শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

টেকসই উন্নয়নের কৌশলপত্র

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশকে অবিবেচ্য রেখে একটি সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। এই দুয়ের যথাযথ সমন্বয় সাধানের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ সংরক্ষণ করে যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা যায় তাকে টেকশই উন্নয়ন বলে। বিষয়ে গুরুত্ব বিবেচনায় জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (২০১৫-২০৩০) প্রণয়ন করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশলপত্র (২০১০-২০২১) প্রণয়ন করেছে। এই অধ্যয়নের মূল লক্ষ্য জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত টেকসই উন্নয়ন কৌশলের বিশ্লেষণ এবং এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা। গবেষণাকর্মটি থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ইসলামে টেকসই উন্নয়ন ব্যাপক অর্থবোধক ও বিস্তৃত এবং তা নৈতিক দিকসহ আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত দিকগুলোর অন্তর্ভুক্ত করে। এ কারণেই একে পশ্চিমা উন্নয়ন মডেলের বৈশিষ্ট্য থেকে সহজেই পৃথক করা যায়। পুঁজিবাদী সমাজ শুধু মুনাফাকামিতা ও বস্তুগত চাহিদা পূরণকেই টেকসই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে, কিন্তু ইসলাম গঠনমূলক উৎপাদানের পাশাপাশি মানবীয় মূল্যবোধ রক্ষা করাকে ও টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশ ব্যতীত মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা  করা যায় না। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ও মানুষ পরিবেশের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারেনি। বিগত শতকের শুরুতে মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, পরিবেশ যতই দূষিত হোক না কেন প্রকৃতির নিয়মে তা আবার পরিশোধিত হবে। বিংশ শতকের ৬০-৭০ এর দশকে পরিবেশের দূষন নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে,পরবর্তীতে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে,পরিবেশ তাঁর নিজস্ব নিয়মে পরিশোধন হতে অক্ষম, মানুষকেই পরিবেশ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে। ২০১৫ সালে শেষ হতে যাওয়া সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অগ্রগতির ধারা আরো বেগবান করার অভিপ্রায়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭০ তম অধিবেশনে গৃহীত হয়েছে ১৫ বছর মেয়াদি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশল পত্র (২০১০-২০২১) প্রণয়ন করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে উন্নয়ন শুধু বস্তুগত বিষয় নয় বরং নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করে।
টেকসই উন্নয়ন একটি সামাজিক পরিভাষা। স্থিতিশীল উন্নয়ন বা উন্নয়নের স্থিতিশীলতা উভয় ক্ষেত্রে শব্দটির প্রয়োগ করা হয়। এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Sustainable Development এবং আরবী প্রতিশব্দ আত্তানইনয়্যাতুল মুস্তাদালাহ। পরিবেশকে ভিত্তি করে সংঘটিত আর্থ সামাজিক উন্নয়নই হলো টেকসই উন্নয়ন। অর্থ্যাৎ উন্নয়ন গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হলো টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়ন বলতে শুধু ভবিষ্য প্রজন্মের চাহিদা পূরণের জন্য বর্তমান প্রজন্মের ভোগ সীমিতকরণকেই বোঝায় না, বরং এটি সংখ্যালঘিষ্ঠের অটেকসই ভোগের কারণে বর্তমান প্রজন্মের অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের প্রক্রিয়া যেন বাধাগ্রস্থ না হয় তা ও নিশ্চিত করে। অতএব টেকসই উন্নয়নের আরেকটি মাত্রা হচ্ছে আন্তপ্রজন্মগত সমতা। অন্যকথায়, টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সমবন্টন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে: টেকসই উন্নয়ন মূলত একটি প্রক্রিয়া, যা দ্বারা জনগণ তাদের চাহিদা মেটায়, তাদের বর্তমান জীবন যাত্রার মানের উন্নতি ঘটায় এবং সেই সাথে ভবিষৎ প্রজন্ম যাতে তাদের আপন চাহিদা পূরণ করতে পারে তাদের সেই সামর্থ্যরে সুরক্ষা করে। আর.ই.মুন টেকসই উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলেন: The meaning of development is sustainable Development refers to play quality enhancement of human and other spheres by achieving their basis needs. Clearly the concept of development here has a more comprehensive meaning than economic growth.
টেকসই উন্নয়নে উন্নয়নের পরিভাষাটি মানব জাতির মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে তাদের জীবন মান ও অন্যান্য সূচকের বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে। বস্তুত এখানে উন্নয়নের ধারণাটিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চেয়ে ব্যাপক অর্থবোধক। মানুষের বাঁচার ন্যূনতম প্রয়োজন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, পানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রয়োজন মিটানো এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করা; জনসংখ্যাকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ধরে রাখা; আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি পুনবন্টনের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ; খনিজ সম্পদের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে তার আবর্তনের উপর জোর দেয়া; প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের মাধ্যমে ভোগ; পানি ও বায়ূ দূষন নিয়ন্ত্রণে রাখা; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার উপর জোর দেয়া; গ্রাম উন্নয়নের উপর জোর দেয়া, যাতে গ্রামের লোকেরা শহরের দিকে না আসে; সুষম ভূমি ব্যবহার এবং তা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় আনা; শক্তি তথা এনার্জির ক্ষেত্রে পুনর্নবায়নযোগ্য উৎসের উপর নির্ভর করা। অতএব বলা যায়, পরিবেশকে ভিত্তি করে সংঘটিত আর্থ সামাজিক উন্নয়নই হলো টেকসই উন্নয়ন। অর্থ্যাৎ পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে সংঘটিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অর্জিত হয়। যার লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, যেখানে প্রতিটি মানুষ উন্নয়নে অবদান রাখার ও এর সুফল ভোগের সুযোগ লাভ করে এব একই সময়ে তারা প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমের সুরক্ষা সহ সংরক্ষণ করে থাকে।
টেকসই উন্নয়ন মুলত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজি’র মতো জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত একটি উন্নয়ন পরিক্রমা, যা ২০১৫ সালের পর এমডিজি-র স্থলে প্রতিস্থাপিত হয়। ৩-১৪ জুন ১৯৯২ ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০-২২ জুন ২০১২ অনুষ্ঠিত হয়। রিও+২০ (Rio+20) বা আর্থ সামিট ২০১২ (Earth Summit 2012) সম্মেলন, যার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল বিশ্ব টেকসই উন্নয়ন সম্মেলন বা World Sustainable Development Conferences (WSDC) এ সম্মেলনে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা Sustainable Development Goals (SDGs) গ্রহন করা হয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক কনফারেন্স-এ (রিও+২০) ৭৯ জন সরকার প্রধানসহ ১৯১ টি জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র অংশগ্রহণ করে। কনফারেন্স এর ফলাফল সংবলিত দলিল ‘দি ফিউচার উই ওয়ান্ট’ এ টেকসই উন্নয়নের রুপরেখা তুলে ধরা হয় এবং কীভাবে তা অর্জন করা যায় সে বিষয়েও আলোকপাত করা হয়। ১ জানুয়ারী ২০১৬ থেকে বাস্তবায়ন শুরু হওয়া এসডিজি (SDGS) র লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২০৩০ সাল। ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য পুরোপুরি দূর করা এবং এবং বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নতুন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের খসড়া রোডম্যাপ ২ আগষ্ট ২০১৫ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। জাতিসংঘের ১৯৩ টি সদস্য দেশ দীর্ঘ তিন বছরের আলোচনা পর্যালোচনা শেষে ১৭টি লক্ষ্য সামনে রেখে ৩০ পৃষ্ঠার এ খসড়া গ্রহণ করে। এর নামকরণ করা হয় Transforming our World: The 2030 Agenda for Sustainable Development. ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত টেকসই উন্নয়ন শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের শীর্ষ নেতারা চরম দারিদ্র্যমুক্ত পরিবেশ সুরক্ষিত ও নিরাপদে বসবাসে উপযোগী বিশ্ব তৈরির উপরিউক্ত এজেন্ডা চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করে। ২০৩০ লক্ষভেদী টেকসই উন্নয়নের রোডম্যাপ প্রধান লক্ষ্য ১৭টি: সূচক ৪৭টি ও সহযোগী লক্ষ্য ১৬৯টি। বেকারত্বের মতো দিকগুলো থেকে সমাজের প্রত্যেকের সুরক্ষা, সকলের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। মৌলিক সেবাসমূহ তথা শ্রম, ভূমি প্রযুক্তিতে স্বল্প পুঁজির লোকদের সম সুযোগ নিশ্চিতকরনে এবং তাদের আর্থিক সচ্ছলতার জন্য যেসব সামাজিক নীতিমালা সহায়তা করে সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বন্টন নিশ্চিত করা। প্রতিটি শিশুর স্বাস্থ্যকরভাবে বেড়ে উঠার জন্য পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তা, ক্ষুধা দূর করা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পুষ্টি বাড়ানো এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচলন। সব বয়সী মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনমান নিশ্চিত করা এবং মরণঘাতী রোগ থেকে মুক্তা থাকা। সবার জন্য ন্যায্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সকলের জন্য সব বয়সে শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা। লিঙ্গসমতা অর্জন এবং সব নারী ও বালিকার ক্ষমতায়ন করা। সবার জন্য পানি ও পয়ঃব্যবস্থার প্রাপ্যতা ও তার টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। সবার জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও আধুনিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণকালীন ও উৎপাদনশীল এবং যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সবার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পূর্ণকালীন ও উৎপাদনশীল এবং যথোপযুক্ত কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করা। অবকাঠামো নির্মাণ, সবার জন্য ও টেকসই শিল্পায়ন গড়ে তোলা এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা। দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তদেশীয় বৈষম্য হ্রাস করা, বিশেষ করে দ্রুত ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নতির সুফল ভোগের জন্য দরিদ্রদের সহায়তায় প্রদান করা। নগর ও মানব বসতির স্থানগুলো সবার জন্য, নিরাপদ, দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই হয়। টেকসই ভোগ ও উৎপাদন ব্যবস্থা প্যার্টান নিশ্চিত হবে। জলবায়ূ পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য সাগর, মহাসাগর ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষন ও পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা। ভূপৃষ্টের জীবন পৃথিবীর ইকোসিস্টেম সুরক্ষা পূর্ণবহাল করা এবং এর টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা, টেকসইভাবে বন ব্যবস্থাপনা করা, মরুকরণ রোধ, ভূমি ক্ষয়রোধ করা এবং জীব বৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন বন্ধ করা। টেকসই উন্নয়নের জন্য শন্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তি মুলক সমাজ প্রতিষ্ঠাকরা, সবার ন্যায়বিচারের সুযোগ নিশ্চিত করা এবং  সর্বস্থরে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলা। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অংশীদারিত্ব বাস্তবায়ন কৌশল গুলো আরো কার্যকর করা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব পূনর্জাগরিত করা।
২৬ ফ্রেব্রুয়ারী ২০১৩ জাতীয় অথ্যনৈতিক পরিষদের (NEC) এক সভায় টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিবেশ নিরাপত্তা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্রথমবারে মতো ১০ বছর মেয়াদি জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশলপত্র (National Sustainable Development Strategy-NSDS) নামের একটি উন্নয়ন দলিল অনুমোদন দেয়া হয়। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অবস্থিত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব সদস্য এ ধরণের টেকসই উন্নয়ন কৌশল অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এ কৌশল গ্রহণ করেছে। এ কৌশলপত্রের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১০-২০২১ সাল পর্যন্ত। দেশের উন্নয়ন যাতে স্থিতিশীল হয় সে জন্য এ কৌশলপত্র একটি রোডম্যাপ। কৌশলপত্রের মূল লক্ষ্য টেসকই উন্নয়ন। এতে দেশের সব খাতের সুষম উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
উৎপাদনশীল সম্পদের দীর্ঘস্থায়ী টেকসহিতা চ্যালেঞ্জার সমাধানসহ কৌশলপত্রে বিবৃত রুপকল্প অর্জনের জন্য এন এসডিএস (২০১০-২০২১) তিনটি পারস্পরিকভাবে সম্পৃক্ত ক্ষেত্রসহ পাঁচটি কৌশলগত অগ্রাধিকার ক্ষেত্র চিহ্নিত করে। কৌশলগত অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ক্ষেত্রগুলোতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অব্যহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অগ্রাধিকার মূলক খতগুলোর উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। যে তিনটি পারস্পরিকভাবে যুক্ত বিষয়াবলি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এলাকাগুলো টেকসই উন্নয়নে সহায়তা দান করবে সেগুলো হলো, দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, ও জলাবায়ূ, সুশাসন এবং জেন্ডার। কৌশলগত বাস্তবায়নের অগ্রগতি পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নের জন্য শীর্ষ সংস্থা হিসেবে কাজ করবে টেকসই উন্নয়ন পরিবীক্ষণ পরিষদ (এসডিএমসি)।
পরিবেশগত টেকসহিত্বের প্রশ্নে কোন আপস ছাড়াই মধ্যম আয়ের মর্যাদায় অর্থনীতির রুপান্তরসহ উন্নতর জীবন মান দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন ও কর্মসৃজন নিশ্চিত করার জন্য ত্বরান্বিত প্রবৃদ্ধিতে প্রধান উন্নয়ন কৌশল হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। অবকাঠামো কর্মসূচি, মানব সম্পদ উন্নয়ন, গবেষনা ও উন্নযন এবং তথ্য প্রযুুক্তিতে সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে এবং বিনিয়োগ প্রণোদনা বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নসহ পিপিপি প্রবর্ধনে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে, শিক্ষা ও দক্ষতা শিক্ষণের মানসহ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বৈদেশিক কর্ম সংস্থানের প্রসার, জাতীয় ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং সবুজ প্রবৃদ্ধি প্রবর্ধনের মাধ্যমে অব্যাহত ও ত্বরান্বিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।
দেশের টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারমূলক খাতসমূহের মধ্যে রয়েছে, কৃষি শিল্প, জ্বালানি, পরিবহন ও মানব সম্পদ উন্নয়ন। এ খাতগুলোর জন্য সুপারিশকৃত কৌশল অর্থনীতিকে সঠিক নির্দেশনা দানের উপর জোর দেয়া হয়েছে, কেননা এ খাতগুলোই আগামীতে সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি থাকবে এবং দেশের টেসকই উন্নয়নে সহায়তা করবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে যেহেতু দ্রুত নগরায়ণ অপ্রতিরোধ্য, সুতরাং টেকসই নগর উন্নয়নের ওপর নানাদিক থেকেই দেশের টেকসই উন্নয়ন নির্ভরশীল। এই অংশে নগরাঞ্চলের টেকসই উন্নয়নে পাঁচটি প্রধান বিষয়ে সমাধান অন্বেষন করা হয়েছে। সেগুলো হলো, নগর, গৃহায়ন, পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন, দূষণ ব্যবস্থাপনা, নগর পরিবহণ এবং নগর ঝুঁকি হ্রাস।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে সকল নাগরিকের অনুকূলে মানসম্মত ও নূন্যতম মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবার অধিকার এবং সেই সাথে সেবা ও ইউলিটি সেবা তাদের জন্য সহজলভ্য করা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, নারীদের অগ্রগতি ও অধিকার, শিশুদের অগ্রগতি ও অধিকার, বয়োবৃদ্ধ এবং অসমর্থ মানুষের জন্য বিশেষ সেবা দান, কর্মসংস্থানের সুযোগের বিস্তৃতি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ও সুবিধাবলিতে অ্যাকসেস বৃদ্ধি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এগুলো সামাজিক উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। বস্তুত সামাজিক উন্নয়ন টেকসই উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তিসমূহের অন্যতম। এই কৌশলগত অগ্রাধিকার প্রাপ্ত এলাকার প্রাথমিক উদ্দেশ্যবলির অন্যতম হলো, প্রাকৃতিক সম্পদের দক্ষ ব্যবহারসমূহ এর সংরক্ষন ও উন্নয়ন যথাযথ গুরুত্ব দান সহ মানব, ইকোসিস্টেম ও সম্পদের জন্য পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, পানি সম্পদ, বন ও জীববৈচিত্র ভূমি ও মাটি উপকূলীয় ও সামুদ্রিক সম্পদ এবং প্রাকৃতিক দূযোর্গ ও জলবায়ূ পরিবর্তন এর আওতাভূক্ত।
জাতীয় টেকসই উন্নয়ন কৌশলপত্রের কৌশলগত অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এলাকাগুলোতে সহায়তা দিতে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা শনাক্ত করা হয়েছে। পারস্পরিকভাবে সর্ম্পকযুক্ত এই এলাকাগুলি হলো, সুশাসন, জেন্ডার, এবং দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, ও জলবায়ূ পরিবর্তন। এটি প্রতীয়মান হয় যে, জলবায়ূ পরিবর্তন সমস্যা উপেক্ষা করে সামগ্রিক ভাবে টেসই উন্নয়ন কখনো অর্জন করা সম্ভব নয়।
সুশাসন খাতে গৃহীত কৌশলের উদ্দেশ্য হলো একটি কার্যকর সংসদীয় ব্যবস্থা, উপযুক্ত আইন ও শৃংখলা, গণমুখী ও দক্ষ সরকারি সেবা বিতরণ, স্বাধীন, মুক্ত, স্বচ্ছ, ও জবাবদিহিতা মূলক আইন ও বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী স্থানীয় সরকার এবং সার্বিকভাবে সামাজিক ন্যায়বিচারসহ একটি দূর্নীতিমুক্ত সমাজ নিশ্চিত করা। কৌশলপত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধি, আর্থিক খাত পরিবীক্ষন সংষ্কার, দূর্নীতি দমন, পরিকল্পনা ও বাজেটিং এর দক্ষতা বৃদ্ধি, আর্থিক খাত পরিবীক্ষ ইশাসনের প্রবর্তন, তথ্যে অ্যাকসেস নিশ্চিতকরণ এবং সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা পুনঃপ্রচলনের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে।
পরিবেশের কোন ভৌগলিক সীমারেখা নেই এবং কোনো দেশই বিচ্ছিন্নভাবে নিজ পরিবেশ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়ে এককভাবে নিজের ভবিষ্যৎ কে শঙ্কামুক্ত করতে পারে না। এজন্য টেকসই উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ ও বহিবিশ্বের অংশীদারিত্বের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ কারণে ইসলামের ন্যায় বিচার, নৈতিকতা, সাম্য, সৌন্দর্যবোধ, ভালোবাসা, দেশপ্রেম প্রভূতি মূল্যবোধ বাস্তবানের উপর জোর দিতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ