বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

যানজট সমস্যা : নিরসন জরুরি

আখতার হামিদ খান : এ প্রসঙ্গটা লিখতে বসে ভাবলাম একটু পেছনে ফিরে তাকানো প্রয়োজন। সেই আশির দশকে ঢাকার সদরঘাট থেকে নৌপথে হুলারহাট পর্যন্ত। এরপর সড়ক পথে হুলারহাট-পিরোজপুর হয়ে বাগেরহাটে যাতায়াত করতাম। পিরোজপুর থেকে বাসে বাগেরহাট গেলে কিছুটা সময় বাঁচানো যেত। কিন্তু ঐ রাস্তাটা এমন খারাপ ছিল যে বাস চলতো খুব আস্তে আস্তে। তাই এক ভদ্রলোক মন্তব্য করেছিলেন যে, পিরোজপুর থেকে বাগেরহাট যেতে বাসের আগে বাই-সাইকেল যায়। কথাটা হাস্যকর হলেও সত্য ছিল। এখন সময় পাল্টেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক অনেক উন্নতি হয়েছে সারাদেশে- এ কথা অন্ততঃ বলা যায়। আর রাজধানী ঢাকা শহরে ঐ সময় রাস্তাঘাট ছিল অপ্রশস্ত। সীমিত আকারে যানবাহন চলাচল করতো। তখন যানজট বলতে ছিল না কিছুই। এখন রাস্তাঘাট প্রশস্ত হয়েছে, উন্নত হয়েছে। সেই সাথে বেড়েছে জনসংখ্যা। সময়ের চাহিদা পূরণে যানবাহনও বেড়েছে কয়েকগুণ। রোড ডিভাইডার বা সড়কদ্বীপ নেই এমন রাস্তা খুব কমই আছে ঢাকা শহরে। প্রত্যেক রাস্তায় একাধিক লেন আছে যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে। কোন কোন রাস্তায় রিকসা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে যানজট কমানোর লক্ষ্যে। এটা নিঃসন্দেহে ভাল পদক্ষেপ। তারপরও যানজট বেড়েই চলেছে অসহনীয় পর্যায়ে। অত্যাধুনিক ট্রাফিক সিগন্যাল যানজট নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে এটাও ঠিক। কিন্তু যানজটের সীমা যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও এ সমস্যা প্রকট। মুমূর্ষু রোগীবাহী এ্যাম্বুলেন্স হুয়া-হুয়া-হুয়া শব্দে সাইরেন বাজাচ্ছে রাস্তা ক্লিয়ার পাবার আশায়। দ্রুত হাসপাতালে কিভাবে রোগীকে পৌঁছানো যায় যানজটে পড়ে এ ব্যর্থ প্রচেষ্টা চলে এ্যাম্বুলেন্সগুলোর। দীর্ঘক্ষণ বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ যানজটে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় জরুরী-রোগীবাহী-এ্যাম্বুলেন্সগুলোকে এবং অন্যান্য যানবাহনগুলোকেও। এ চিত্র দেখলে মনে হয় হেঁটে গেলে গাড়ীর আগে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে। আমি না হয় হেঁটে গেলাম। কিন্তু রোগীর অবস্থা কি হবে ভেবে পাই না। তখন মনে হয় একটা স্ট্রেচার এবং চারজন লোক থাকলে রোগীকে ঘাড়ে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে যানজটে আটকা পড়া ঐ এ্যাম্বুলেন্সের আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে। যেমনটি ৮০’র দশকে পিরোজপুর থেকে বাগেরহাটে বাসের আগে সাইকেল যেত।

সমস্যার এখানেই শেষ নয়। অর্থাৎ শুধু মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে নিতে পারার বিষয়টাই সমাধান নয়। আরও সমস্যা হচ্ছে অফিসগামী মানুষ, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি গামী ছাত্র-ছাত্রী, পরীক্ষা কেন্দ্রগামী পরীক্ষার্থীরা সবাই আটকা পড়ছে এ অসহনীয় যানজটে। ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি আছে, ট্রাফিক পুলিশও আছে কিন্তু নেই যানজটের উপর নিয়ন্ত্রণ। ফুটপাতগুলো হকারদের/বাস মালিক সমিতির রঙিন ছাতাওয়ালা কাউন্টারের দখলে। তাহলে পথচারীরা হাঁটবে কিভাবে? ফুটওভার ব্রীজ/ফ্লাইওভার আছে যথেষ্ট। আন্ডার পাসও আছে কোথাও কোথাও। ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে অনেক অর্থ দিয়ে এবং আরও ফুটওভার ব্রীজ ফ্লাইওভার তৈরির পরিকল্পনাও করা হচ্ছে যা হয়তো শীঘ্রই বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু এতসব ব্যবস্থাদির পরও কোন কিছুতেই যেন কিছুই হচ্ছেনা। যানজট এখন জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত।

যানজট শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নেই। মফস্বল শহরগুলোতেও এখন কম/বেশী যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। সারাদেশে এ অসহনীয় যানজট হওয়ার সম্ভাব্য কারণসমূহ ও তা সমাধানের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে চিন্তা-ভাবনার পাশাপাশি সচেতন মহলকেও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। নইলে সামনের দিনগুলোতে কী অবস্থা হবে তা ভবিতব্যই জানেন। দেশসেরা জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক হানিফ সংকেত এর জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে একটি দৃশ্য দেখানো হয়েছিল কয়েক বছর আগে। যানজটে আটকে পড়ে কেউ পেপার পড়ছিলেন, কেউ বই পড়ছিলেন, কেউ হাতের সেলাই কাজ করছিলেন, কেউবা অফিসের কাজ করছিলেন। কয়েক বছর আগের যানজট আর সাম্প্রতিককালের যানজট এক নয়। তাই এ ভয়াবহ যানজট নিরসনে এখনই আশু কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। যানজট নিরসনে নি¤œবর্ণিত ব্যবস্থাদি গ্রহণের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় আনা যেতে পারে ঃ-

১। ঢাকাসহ সারা দেশের রাস্তায় ধারণক্ষমতা অনুযায়ী যানবাহন চলাচলের অনুমতি প্রদান। কোন অবস্থাতেই এর বেশী যানবাহন চলতে না দেয়া।

২। এ লক্ষ্যে বেশী পুরাতন যানবাহন তুলে দেয়া এবং নতুন যানবাহন চলাচলের অনুমতি আপাতত: না দেয়া।

৩। একটি প্রাইভেট কারে সর্বোচ্চ ৫/৭ জন লোক বহন করতে পারে। কিন্তু এ বাহনটি রাস্তায় যতটুকু পরিমাণ স্থান দখল করে ৪০/৫০ জন যাত্রীবাহী একটা বাস তার চেয়ে সামান্য কিছু স্থান বেশী দখল করে। তাই প্রাইভেট কারের সংখ্যা সীমিত পর্যায়ে নিয়ে আসা (শুধুমাত্র ভি আই পি/ ভি ভি আই পি/সি আই পি ব্যতীত) এবং যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা প্রয়োজন অনুযায়ী চলাচলের  অনুমতি দেয়া। (সম্ভব হলে ডবল ডেকার বাসও)।

৪। ফুটপাত দখল মুক্ত নিশ্চিত করে পথচারী চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি করা যাতে কোন পথচারী ফুটপাতে হাঁটার জায়গার অভাবে রাস্তায় না নামতে হয়।

৫। যততত্র গাড়ী পার্কিং না করতে দেয়া। কোন নির্দিষ্ট স্থানে পার্কিং এর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে বিপণী বিতানগুলোর নিজ ব্যবস্থাপনায় আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং চালু করা (যেখানে নেই)।

৬। মুমূর্ষু রোগীবাহী এ্যাম্বুলেন্স যাতে দ্রুত হাসপাতালে গমনাগমন করতে পারে সে ব্যাপারে পৃথক লেন এর ব্যবস্থা রাখা। নতুবা এ্যাম্বুলেন্সগুলোকে সবার আগে যেতে দেয়ার ব্যবস্থা করা।

৭। রেল ক্রসিং এবং একাধিক রাস্তার সংযোগ স্থলে ফ্লাই ওভার নির্মাণের ব্যবস্থা করা।

৮। অপ্রশস্ত রাস্তাগুলোকে প্রয়োজনানুযায়ী প্রশস্ত করা।

৯। আনফিট যানবাহন রাস্তায় চলাচল করলে সেগুলো কে রাস্তায় আটকে যানজট সৃষ্টি না করে রাস্তায় বের হবার আগেই টার্মিনালে চেকিং এর ব্যবস্থা করা। তাতে যানজট কমবে এবং যাত্রী ভোগান্তিও কমবে।

১০। আনফিট যানবাহনগুলো চিহ্নিত করে যাতে রাস্তায় বের হতে না পারে সে ব্যাপারে গাড়ীর বডিতে (সম্মুখে, পেছনে, ডানে, বামে) লাল ক্রসিং দিয়ে অথবা অন্য কোন ব্যবস্থাপনায় সহজে সনাক্তকরণের ব্যবস্থা করা। এরপরও ওগুলো রাস্তায় বের হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১১। দূর পাল্লার যানবাহন যাতে শহরে প্রবেশ না করে টার্মিনালে অবস্থান করে তার ব্যবস্থা করা। এ ব্যাপারে বর্তমানের টার্মিনালগুলো শহরের বাইরে স্থানান্তর করা যেতে পারে। যেমনঃ (ক) গাবতলী বাস টার্মিনাল আমিন বাজারে বা এর কাছাকাছি (খ) সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল চীন-মৈত্রী সেতুর ওপার কেরানীগঞ্জ এবং (গ) মহাখালী বাস টার্মিনাল উত্তরা এলাকায়। প্রয়োজন বোধে বাইপাস সড়কেরও ব্যবস্থা করা।

১২। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি যানজটের অন্যতম প্রধান একটি কারণ। তাই দিনের বেলায় এ কাজ না করে রাত ১২ টার পর হতে ভোর ৬ টা অবধি এ কাজ করা। এ সময়ের মধ্যে যতটুকু কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব ততটুকু কাজ হাতে নেয়া। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে অধিক সংখ্যক শ্রমিক/জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করা।

১৩। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। যেমনঃ ঢাকার নিকটবর্তী জেলা শহর গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়/দপ্তর সমূহ এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়/দপ্তর সমূহ অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী জেলা শহরগুলোতে স্থানান্তর করা। এতে রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ ও যানজট অনেকটা কমে আসবে।

১৪। বৃষ্টির পানি জমে যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটাও যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ। এই বৃষ্টির পানি দ্রুত সরে যাবার বা নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে রাজধানীর চারপাশের নদীগুলোকে ভূমি খেকো দস্যুদের হাত থেকে দখলমুক্ত করতে হবে তথা বাঁচাতে হবে। নদীগুলোর নাব্যতাও বৃদ্ধি করতে হবে।

১৫। যানজট নিরসনে আরও একটি পদক্ষেপ কার্যকরী করা সম্ভব হলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। যেমনঃ কোন গাড়ী সপ্তাহে অন্ততঃ ২ দিন রাস্তায় বের করা যাবে ন। এ দু’দিন গাড়ীর রক্ষণাবেক্ষণ ও চালকের বিশ্রাম বাবদ সংরক্ষিত রাখা যেতে পারে। ফলে একদিকে যেমন গাড়ীর আয়ুষ্কাল বাড়বে, অন্যদিকে জ্বালানিও সাশ্রয় হবে। এ ব্যবস্থা এলাকা ভিত্তিক বা গাড়ির প্রকার অনুযায়ী করা যেতে পারে। 

এ কাজটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা/তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। এ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা Monitor করতে Counter Intelligence নিয়োগ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, সপ্তাহে যে দু’দিন উল্লেখিত গাড়ী রাস্তায় চলাচল করবে না সেই দু’দিন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে নিজ অথবা অধীনস্থ জনবলের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ