শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আমার সন্তানের আচরণ ঠিক আছে তো?

মাকসুদা সাকি : কোলে আমার শিশু ছেলে, মায়ের সাথে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। গাড়িতে যে আসনে বসেছি তার বিপরীতে ঢাকার নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (পোষাকে প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া) এইট নাইন এ পড়ে এমন বয়সি দুটি ছেলে বসে গল্প করছে। ওদের গল্পের বিষয় পরীক্ষা। পরীক্ষায় এক বন্ধু আরেক বন্ধুর খাতায় সব লিখে দিয়েছে, যে ছেলেটি শুনছে সে বলল কে  গার্ডে ছিলো রে? একটা অসম্মান জনক বিশেষন স্যারের নামের আগে যুক্ত করে নামটা জানালো সে। আরেকজন এবার একইকাজ করে বলল, সে থাকলে টের পেতি। তারপর অনেকক্ষন পড়াশুনা নিয়ে ই কথা বলল। আমি কথা শুনেই বুঝতে পারছিলাম দুজন ই ভালো স্টুডেন্ট তবে ভালো ছাত্র নয়। কারণ যত বার ই শিক্ষকদের প্রসজ্ঞ আসছে এদের দুজন ই কোনো শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে কথা বলছে না। এবার বলি প্রতিবেশি এক আপুর ছেলের কথা সেও ঢাকার মোটামুটি নামকরা এক প্রতিষ্ঠানে পড়ে। জে এস সি পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে মা কে জানালো আজ উমুক মার খাবে।  মা জানতে চাইলো সে কে?  বললো আরে আমাদের স্যার। পোলাপাইন শুধু পরীক্ষা শেষের অপেক্ষা করছিলো আজ শেষ তাই তারে ধোলাই দিবে।
এই দুটো আমাদের আশেপাশের খুব পরিচিত ঘটনা আর যখন এ লিখাটি লিখছি তখন পত্রিকার পাতায় দেখছি নবম শ্রেনীর ছাত্র প্রেমিকাকে পেতে নিজের সহপাঠীকে খুন করেছে। পত্রিকার মাধ্যমেই জানা কুমিল্লায় কিশোরদের একটা গ্যাংস্টার গ্রুপ তৈরি হয়েছে যারা চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে জমি দখল সব করছে তাদের নামে খুনের মামলাও আছে।
সত্যিই তো যারা শিক্ষকদের উপর শ্রদ্ধাবোধ রাখতে পারেনা তাদের দিয়ে তো এমন ঘটনা ঘটবেই,  ঘটতেই থাকবে সেটা স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও তফাৎ নেই। আমরা সেটি দেখতে পাচ্ছি মোটা দাগে, তরিকুল কে মারা হাতুড়ী মামুনরা কিংবা তানজীম স্যারের হুমকী দাতারা তো দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এর স্টুডেন্ট কিন্তু আচরণে কি কোনো মানবিকতা আছে এদের? উল্টো এরা চায় মরিয়মদের প্রকাশ্যে  ধর্ষণ করতে।
এমন  উগ্র আচরণ যারা করছে তারা কিন্তু মেধাহীন নয়, তারা মেধাবী।তারা স্কুল কলেজে ভালো রেজাল্ট করেছে এবং দেশ সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করছে।তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো কি শেখাচ্ছে আর ছেলেমেয়েরা কি শিখছে? নৈতিকতা শব্দটা কি শুধুই কাগুজে? নৈতিকতা বর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থার ফলেই এমন আচরন নিয়ে বড় হচ্ছে একটি শিশু যার প্রতিফল আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন পড়েছিলাম শিক্ষা গুরুর মর্যাদা সহ অনেক শিক্ষামুলক কবিতা এখন ওরা পড়ছে যাচ্ছো কোথা, চাংড়ি পোতা কিংবা রাম ঘটাঘট ঘেচাং ঘেং এর মত ইতং বিতং কবিতা। বই বেড়েছে তবে শিক্ষা বাড়েনি।আচরনে উগ্রতা বেড়েই চলেছে। আর এর প্রতিকারের জন্য প্রয়োজন পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। প্রতিটি শিশুর জন্য তার পরিবার আর তার চারপাশের পরিবেশ খুব গুরুত্বপূর্ন , মনে রাখতে হবে এটা তাদের প্রথম শিক্ষাক্ষেত্র। আমি সব জানি, আমি যা বলি সব ঠিকÍএমন মনোভাব অনেক সময় উগ্র মেজাজ দেখানোর কারণ হতে পারে। এজন্য শুরু থেকেই পরিবার থেকে ঠিক করে  দিতে হবে। বুঝাতে হবে বিনয়ের সঙ্গে প্রচুর আত্মবিশ্বাস অন্যের আকর্ষণের কারণ হয়, সবার কাছ থেকেই জীবনে কিছু শেখার থাকে। আমরা সবাই কোনো না কোনো সময় রাগি, আহত হই-এ অস্বাভাবিক নয়, রাগের প্রকাশ হবেই তো। কিন্তু তা অভ্যাসে দাঁড়াবে কেন?টিনএজে সন্তানের উগ্র আচরণ হতে পারে। দুর্বিনীত আচরণ, অসংযত খেয়াল টিনএজে বেশি। কিন্তু অনেকে এ থেকে বেরিয়ে আসে ভালো প্যারেন্টিংয়ের জন্য বা ভালো পরিবেশ এর জন্য।  এ বয়সে ভালো ভালো বই, ভালো সাংস্কৃতিক পরিবেশ কিংবা খেলাধুলা ও অনেক উপকার করে। প্রকৃতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ লালন-পালন। তাই বিভ্রান্তিতে, মেজাজের এই উত্তাল অবস্থায় দিশা দেখাতে পারেন মা-বাবা, গুরুজন, শিক্ষক ও মিডিয়া। অভিভাবকের স্নেহ-মমতা ভরা নিরাপত্তা ও আশ্বাস, নির্ভরতা-এভাবে টিনএজ থেকেই বড় হয়ে ওঠে সন্তান, বড় হয়ে সে দুর্বিনীত ও উদ্ধত আচরণ। সবকিছু নিজের মনমতো চলবে না,  অন্যের মত গ্রহণ করতে হবে এটা শিশুর মনে ঢুকিয়ে দেয়ার কাজটা বড়দের ই করতে হবে।হিংসা অনেক সময় উগ্র মেজাজের জন্ম দেয়। একে সামলানো উচিত।জাপানীরা বিনয়ী জাতি কারন ওরা শিশু মধ্যে তিনটা শব্দ ভালোভাবে ঢুকিয়ে দেয়।  সেগুলো হলো স্যরি, ধন্যবাদ আর আমি তোমাকে ভালোবাসি। ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি বলা, নিচুস্বরে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলা, অন্যের কথার মধ্যে বাধা না দেওয়া, আলাপ করা, অন্যের ভালো কাজের প্রশংসা করা, খেতে বসে শিষ্ট আচরণ করা-এসব কিছু আচরণ তৈরী করতে হবে শিশু থেকেই। সমাজ এসব নিয়ম-আচার পালনের প্রতি অতটা কঠিন নয়, আবার অনেকেই একে প্রশ্রয়ও দেয়। যার ফলেই আমাদের সমাজের এই অবস্থা। আমাদের সন্তানদের আচরন আমরা ঠিক করে দিলে ওরাও হয়ে উঠবে বিনয়ী।আমাদেরকে এত উগ্রতা দেখতে হবে না, হারাতে হবে না প্রিয়জনকে। প্রতিটি পরিবারকে ই হতে হবে সচেতন, দিতে হবে ভালো সমাজ তবেই পাবো ভালো রাষ্ট্র।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ