আলোর মুখ দেখছে না খুলনা জেলা পরিষদের অতি গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রকল্প
খুলনা অফিস : আলোর মুখ দেখছে না খুলনা জেলা পরিষদের নেয়া তিনটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এগুলো হচ্ছে, খুলনার বধ্যভূমি গল্লামারী স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধের পূর্ণতা প্রদান, হাজার আসন বিশিষ্ট অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস হল ও পুরাতন ডাকবাংলোর স্থানে ২০ তলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ। ফলে এর সুফল বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসী। অবশ্য সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, নানা জটিলতায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। তবে তাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
খুলনা জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ভেন্যু বা স্থান নিশ্চিতের জন্য গত বছর মার্চ মাসে নগরীর রূপসাস্থ স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তর (এলজিইডি)’র রেস্ট হাউজ সংলগ্ন এলাকায় ৬০ শতক জমিতে এক হাজার আসন বিশিষ্ট একটি আধুনিক অডিটোরিয়াম কাম মাল্টিপারপাস হল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রথমে এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৪ কোটি টাকা। উদ্যোগটি বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের জেলা পরিষদ অধিশাখা প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনুমতি দেয়। মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক অনুমোদন সাপেক্ষে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য টাইপ প্লান, ডিজাইন ও প্রাক্কলন অনুযায়ী একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রকল্প তৈরি করা হয়। ওই প্রকল্প তৈরি শেষে জেলা পরিষদ এটি স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রেরণ করে। কিন্তু নকশা অনুযায়ী ভূমি সংকুলন না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম থেমে যায়। এরপর গত বছর নবেম্বর মাসে নগরীর ১নং কাস্টমঘাট এলাকার করোনেশন কারিগরি বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সংস্থার নিজস্ব জায়গায় ফের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলা পরিষদ নতুন আরেকটি প্রাক্কলন তৈরি করে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রকল্প স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রেরণ করে। চার তলা বিশিষ্ট ওই হলটিতে এক হাজার আসনের অডিটোরিয়াম, সেমিনার কক্ষ, ভিআইপি গেস্ট হাউজ ও বাউন্ডারী ওয়াল ইত্যাদি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এটিই হবে খুলনাই একমাত্র বৃহৎ আয়তনের ভেন্যু। তবে, নানা জটিলতায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না মেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।
২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহুল গল্লামারীতে স্বাধীনতা সৌধ নির্মাণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. আনোয়ারুল ইসলাম বিপিএম (বার) পিপিএম ওই ভিত্তি প্রস্তরের উদ্বোধন করেন। খুলনা জেলা পরিষদের উদ্যোগে ওই সৌধটি নির্মাণে মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ১০ কোটি টাকা। যার মধ্যে রয়েছে মূল স্তম্ভ ও বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য নির্মাণ, স্তম্ভের চারপাশে ১০ ফুট লাল টাইলস্ বসানো, পায়ে হাঁটা পথ, পার্কিং ইয়ার্ড, সীমানা প্রাচীর, গেট, সিকিউরিটি শেড, রেস্টুরেন্ট, দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান, পানির ফোয়ারা ইত্যাদি। এর মধ্যে মূল স্তম্ভ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ২ কোটি ১৬ লাখ ৩১ হাজার টাকা। প্রকল্পটির অনুমোদনের পর মূল স্তম্ভ নির্মাণে ২ কোটি ১৬ লাখ ৩১ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ওই অর্থ বরাদ্দের পর স্তম্ভ নির্মাণে দুই দফা দরপত্রের আহ্বান করে জেলা পরিষদ। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২৩ জুন আহ্বানকৃত দরপত্রের প্রেক্ষিতে কাজটি পায় খুলনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আজাদ-ইলোরা জেভি। যার ওয়ার্ক অর্ডার হয় ২০০৯ সালের ১৫ নবেম্বর এবং মূল স্তম্ভ নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১১ সালের নবেম্বর মাসে। কিন্তু ওই বছরের মার্চে স্মৃতিসৌধের স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন নির্মিত ওই মূল স্তম্ভ পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি স্মৃতিসৌধটিকে পূর্ণতা দিতে মূল নকশা বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন। তার পরামর্শ ও মূল নকশা অনুযায়ী স্মৃতিসৌধের পূর্ণতা দিতে ২০১১ সালের মার্চে স্থানীয় সরকার বিভাগে বাকী ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ পেতে পত্র প্রেরণ করে জেলা পরিষদ। স্থানীয় সরকার বিভাগ বাকী অর্থ প্রদান না করে ওই বছরের এপ্রিল মাসে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে অর্থ প্রদানে সুপারিশ ও নির্দেশনা দেয়। কিন্তু আজ অবধি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই অর্থ বরাদ্দ প্রদান করেনি। একাধিকবার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে অবহিত করলেও কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সৌধটির পূর্ণতা না পেয়ে বর্তমানে অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফলে চতুর পাশে উন্মুক্ত জায়গায় গরু-ছাগল অবাধে বিচরণ করছে। স্থানীয়দের অভিযোগ রাতের বেলায় সৌধটিকে ঘিরে মাদক সেবীদের আড্ডা বসে।
খুলনা সিটি কর্পোরেশন ও খুলনা জেলা পরিষদের মধ্যকার ২০১২ সালের ১৩ জুন সমঝোতা স্মারক-এর আলোকে খুলনা শহরের পুরাতন ডাকবাংলো স্থলে ২টি বেজমেন্ট ও ২০ তলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবণের ডিজাইন/প্লান প্রণয়ন করা হয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ঠিকাদারও নিয়োগ করা হয়। কিন্তু খুলনা সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আসা আপত্তির কারণে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ)’র নকশা অনুমোদিত না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের জন্য অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন)-এর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উভয়পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের যে অনুচ্ছেদ সমূহ সংশোধন করা প্রয়োজন তা যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য দুইপক্ষকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সমঝোতা স্মারক সংশোধনের বিষয়ে সদস্যগণ ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় তা চূড়ান্ত হয়নি। এরপর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও সিটি কর্পোরেশন ও জেলা পরিষদ আলোচ্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে একমত না হওয়ায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এ অবস্থায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে ১৫ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খুলনা স্থানীয় সরকারের পরিচালককে প্রকল্প পরিচালক, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনের উপযুক্ত প্রতিনিধিকে উপ-প্রকল্প পরিচালক এবং খুলনা বিভাগীয় কমিশনারকে উপদেষ্টা নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। নোটিশে প্রকল্প পরিচালককে আর্থিক ও প্রশাসনিকসহ সকল ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। অপরদিকে এটি বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার, খুলনা স্থানীয় সরকার বিভাগ, সিটি কর্পোরেশন ও জেলা পরিষদকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এরপর প্রকল্পটির আর কোন অগ্রগতি হয়নি।
খুলনা জেলা পরিষদের সহকারী প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান বলেন, জমি সংক্রান্ত জটিলতায় প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা বিলম্ব হয়। এখন ১নং কাস্টমঘাট এলাকার করোনেশন কারিগরি বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সংস্থার নিজস্ব জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। তবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ডাক বাংলায় বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ এখনও পূর্বের অবস্থায় রয়েছে। কোন অগ্রগতি হয়নি।
খুলনা বধ্যভূমি গল্লামারীর স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধর ব্যাপারে তিনি বলেন, নির্মাণে মন্ত্রণালয় ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। জেলা পরিষদ ওই অর্থের সাথে আরও ১৬ লাখ যোগ করে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা দিয়ে মূল স্তম্ভ নির্মাণ করেছে। নকশা অনুযায়ী বাকী কাজ সম্পন্ন করতে আরও ৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। বাকী অর্থ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে কিন্তু তাতে কোন সাড়া মেলেনি।