাড়াশের রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন কীর্তিও নির্দশন। তাড়াশে ভগ্নপ্রায় জোরবাঙ্গালার গায়ে ১৬৬১ খিষ্টাব্দের খোদিত লিপি থেকে জানা যায়, এখানকার গোপীনাথ বিগ্রহের সেবায়েত ছিলেন নাগবংশীয় কায়স্থ। এই তাড়াশের বিনোদ রায়, গোবীন্দজী, রশিক রায়,কপিলেশ্বর শিব প্রভৃতি যে কয়েকটি বিগ্রহের মন্দির রয়েছে, এর মধ্যে কপিলেশ্বর ও গোবিন্দ মন্দির অন্যতম। আর এ সব দেখতে দেখতেই এক নিমিষেই ফিরে যাবেন অতীত যুগে। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠবে হয়তোবা পুজা পার্বণের সেই পুরোনো দিনগুলোর কথা। দেখবেন এখানকার প্রতিটি মন্দিরের গায়ে রয়েছে অপরূপ কারুকাজ। প্রাচীনকালে ক্ষুদ্র ইট দিয়ে এসব মন্দির তৈরি হয়েছিল।
তাড়াশ উপজেলার বারুহাঁস ইউনিয়নের বিনসাড়ায় বেহুলা লক্ষীনদারের জিয়ন্তকুপ ও পিতা বাছিয়া বানিয়া সওদাগারের বাড়ি, উপজেলা সদরে রায় বাহাদুরের স্মৃতি বিজরিত বাড়ী, নওগাঁয়ে তাপস শ্রেষ্ঠ ওলিয়ে কামেল শাহ শরীফ জিন্দানী (রহঃ) এর মাজার শরীফ।
অপরদিকে, চাটমোহরের শীতলাইয়ের জমিদার বাড়ী, সদরে শাহী মসজিদ, গুরুদাসপুর উপজেলার চলনবিল জাদুঘর, সিংড়ার পেট্রোবাংলা, তিসিখালী মাজারসহ রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান।দেশের উৎপাদিত মাছের অন্যতম প্রধান উৎস সিরাজগঞ্জের চলনবিলাঞ্চল। কিন্তু প্রতি বছর কমছে এ অঞ্চলে মাছের উৎপাদন, বিলুপ্ত হচ্ছে মাছের প্রজাতি। মাছে ভাতে বাঙালি বাংলার চিরায়ত প্রবাদ। কিন্তু মানুষের নানামুখী হস্তক্ষেপের কারণে ইদানীং কমতে শুরু করেছে মাছের উৎস। একই সঙ্গে হুমকির মুখে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। কিছু মাছ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সম্পূর্ণরূপে। বিলুপ্তির পথে এমন মাছের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মানসম্মত পোনার অভাব, বিল এলাকায় প্রাকৃতিক জলাভূমির পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া, ফসলি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার এবং ডিমওয়ালা মাছ ধরা প্রভৃতি কারণে বিলুপ্ত হয়েছে দেশী প্রজাতির ২৫ রকমের মাছ।
তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান জানান, জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্পের আওতায় মৎস্য চাষিদের প্রশিক্ষণ, নার্সারি স্থাপন, জাল ও পিলেট মেশিন প্রদান, পানি পরীক্ষা, পরামর্শ ও মাঠ দিবসের আয়োজন করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এলাকার জনগণের জীবিকা নির্বাহ নিশ্চিতকরণ প্রকল্পের আওতায় অভয়াশ্রম স্থাপন, পোনা অবমুক্তি, বিকল্প আয়বর্ধক কর্মসূচি, জলাশয় পুনর্খনন, সমিতি গঠন ও তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ব্যবস্থা করা হয়।
এদিকে চলনবিলের শুঁটকি মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। স্থানীয় বাজারে সৃষ্টি, শুঁটকি সংরক্ষণাগার তৈরী আর সেই সাথে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতিতে এই শুঁটকি তৈরী করতে পারলে তা বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে। মৎস্য সম্পদে ভরপুর চলনবিল এলাকার মৎস্যজীবীদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে শুঁটকি তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করে। চলনবিলের মাছ স্বাদ যুক্ত হওয়ায় এ মাছের শুঁটকির চাহিদাও বেশী। বছরের ৬ মাস টেংরা, পুটি, চান্দা, চিংড়ী, গুচিসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ শুকিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে তারা।
চলনবিল এলাকার বসবাসরত প্রবীন ব্যাক্তি আব্দুল মজিদ জানান, বর্ষাকালে যেদিকে চোখ যায় শুধুই পানি আর পানি। চলনবিল জুড়ে শুরু হয় ঢেউয়ের খেলা। আবার শুস্ক মৌসুমে মাঠভরা সবুুজ আর সবুজ। গোলাভরা ধান। তিনি জানান, বর্তমানে দেশীয় প্রজাতির কিছু মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো চোখে পড়ছে না। তাড়াশ উপজেলা যুব মহিলালীগের সভাপতি শায়লা পারভীন জানান, চলনবিলকে রক্ষার জন্য এবং ভিতর প্রবাহমান ১০-১২টি নদনদীসমুহের সংস্কার ও গতিপথ বন্ধ করে অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ, পর্যটন কর্পোরেশনের আওতায় এনে পর্যটকদের প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদান করা জোর দাবী জানাচ্ছি।
মাগুড়া বিনোদ ইউপির চেয়ারম্যান প্রভাষক এম আতিকুল ইসলাম বুলবুল জানান, চলনবিলের মধ্য দিয়ে এখন মহাসড়ক হওয়ায় নৌকা চলাচল অনেকটা কমে গিয়েছে। চলনবিলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণারত শিক্ষক গবেষকদের আসতে দেখলেও এর পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য কাউকে আসতে দেখলাম না। তিনি আরো জানান, সরকার ইচ্ছা করলেই এটিকে পর্যটন উপযোগী করে দেশের ঐতিহ্যবাহী সম্পদকে রক্ষা করতে পারে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ