শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আধ্যাত্মিক সাধক আল্লামা রুমী (র.) শহর কোনিয়া

আশফা খানম (হেলেন) : কোনিয়াকে বলা হয় শান্তির শহর, এটি তুর্কীর আনাতোলিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত। এই শহরটি আধ্যাত্মিক দরবেশ, সুফী সাধক এবং সেলজুক সা¤্রাজ্যের অসাধারণ আকির্টেকচার নিদর্শনগুলোর জন্য সুপরিচিত। বিশেষ করে সুফী সম্রাট ও আধ্যাত্মিক কবি আল্লামা জালাল উদ্দিন রুমীর শহর হিসেবে কোনিয়া বেশ সুপরিচিত। মসনবি রচয়িতার এ বিশ্ব বিখ্যাত সুফী সাধক ১৩ শতকের পার্সিয়ান সুন্নী মুসলিম কবি, বিচারক, ইসলামিক পন্ডিত এবং আধ্যাত্মিক সুফী সাধক ছিলেন। আমাদের দেশেও তার নাম জানে না এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। সুফী সাধক ও মসনবি রচয়িতা হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। এমন মহামানবের স্মৃতি বিজড়িত শহরে পদার্পণ করে আমরা খুবই ভাবাবেগে আপ্লুত ছিলাম। তিনি ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দে একটি ধর্মপ্রাণ সুফী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বাহাউদ্দিন ওয়ালিদ একজন বিচারক, ইসলামী পন্ডিত, ও ধর্মপ্রাণ সুফী সাধক ছিলেন। তাঁর মা মুমিনা খাতুন একজন ধর্মপ্রাণ মহিলা ছিলেন। তিনি ৩০ শে সেপ্টেম্বর ১২০৭ সালে বালখে (যা বর্তমানে আফগানিস্তান) জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে মঙ্গলীয়রা যখন এশিয়ার মধ্যে আক্রমণ করে তখন তার বাবা পরিবার ও শিষ্যদেরসহ বাগদাদ, দামেস্ক এবং অন্য মুসলিম দেশ অতিক্রম করে অবশেষে মক্কা শরীফে হজ পালন করে কোনিয়ায় স্থায়ী হন। রুমী তার বাবার অন্যতম শিষ্য বুরহান উদ্দীন মুহাবকিব তিরমিযীর শিষ্য ছিলেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে তিনি আধ্যাত্মিক সাধক হোন। প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর বাবা বাহাউদ্দীনের মৃত্যু পর ১২৩১ খ্রিষ্টাব্দে রুমী বাবার স্থলাভিষিক্ত হন এবং একজন নামকরা ধর্মগুরু হয়ে উঠেন। তিনি কোনিয়ার মসজিদে ধর্ম প্রচার করতেন। তাঁর ২৪ বছর বয়সে তিনি ধর্ম বিজ্ঞানের উপর একজন অপ্রতিরোধ্য পন্ডিত হয়ে উঠেন। তাঁর পরম নিকটতম বন্ধু আরেক সুফী দরবেশ শামসুদ্দিন এর হত্যাকান্ডে তিনি খুবই মমার্হত হন এবং তাঁর শোককে তিনি গান, নাচ এবং কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেন। তিনি এ সময় গজল রচনা করেন যা দিওয়ান-ই-কবির বা দিওয়ান-ই-শামস্‌ নামে সুপরিচিত। তিনি তাঁর জীবনের পরবর্তী সময় আনাতোলিয়ায় কাটান এবং ছয় খন্ডের তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি মসনবী রচনা করেন।
তাঁর বইগুলো পুরো পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষায় যথা রাশান, জার্মানি, উর্দু, তুর্কী, আরবি, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ এবং বাংলা ভাষায় অনুদিত হয়। এই সুফী সাধক ১৭ই ডিসেম্বর ১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দ সেলজুক সাম্রাজ্যের সময়কালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর পিতার পাশেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর স্মরণে ও শ্রদ্ধায় মেভলানা মুসলিয়াম নামে একটি মাজার কোনিয়ায় নির্মাণ করা হয়। আমরা ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে কোনিয়ায় পৌঁছে যাই। কোনিয়ায় প্রথমে আল্লামা রুমীর সেই মেভলন মুসলিয়ায় পৌঁছে যাই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর ভক্তরা এখানে এসে ভীড় করেন। আমাদের গাইড ইনজি গাড়িতে যেতে যেতে আমাদেরকে মাওলানা রুমীর মাজারের বর্ণনা দিতে থাকেন এবং এর ইতিহাস বলেন। সেলজুক সম্রাট সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদ তাঁর গোলাপ বাগানে মাওলানা রুমীকে তাঁর পিতার কবর সমাধিস্থ করতে দেন। এখানে তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয়। মাওলানার পরবর্তী উত্তরসূরিরা এই মাজার বানান। এটি সেলজুক সাম্রাজ্যের আর্কিটেক্ট বেহরেত্তিন তেবরিজলি ১২৭৪ সালে নির্মাণ শেষ করেন। সেলজুক আমির সোলেমানের স্ত্রী গোরচে হাতুন এবং আমির আলামেদ্দীন কায়সার এই নির্মাণ কাজের ব্যয়ভার বহন করেন। পরবর্তীতে অটোম্যান সম্রাট সেলিম ১ম এর সৌন্দর্য বর্ধনে আরো কাজ করান। মাজারের সবুজ গম্বুজ এর নিচে মাওলানা রুমীর সমাধি। কামাল আতাতুর্ক একটি ডিক্রি জারি করে ১৯২৫ সালে সুফি সাধকের এই মিলন মেলা ভেঙ্গে দেন এবং অন্য ডিক্রি দিয়ে ১৯২৬ সালে ৬ই এপ্রিল একে মিউজিয়াম হিসেবে উন্মুক্ত করে দেন। ১৯৫৪ সাল থেকে বিশেষ সুপারিশের মাধ্যমে তুর্কী সরকার পর্যটকদের জন্য বছরে ২ সপ্তাহ তাদের আধ্যাত্মিক সাধকদের ঐতিহ্যবাহী ‘সামা নৃত্য’ প্রদর্শনের অনুমতি প্রদান করেন। আল্লামা রুমীর ভক্তদের এখানে প্রতি বছর সমাবেশ ঘটে। শুধু ২০১৭ সালে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন পর্যটক এই মিউজিয়াম পরিদর্শন করেন। মূল হলঘরে (সবুজ গম্বুজ) দরবেশদের সমাধি ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন শিল্পকর্মের মাধ্যমে ইসলামিক বাণী এবং মূর্তি। আল্লামা রুমীর পিতার কবরের নিকটেই তাঁর কবর যা ধারাবাহিক ভাবে পিতার প্রতি সম্মানের নিদর্শন। আর এভাবে গুরুশিষ্য সম্মান অনুসারে অন্যান্য আধ্যাত্মিক সাধকদেরও কবর আছে। মূল ঘরের দুইপাশে বর্ধিত অংশকে সেমিহেন বলে। বতর্মানে এ ঘরগুলো মাওলানা রুমীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে যাদুঘর হিসেবে সাজানো হয়েছে। এতে অটোম্যান ও সেলজুক স¤্রাটদের বিবিধ জিনিসও প্রদশর্নীর জন্য রাখা হয়েছে। এতে আছে ১৩ শতকে সোনা দিয়ে লিখিত কুরআন, মূল্যবান সিল্ক কার্পেটের জায়নামাজ দ্যা মেগনিফিসেন্ট সুলতান সুলেমানের আমলে মাজারের ডানপাশে সুলতানের পতœী হুররাম সুলতানের সমাধি এবং দরবেশদের জন্য রান্নাঘর অবস্থিত। রান্নাঘরের একাংশ শিষ্যদের দীক্ষা দেবার জন্য এবং সামা শিক্ষা দেবার জন্য ব্যবহৃত হতো। আমরা সব ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। মাজার প্রাঙ্গনে (মধ্যর্বতী স্থানে) একটি সুন্দর ফোয়ারা আছে। এটি সুলতান সেলিম নির্মাণ করে দেন। সুলতান সুলেমানের সময় সেমিহেন সংলগ্ন ছোট মসজিদও বানানো হয়। এই হলে দরবেশরা তাদের বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্রের সুরের তালে তালে সামা নৃত্য পরিবেশন করতেন। বর্তমানে এগুলোর সবই প্রর্দশনীর জন্য সেখানে রাখা আছে। প্রতিটি রুমে কি করা হতো তা বিভিন্ন প্রতিমূর্তি বানিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃ মসজিদ ও কবর সংলগ্ন এলাকায় এভাবে বানানো প্রতিমূর্তি দেখে আমরা অস্বস্তিবোধ করি। কাবাঘরের যে মূর্তি ভাঙ্গার এবং এর বিরুদ্ধচারণের জন্য যুগে যুগে ইবরাহীম (আ:) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এবং আল্লাহ্‌র প্রেরিত অসংখ্য নবী-রাসূলরা পর্যন্ত নিজ পরিবার, গোত্র, এমনকি মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন এবং সংগ্রাম করেছিলেন সেক্ষেত্রে আজ মিউজিয়াম আকর্ষণীয় করার জন্য পবিত্র মাজার ও মসজিদ সংলগ্ন যাদুঘরে ডামিরুপী মূর্তিগুলোর অবস্থান সত্যিই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক লেগেছিল।
এছাড়াও একটি রুমে মাওলানা রুমীর রচিত ১৩৬৬ সালের দিওয়ানই কেবির এবং মসনভীর (১২৭৮ ও ১৩৭১ সালের) কপি রয়েছে। কবর সংলগ্ন লাগানো মসজিদের ঘরটিতে বহু পুরানো এবং বিভিন্ন সময়ের কুরআনের কপি, মূল্যবান জায়নামাজ প্রদর্শনীর জন্য রয়েছে। এতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু ছিল একটি ছোট গ্লাসের বাক্সে হযরত নূরে মুহাম্মদ (সা:) এর দাঁড়ি মুবারক রাখার বাক্স যার চার কোনায় ছোট চারটি ফুটা আছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি পরে বাক্সের চর্তুদিকে মানুষের ভীড় এবং এর খুশবু নিতে দেখে আমরাও বাক্সের দিকে এগিয়ে যাই। যাতে পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)এর দাঁড়ি চুল রক্ষিত আছে এবং এর খুশবু নিই। সুব্‌হান আল্লাহ ! কুরআনের ভাষায় যেন চমৎকার মিশক আম্বর এর জান্নাতি খুশবু। আমরা সবাই এই মুজিযার সন্ধান পেয়ে চমৎকৃত হই এবং এ পবিত্র সুরুভী অর্জনের সৌভাগ্য প্রাপ্ত করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের নিকট এ সৌভাগ্য প্রাপ্ত করায় শুকরিয়া জানাই। আমরা মিউজিয়াম ও আল্লামা রুমীর মাজার এলাকা ঘুরে দেখলাম। বাইরের মার্কেট থেকে কিছু টুকি টাকি বাজার করলাম। এরপর ফুলে ফুলে সুশোভিত শান্ত শহর কোনিয়া ভ্রমণের চমৎকার অভিজ্ঞতা পরবর্তী সংখ্যায় লিখবো আশা রাখি। 
লেখক : প্রিন্সিপ্যাল, চট্টগ্রাম ভিক্টোরী ন্যাশনাল স্কুল-সিভিএনএস এবং কলামিস্ট ও নারী উন্নয়নকর্মী।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ