শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

অর্থদণ্ড

শফিকুল ইসলাম শফিক : সেদিন সকাল ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারপাশে এখনো ঊষার আলো প্রস্ফুটিত হয়নি। আকাশটা ছিল বেশ থমথমে। মিলুদের বাড়িটা ছিল দু’তলা বিশিষ্ট। বাড়ির সামনেই রাস্তা। কিছুকাল আগেও রাস্তাটি বেশ কাঁচা ছিল। সেসময় অবশ্য অত গাড়ি বা মানুষজন চলাচল করত না। সময়ের পরিক্রমায় দিন বদলে যায়। এখন ব্যস্ত পাকা রাস্তা। একদিকে, চলাচলের বেশ সুবিধা। অন্যদিকে, কখন কী হয়! এ নিয়ে আশপাশের মানুষ বেশ শঙ্কিত থাকে। 

ছোটবেলা মিলুর বাবা মারা যায়। তখন থেকেই সে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে শিখেছে। কাজ ফেলে কখনও বসে থাকে না। কাজই মিলুর জীবনের নিত্য সঙ্গী। অভাবের কশাঘাতে ও সংসারের দায়ভারে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হতে থাকে। অনেক কষ্ট করে কিছুটা সংসারের কষ্ট লাঘব করেছে। মিলুদের দুটি ছাগল। গায়ের রং কালো, দেখতে একই রকম। প্রতিদিনের মতো তার মা আজও খুব সকালে গোয়ালের চাটা উদাম করে দিলেন। দুটি ছাগল লাফাতে লাফাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। মিলুর জেঠা আবুল মিয়া। তিনি ফজরের নামায আদায় করে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরছেন। 

মুকুল মাস্টার। পাশের গ্রামে বাড়ি। সেদিন তার বোনসহ মোটরসাইকেল নিয়ে যাচ্ছেন। পথিমধ্যে হঠাৎ একটি ছাগল গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খায়। আবুল মিয়া ছাগলটি লক্ষ্য করে শিগগিরই চেঁচাঁমেচি শুরু করতে লাগলেন। মিলু, এই মিলু। তোরা কে কোথায় আছিস? শিগগিরই আয়। মিলু ও তার মা ছুটে এল। ছাগলটি ততক্ষণে মারা যায়। শোরগোল পড়ে গেল। পাড়ার অনেক লোকজন উপস্থিত হলো। সবাই বলতে লাগল, ‘মিলু একটা এতিম ছেলে। তার বাপ নেই। অনেক কষ্ট করে সংসার চালায়। তার এত বড় ক্ষতি এমনি এমনি মেনে নিতে পারি না।’

বাড়ির পাশে থানা। লোকজন থানায় মামলা দিতে বলল। আবুল মিয়া খুব বিচক্ষণ মানুষ। ভাবলেন, মাস্টার তো আমাদের অতি চেনাজানা কাছের মানুষ। আলগা কোনো মানুষ নয়। তাছাড়া তিনি একজন স্কুলের মাস্টার। থানা-পুলিশ এগুলো তার ক্ষেত্রে শোভা পায় না। আমরা থানায় যাচ্ছি না। অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি ও মিলু একটি ভ্যানগাড়িতে মৃত ছাগলটি নিয়ে মাস্টারের বাড়ি গেলেন। সাড়াশব্দে মাস্টারের বউ বাড়ি থেকে বের হলেন। 

অতঃপর আবুল মিয়া সব ঘটনা খুলে বললেন। মাস্টারের বউ বললেন, ‘আমি তো কিছুই জানি না। মাস্টার খুব ভোরে তার বোনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছেন। আপনারা অনেক কষ্ট করে এসেছেন। বসুন! মাস্টার চলে আসবে। না হয় ফিরে এলে বিষয়টি তাকে আমি অবশ্যই জানাবো।’ আবুল মিয়া বললেন, ‘ঠিক আছে। আমরা তার জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করব? কয়েকদিন আগে ব্যাপারী ছাগলটির দাম চার হাজার টাকা বলেছে। মিলু আরও বেশি দামের আশায় ছাগলটি আর বিক্রি করল না। মাস্টারকে অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অন্যথায় থানায় মামলা দিতে বাধ্য হব। আমরা চলে যাচ্ছি।’

ফেরার পথে মাস্টারের সঙ্গে দেখা হলো। এখানেও বিভিন্ন মানুষ উপস্থিত হলো। মাস্টার নিমিষেই হতভম্ব হন। ঘটনাটি আন্দাজ করতে আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। গাড়ি থামালেন। কথা না বাড়িয়ে সব দোষ স্বীকার করে নিলেন। বললেন, ‘ইচ্ছে করে তো দুর্ঘটনা হয়নি। ছাগলটি মারা গেল। সবাই মিলে একটা কিছু সমাধান খুঁজি। আমি বাপু, চার হাজার টাকা দিতে পারব না। দুই হাজার টাকা দেবো। এখন দিতে পারছি না। কথা দিলাম। আগামী মাসের বেতন পেলে নিজেই এসে দিয়ে যাব।’  মিলু সহজে মানতেই চায় না। মুখটা বেশ ভারি ভারি। জেঠার কথা সে আর এড়িয়ে যেতে পারে না।

অবশেষে মিলু রাজি হলো। মিলুর মা তিনিও ছাগলের জন্য খুব আফসোস করতে লাগলেন। মিলুকে দোষী করলেন। ছাগলটি বিক্রি করলে আজ হয়তো এমন দুর্দিন দেখতে হত না। মাস্টার পরের মাসে স্কুলের বেতন পেলেন। কথামতো সমুদয় অর্থদ- দিলেন। মিলু কিছুতেই ছাগলের কথা ভুলতে পারে না। ছাগলের প্রতি খুব মায়া মায়াভাব জন্মেছিল। আজও যেন চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। একটি আছে, আরেকটি নেই। শূন্য গোয়াল। শূন্য বাড়ি। সে ভাবে, অর্থদ- পেলেই কী সব কিছুর প্রয়োজন মিটে যায়!

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ