শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নিপীড়নের ফল ভালো হয় না

দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর দমকা হাওয়া বিরাজ করছে। কোথাও যেন এতটুকু স্বস্তির জায়গা নেই যেখানে দাঁড়িয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায়।
ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরার গ্যারান্টি শূন্যের কোঠায়। কত অবলীলায় মানুষের প্রাণ হরণ হচ্ছে তার কোনো ইয়তা নেই। নিপীড়নের শিকার মানুষগুলোর কষ্টের কথা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। একটা সময় তো এমন ছিল যেখানে বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা করা হতো না। রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আর ভালোবাসার বন্ধন ছিল রাজনীতির উত্তম মডেল। এখন আর তেমনটা দেখা যায় না বলেই রাজনীতিতে নিপীড়নের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। তবে নিপীড়নের শাখা প্রশাখা রাজনীতি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত গড়িয়েছে। এতদিন জানতাম ক্ষমতাসীনরা বিরোধী রাজনৈতিক মতালম্বীদেরকে শায়েস্তা করার জন্য নিপীড়ন করে। কিন্তু এখন দেখছি নিপীড়নের শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থী। কোটা সংস্কারের নিপীড়নের রেশ কাটতে না কাটতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বৃটিশ নিপীড়ন করে যেমন থাকতে পারেনি তেমনি পাকিস্তানও বিতাড়িত হয়েছে। নিপীড়নের ফল ভালো হয় না এটা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে অনুধাবন করা না গেলেও বিরোধী দলে গেলে টের পাওয়া যায়। রাজনৈতিক সংঘাত সহিংসতার কারণে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, ক্ষমতার দাপটমুক্ত, নিপীড়নবিহীন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের অতীত রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে অনেক নির্মম ঘটনাগুলো মানুষ মনের অজান্তে ভুলে গেছে। তবে আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা অতীত ইতিহাস থেকে যেমন শিক্ষা নিতে পারিনি তেমনি অন্যায় অবিচার জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারিনি। কিন্তু এবারের নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা সমাজ ও রাষ্টকে যে ধাক্কা দিয়েছে তা কালের স্রোতে হারিয়ে গেলেও প্রতিবাদকারীর প্রেরনার উৎস হয়ে থাকবে। স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় যে সাহস দেখিয়েছে, ফেস্টুনে যেসব কথা লিখেছে তা গোটা জাতিকে চমকে দিয়েছে। ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মনে সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এত দ্রোহ পুষে রেখেছে তা যেমন কেউ কল্পনা করতে পারেনি তেমনি সরকারও অনুভব করতে পারেনি। এই আন্দোলন অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। শাসকগোষ্ঠী নিপীড়ন চালিয়ে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দমিয়ে কোমলমতি শিশুদের অন্তর্জ¦ালার ক্ষতে যে লবণের ছিটা দিয়েছে তার দাগ শুকাইতে সময় লাগবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক ধরনের আন্দোলন সংগ্রামের ঘটনা ঘটেছে কিন্তু এই কায়দায় আন্দোলন অতীতে কেউ দেখেনি। তারা গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রকে নাড়িয়ে দিয়ে দাবি তুলেছে উই ওয়ান্ট টু জাস্টিস। অর্থাৎ তারা বিচার চায়। সড়কের খুনিদেরই শুধু বিচার চেয়েছে তা কিন্তু নয়, তারা রাষ্ট্রের সকল অনিয়ম, দুর্নীতি, জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবাইকে জাগ্রত হওয়ার তাগিদ দিয়েছে। আমরা অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহসটুকু প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল।
নিকট অতীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সরকারের সোনার ছেলেরা যেভাবে বাড়াবাড়ি করছে তা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মোটেও কাংখিত ছিল না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দমনের নামে ছাত্রদের ওপর নানাভাবে নিপীড়ন চালানো হয়েছে। এমনকি ছাত্রীদের যৌন নিপীড়ন করতেও কুন্ঠাবোধ করেনি। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ওপর যে নগ্ন হামলা হয়েছে, তাতে যেকোন সুস্থ মানুষ মর্মাহত না হয়ে পারে না। এসব নির্যাতন আমাদেরকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ছাত্রসংগঠন এনএসএফের জুলুম নির্যাতন, অত্যাচার, নিপীড়নের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। আইয়ুব খান উন্নয়নের জোয়ারে জাতিকে আফিমে বুদ রেখেও টিকে থাকতে পারেনি। তৎকালীন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) ও পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে দাবিরে রেখে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী কোনো স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিবাদী শাসক নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে ক্ষমতার মসনদে বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের জোয়ারে আইয়ুব খানের ক্ষমতার দাপট তাসের ঘরের মতো খান খান হয়ে গিয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী যুগ যুগ ধরে এই উপমহাদেশে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যারা নেমেছে তাদেরই ওপর শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ন চলছে।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন নির্যাতন ও নিপীড়নের নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ করা হয় তখন কারও বুঝতে বাকি থাকে না যে দেশটিতে গণতন্ত্রের খড়গ চলছে। ক্ষমতার দাপট মানুষকে অন্ধ করে দেয় বলেই ক্ষমতাসীনরা জনগণের মৌলিক অধিকার সংকোচিত করতে কুন্ঠাবোধ করে না। আর তখনই শাসক শ্রেণির নির্মমতার শিকার হয় নিরীহ জনগণ। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। কিন্তু বাস্তবে সেই চেতনার কোন রূপই সমাজ ও রাষ্ট্রে খুঁজে পাইনি। তবে বাংলাদেশের সংবিধানে তার উপস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে,‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে,আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজের প্রতিষ্ঠা-যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য,স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে। কিন্তু আমরা সংবিধানের আলোকে সুবিচার নিশ্চিত করা তো দূরের কথা নিপীড়নের নিষ্ঠুরতা থেকে রক্ষা পাচ্ছি না। একধরনের অস্থিরতা থেকে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমাবেশেও বাধা দেয়া হচ্ছে,যা সংবিধানের পরিপন্থী। অথচ সংবিধান প্রতিটি মানুষের সভা-সমাবেশ করার অধিকার দিয়েছে। তাহলে কেন মানুষের অধিকার আজ ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে এই বিষয়টি সবারই ভেবে দেখা দরকার।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে গেলেও স্বস্তির দেখা মেলেনি। সাতদিনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যেমন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তেমনি ছাত্রলীগ অমানবিক নগ্ন হামলা করে ছাত্ররাজনীতির কলংকের  বিশ্ব রেকড অর্জন করেছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এদেশেরই সন্তান। তারা কারো ভাই না হয় কারো সন্তান। তারাই একদিন বাংলাদেশের পতাকাকে বিশ্বের দরবারে উড্ডীন করে তুলে ধরবে। কিন্তু সরকারের আজ্ঞাবহরা যেভাবে তাদের উপর নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে তা কোন স্বৈরতান্ত্রিক দেশেও কাম্য নয়! সরকার বিরোধী মতালম্বীদের যেভাবে দমন নিপীড়ন করে স্তব্দ করে দিয়েছে একই কায়দায় কোমলমতি শিশুদেরকে নিপীড়ন করা হচ্ছে। ৯ দিনে ৩৬টি মামলা হয়েছে। হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা আসামী উল্লেখ করে দায়ের করা মামলায় ইতিমধ্যে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হলেও শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের উপর হামলার সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন শিক্ষার্থীকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। অথচ হেলমেট পরা, লুঙ্গিপরা হামলাকারিদের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পরও তাদের ধরা হচ্ছে না। পুলিশের যেখানে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করার থাকা সেখানে আজ পুলিশই দুষ্টকে লালন করেছে। পুলিশের এমন দুর্দশার জন্য দায়ী কে? দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছাত্রলীগ নাকি পুলিশের ওপর? এই প্রশ্নের উত্তর জাতির সামনে উন্মোচন করা প্রয়োজন।
একটি রাষ্ট্রে যখন ফ্যাসিবাদের উত্থান কায়েম হয় তখন সেখানে কেউ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পায় না। প্রাথমিকভাবে অনেকে ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবলেও শেষ পর্যন্ত তাদের সেই নিরাপত্তা বর্ষার বাদলে ডুবে যায়। আইন সবার চোখে সমান হলেও বাস্তবতা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের কেউ অন্যায় অপরাধ করলেও বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। কিন্তু বিরোধী মতালম্বীদের কেউ একটু টুশব্দ করলেই হামলা, মামলা আর রিমান্ডের বিভীষিকায় জীবন অচল করে দেয়া হয়। আধুনিক পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ছিল এক কলংকিত অধ্যায়ের ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিটলার তার দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছিল। জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধ পাঁচ কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। তবে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার মধ্যদিয়ে জার্মানীতে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। ইতিহাসের পাতায় বহু রাজা বাদশার নিষ্ঠুরতার কাহিনী মুদ্রিত আছে। তারা তুচ্ছ কারণে মানুষকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। তবেতাদের সবাই মানুষের অভিশাপ নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। কারণ তারা ইতিহাসের গতিকে উল্টো পথে পরিচালিত করতে গিয়ে নিজেরাই ক্ষমতার পিচ্ছিল পথে টিকে থাকতে পারেনি। তারা মনে করেছিল ইতিহাস তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চলবে। কিন্তু তা হয় না। ইতিহাস চলে তার আপন গতিতে।
যারা ক্ষমতার দাপটে নিপীড়নের পথে হেটেছে তারাই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। রোমান স¤্রাট ক্যালিগুলা ও সম্রাট নীরো, হিটলার, মুসোলিনী, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং এর মতো শাসকদের কারণে কোটি কোটি নিরীহ মানুষের জীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। কিন্তু তারা আজ কোথায়? আমরা মনে করি গণতন্ত্র মানবাধিকার শান্তি ও নাগরিকদের স্বস্তির স্বার্থেই নিপীড়নের অবসান হওয়া প্রয়োজন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ