বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মহররম ও আশুরা

মহররম কাকে বলে?
      আরবী বর্ষ বা হিজরি সনের প্রথম মাস হল মহররম।
মহররম শব্দের অর্থ-
অলঙ্ঘনীয় পবিত্র;  সম্মানিত
মর্যাদাপুর্ণ; তাৎপর্যপুর্ণ
পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২। যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ (সুরা তাওবা : ৩৬)
এখানে আল্লাহ তায়ালা যে চারটি সম্মানিত মাসের কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো হল জিলক্বাদ, জিলহজ, মহররম এবং রজব মাস। জাহেলী যুগের লোকেরাও এই চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুটপাট, রক্তপাত, হানাহানি ইত্যাদি থেকে বিরত থাকত।
হাদিস শরিফে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা আল্লাহর মাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মহররম মাস সম্মানিত হওয়ার বিশেষ একটি কারণ হচ্ছে আশুরা।
আশুরা কি? 
মহররমের ১০ম দিনকে আশুরা বলা হয়। আশুরা শব্দটি  আরবী শব্দ ‘আশারা’ থেকে নেয়া হয়েছে। এর অর্থ ১০।  পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই এই দিনে সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। হাদিস ও অন্যান্য গ্রন্থ থেকে পাওয়া সেসব ঘটনাগুলি হল-
১।  আল্লাহ তায়ালা এই দিনেই আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেন।
২। পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আঃ) কে এই দিনেই সৃষ্টি করা হয়।
৩। এই দিনেই আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) কে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়।
৪/ মহাপ্লাবনের সময় নূহ (আঃ) এর নৌকা এই দিনেই পর্বতে গিয়ে ঠেকেছিল।
৫/ মূসা (আঃ) ও তাঁর অনুসারীদেরকে আল্লাহ তায়ালা এই দিনে ফিরাউনের হাত থেকে বাচান এবং ফিরাউনকে লোহিত সাগরে ডুবিয়ে মারেন।
৬/ ইব্রাহীম (আঃ) কে আগুনে ফেলা হলে আগুন তাঁর জন্য শীতল হয়ে যায়। সেটা ছিল এই দিন।
৭/ আইয়ুব (আঃ) দুরারোগ্য অসুখ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন এই দিনেই।
৮/ এই দিনেই ঈসা (আঃ) কে আল্লাহ তায়ালা ঊর্ধাকাশে উঠিয়ে নিয়েছিলেন।
৯। ইউনূস (আঃ) মাছের পেট থেকে এই দিনেই মুক্তি লাভ করেন। 
১০/ ইউসুফ (আঃ) ও তাঁর পিতা ইয়াকুব (আঃ) এর সাথে এই দিনেই বহু বছর পর দেখা হয়।
১১/ দাউদ (আঃ) এর তাওবা কবুল হয় এই দিনে।
১২/ সুলাইমান (আঃ) পুনরায় রাজত্ব লাভ করেন এই দিনে।
১৩/ ইদ্রিস (আঃ) কে আল্লাহ জান্নাতে উঠিয়ে নেন এই দিনে।
১৪/ কারবালার ময়দানে এই দিনে হোসাইন (রাঃ) তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে নির্মমভাবে শাহাদাৎ বরণ করেন। 
১৫/ এই দিনেই কেয়ামত সংগঠিত হবে।
মহররম ও আশুরা দিবসে কি করতে হবে?
 রোজা রাখাঃ
মহানবী (সা.) যখন হিজরত করে মদিনা পৌঁছেন, তখন তিনি দেখলেন যে মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, আশুরার দিনে তোমরা রোজা রেখেছ কেন? তারা উত্তর দিল, এই দিনটি অনেক বড়। এই পবিত্র দিনে মহান আল্লাহ মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে ফিরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন আর ফিরাউন ও তার বাহিনী কিবতি সম্প্রদায়কে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজরত মুসা (আ.) রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। তাদের উত্তর শুনে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, হজরত মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি নিজে আশুরার রোজা রাখেন এবং উম্মতকে তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন।
রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা উম্মতে মহম্মদীর ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে ওই বিধান রহিত হয়ে যায় এবং তা নফলে পরিণত হয়।
হাদিস শরিফে হজরত জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে- ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না। (মুসলিম শরিফ-১১২৮)
বর্তমানে এই রোজা যদিও নফল, কিন্তু অন্যান্য নফল রোজার তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল (সা.) আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে সেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন না। (বুখারি ও মুসলিম)
হজরত হাফসা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) চারটি কাজ কখনো ছেড়ে দিতেন না। তার মধ্যে একটি আশুরার রোজা। (নাসায়ি শরিফ)
 ‘হজরত আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়। (মুসলিম-১১৬২)। ‘
রাসুল (সা.) বলেন- ‘রমজান মাসের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা আল্লাহর মাস মহররমের আশুরার রোজা।’ (সুনানে কুবরা-৪২১০)
তবে শুধুমাত্র আশুরার দিন রোজা না রেখে তার আগের বা পরের যে কোন একদিন রোজা রেখে একসাথে দুটি রোজা রাখতে হবে।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘মহানবী (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইহুদি-নাসারারা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। (আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। ) তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘ (তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে) আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব। (মুসলিম-১১৩৪)
আশুরার শিক্ষাঃ    
১। আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং ভরসা থাকলে আল্লাহ অবশ্যই সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবেন।
২/ আল্লাহর পথে কাজ করতে গেলে অবশ্যই বিপদ আসবে কিন্তু সেসব বিপদ থেকে অভাবনীয় উপায়ে উদ্ধার করবেন আল্লাহ নিজেই। 
৩/ বাতিলের সাথে মোকাবেলায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে।
৪/ আল্লাহ বিরোধী কার্যকলাপ ও সমাজ থেকে জুলুম নির্মূল করতে প্রয়োজনে নিজের জীবন কোরবান করতে হবে।
ভূল ধারণা : মহররমের ১০ তারিখকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে অনেক ভূল ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। যেমন-
১/ এ মাসে শাক খাওয়া নিষেধ
২/ এ মাসে বিয়ে শাদি পড়ানো নিষেধ
৩/ মাতম করা, উচ্চস্বরে আহাজারি করা, পোশাক ছিঁড়ে ফেলা, শরীর রক্তাক্ত করা।
ইসলামে এসবের কোন ভিত্তি নেই। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “শোকে বেহাল হয়ে যে ব্যক্তি গাল চাপড়ায়, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহিলী যুগের ন্যায় আচরণ করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।“ -বুখারি ও মুসলিম
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে মহররমের শিক্ষা থেকে উজ্জীবিত হওয়ার এবং সমস্ত বিদয়াতি কাজ কর্ম থেকে বিরত থাকার তৌফিক দান করুন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ