শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতা এবং ফারাহ’র উদাহরণ

গত বছর ২৫ আগস্ট শুরু হয়েছিল মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সামরিক অভিযান। এর এক বছর পূর্তি উপলক্ষে গত শুক্রবার নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে অনুষ্ঠিত হয় এক বহুজাতিক ও আন্তধর্মীয় প্রতিবাদ সভা ও পদযাত্রা। এর আয়োজক ছিল বার্মা টাস্কফোর্স নামের একটি নাগরিক অধিকার সংগঠন। ম্যানহাটনের ইসলামিক কালচারাল সেন্টার থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রাটি শেষ হয় মধ্য ম্যানহাটনে জাতিসংঘে মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধির দপ্তরের সামনে। সেখানে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি স্মারকপত্র হস্তান্তর করা হয়। স্মারকপত্রে অবিলম্বে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থানরত সব রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন ও তাদের নাগরিকত্বসহ সব মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দাবি করা হয়।
স্মারকপত্রে যে দাবি করা হয় তার যৌক্তিকতা সভ্য পৃথিবী উপলব্ধি করে, কিন্তু মিয়ানমার তো তা বিবেচনায় আনছে না। বেপরোয়া অপরাধীর মতো মিয়ানমার সরকার শঠতা ও চাতুর্যের পথ অবলম্বন করে মানব জাতিকে অপমান করে যাচ্ছে। নাগরিক জমায়েতে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা মজলুম রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য প্রদান করেন। বার্মা টাস্কফোর্সের অন্যতম সমন্বয়কারী এডেম ক্যারল জানান, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে নিউইয়র্ক ছাড়াও ওয়াশিংটন ডিসি, শিকাগো এবং কানাডাতে পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। মার্কিন সরকার যাতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে, সে উদ্দেশ্যে এই টাস্কফোর্স কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন বলে জানানো হয়।
এদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই মর্মে মন্তব্য করেছে যে, বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতার কারণে রাখাইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। গত এক বছরের চালচিত্র বিশ্লেষণ করলে বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতার বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের মোহে বিশ্বনেতারা বড় অপরাধকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। এমন ভূমিকার জন্য তাদের ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা মানবজাতির জন্য উত্তম উদাহরণ হতে পারতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় তেমনটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা নিজ দেশের জনগণ ও বিশ্ববাসীর জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তাদের ভ্রান্ত ভাবনা, দাম্ভিক আচরণ, মন্দ জীবনযাপন এবং নীতিহীন চাতুর্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা বলা যায়। তাকে নিয়ে এখন ইমপিচমেন্টের (অভিশংসন) আলোচনা হচ্ছে। ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ইমপিচমেন্টের উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিণতি বয়ে আনবে। তিনি আরো বলেন, যদি আমি কখনো ইমপিচমেন্টের শিকার হই, আমার মনে হয় তাহলে বাজারে ধস নামবে। সবাই তখন গরিব হয়ে যাবে। ভাবতে অবাব লাগে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের ভুল-ত্রুটি ও অনিয়মের কথা স্বীকার করে সংশোধনের পথে না গিয়ে কী করে মানুষকে দারিদ্র্যের ভয় দেখাচ্ছেন? এতে তো তার বিচার-বিবেচনা ও কা-জ্ঞান সম্পর্কেই প্রশ্ন জাগে।
এদিকে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রচারণায় আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আদালতে স্বীকার করে নিয়েছেন ট্রাম্পের সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেন। নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব এড়ানোর উদ্দেশ্যেই ‘প্রার্থীর নির্দেশনায়’ এমনটি করেছিলেন বলে আদালতকে জানিয়েছেন কোহেন। তিনি জবানবন্দীতে স্বীকার করেছেন যে, ট্রাম্পের নির্দেশেই ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে দুই পর্নো তারকাকে অর্থ দিয়েছিলেন তিনি। শর্ত ছিল, ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কের কথা তারা প্রকাশ করবেন না। এভাবে অর্থ দেয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অর্থায়নের আইন লংঘনের পাশাপাশি নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান চাপে ট্রাম্প তার শীর্ষ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনসের সমালোচনা করে বলেন, সেশনস কখনো বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। আক্রমণাত্মক এমন মন্তব্যের জবাবে জেফ সেশনস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, রাজনৈতিক চাপের কাছে বিচার বিভাগ নতি স্বীকার করবে না। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাই হবে দেখার মত বিষয়।
মনুষ্য সমাজেই আছে আইন-আদালত তথা বিচার বিভাগ। কারণ মানুষ শুধু প্রাণীর নাম নয়। মানুষ চিন্তা করে, মানুষের আদর্শ আছে, দর্শন আছে। এ কারণে মানুষের মধ্যে যেমন স্বকীয়তা আছে, তেমনি আছে বৈচিত্র্যও। তবে বর্তমান ভোগবাদী সমাজে মানুষের কাছে আদর্শের চাইতে ভোগ্যপণ্যের গুরুত্ব অধিক। ফলে পৃথিবীতে এখন ন্যায় ও নীতির বদলে লোভ-লালসা, চাতুর্য ও নিজেকে বিকিয়ে দেয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পৃথিবী এখন শান্তি, সৌহার্দ ও মানবিক বোধের বদলে অশান্তি, অস্থিরতা ও আগ্রাসনের এক অনাকাক্সিক্ষত গ্রহে পরিণত হয়েছে। এখন বৈচিত্র্যের ঐক্যই শুধু অনুপস্থিত নয়, অনুপস্থিত স্বকীয়তাও।
এমন বাতাবরণে মাঝে মাঝে ব্যতিক্রমী ঘটনাও লক্ষ্য করা যায়। ১৭ আগস্ট এমন একটি ঘটনার খবর পরিবেশন করেছে বিবিসি। খবরে বলা হয়, ‘হ্যান্ডশেক’ মামলায় জিতে গেছেন সুইডেনে বসবাসকারী মুসলিম তরুণী ফারাহ আলহাজেহ। চলতি বছর ফারাহ একটি সুইডিশ প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করেন। চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে ডাকলে তিনি ধর্মীয় কারণে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সাথে হ্যান্ডশেক করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এর বদলে তিনি বুকে হাত রেখে তাদের প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। কিন্তু হ্যান্ডশেক না করায় কর্তৃপক্ষ তার ইন্টারভিউ বাতিল ঘোষণা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফারাহ দেশটির শ্রম আদালতে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আদালত ফারাহ’র পক্ষে রায় প্রদান করে। মামলার রায়ে আদালত জানায়, প্রতিষ্ঠানটি ফারাহ’র প্রতি ধর্মীয় বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে।
অপরাধের কারণে আদালত অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ৪ হাজার ৩৫০ ডলার জরিমানা ধার্য করে। এদিকে রায় প্রসঙ্গে বাদী ফারাহ জানান, তিনি অর্থ প্রাপ্তির জন্য অভিযোগ দায়ের করেননি। অভিযোগ দায়েরের কারণ, আমি কোনো ভুল কাজ করিনি এবং অন্যায়ের শিকার হয়েছি। আমি আশা করি, সুবিচারের ফলে এরকম পরিস্থিতির শিকার অন্য নারীরা আশাবাদী হতে পারবে।
আলোচ্য হ্যান্ডশেক মামলায় মুসলিম তরুণী ফারাহ তার ধর্মবিশ্বাসজনিত স্বকীয় চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে বিজয়ী হয়েছেন। অথচ বর্তমান ভোগবাদী সভ্যতায় মানুষ কত সহজেই না আদর্শকে, স্বকীয়তাকে সামান্য স্বার্থে বিসর্জন দিচ্ছে। ফারাহ’র উদাহরণে শেখার বিষয় রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা শিক্ষা গ্রহণ করবো কী?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ