শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ভিকারুননিসায় জিপিএ-৫ বেড়েছে

মুহাম্মদ নূরে আলম : তখনও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা হয়নি। শিক্ষার্থী-অভিভাবরা আগ্রহ উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির গেটে অপেক্ষমাণ। প্রচন্ড গরম রৌদ্রের প্রহরতা মাথায় নিয়ে কলেজের ১ নং গেইটে সবাই অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দুপুর পৌনে ২টায় খুলে দেয়া হয় মূল গেট। আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার অপেক্ষায় তখনও শিক্ষার্থী অভিভাবকরা ও সংবাদ কর্মীরা। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বোর্ডে টানানো হয় ফলাফল শিট। অপেক্ষমাণরা ভিড় ঠেলে যখন কাক্সিক্ষত ফল দেখতে পান, তখনই উচ্ছ্বাস, আনান্দ আর হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠে পুরো ভিকারুননিসা ক্যাম্পাস। আবার কাক্সিক্ষত ফলাফল ভালো না করায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন অনেক শিক্ষার্থী। এদিকে খুব ভালো পরীক্ষা দেয়ার পরেও কাক্সিক্ষত ফল না পেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবককে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে এক শিক্ষার্থী জ্ঞান হারিয়ে ফেললে সতীর্থরা তার সেবা শুশ্রƒষা করে তাকে সুস্থ করে তোলে।

২০১৮ সালের উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৯৯.৭৮ শতাংশ পরীক্ষার্থী কৃতকার্য হয়েছেন। ১ হাজার ৮৫৩ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১ হাজার ৮৪৯ জন পাস করেছে এবং ৪ পরীক্ষার্থী ফেল করেছে। ১ হাজার ৮৫৩ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ৯৯৭ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ পেয়েছে, যা মোট পরীক্ষার্থীর অর্ধেকেরও কম জিপিএ ৫ পেয়েছে। তবে গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৯৫৪ জন আর এবার পেয়েছে ৯৯৭ জন। গতবার পাসের হার ছিল ৯৯ দশমিক ৬২ শতাংশ আর এবার পাসের হার ৯৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ । গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে কলেজের নোটিশ বোর্ডে প্রকাশিত ফলাফল থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞান বিভাগের ১ হাজার ৪০০ জনের মধ্যে ৯২৩ জন, মানবিকের ২৩৩ জনের মধ্যে ২২ জন ও বাণিজ্যিক বিভাগের ২২২ জনের মধ্যে ৫২ জন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এ বছর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নিয়েছে মোট ১৪০০ জন। এ ছাড়া মানবিকে ২৩৩, ব্যবসায় শিক্ষা ২২০ জন। এরমধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেছে ১৩৯৮ জন, মানবিকে ২৩১ এবং ব্যবসায়ী শিক্ষায় ২২০ জন। বিজ্ঞান ও মানবিকে দুইজন করে মোট চারজন ফেল করেছে। বিজ্ঞানে পাসের হার ৯৯ দশমিক ৮৫, মানবিকে ৯৯ দশমিক ১৪ ও ব্যবসায়ী শিক্ষায় শতভাগ পাস করেছে।

গত বছরের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ফলাফল: গত বছর জিপিএ-৫ এর হার ৫২.৩৮ শতাংশ । এ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ১ হাজার ৮২১ ছাত্রীর মধ্যে ৩ জন বাদে সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগের ওই ৩ ছাত্রী অনুপস্থিত ছিল। পাসের হার ৯৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১ হাজার ২৮৮ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯২১ জন। মানবিক বিভাগে ২৪৩ জনের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১০ জন। ব্যবসা শাখায় ২৯০ জনের মধ্যে ২৩ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।

এই বছর বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া অহনা মাহিন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমার পরীক্ষা একটু খারাপ হওয়ায় জিপিএ-৫ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। ফল দেখে নিশ্চিত হলাম। এজন্য শিক্ষকদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। দেশে প্রশ্ন ফাঁস না হলে ভিকারুননিসা নুনের মেয়েরা ভালো ফল করে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস। গতকাল বৃহস্পতিবার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা বরাবরের মতো ভালো ফল করায় এবং গতবারের চেয়েও বেশি জিপিএ-৫ অর্জন করায় উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেছেন তিনি।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস বলেন, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস বলেন, এ বছর এইচএসসিতে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৮৫৩। যার মধ্যে পাস করেছে ১৮৪৯ জন। ফেল করেছে চারজন। আর মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ৯৯৭ জন। এ বছর পাসের হার ৯৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। গতবারের তুলনায় এ বছর জিপিএ ৫ এর সংখ্যা ৪৫টি বেশি। এ ছাড়া পাসের হার অন্যান্য স্কুলের তুলনায় বেশি।

গত বছরের তুলনায় এবার এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার কিছুটা কমেছে। কিন্তু এই ফল বিপর্যয়ের মধ্যেও ভিকারুননিসার মেয়েদের ফল খুবই ভালো। গত বছরের চেয়েও এবার এই কলেজের ৪৩ জন ছাত্রী জিপিএ-৫ বেশি পেয়েছে।

তিনি জানান, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে পাসের হার ৯৯.৮৫, মানবিক শাখায় পাসের হার ৯৯.১৪। আর ব্যবসায় শিক্ষায় পাস করেছে শতভাগ শিক্ষার্থী। এবার এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র চারজন শিক্ষার্থী ফেল করেছে। ভালো রেজাল্টের কারণ হিসেবে তিনি জানান, মূলত নিয়মানুবর্তিতা, শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম, শিক্ষার্থীদের পাঠে মনোযোগিতা থাকায় সব মিলিয়ে ফল ভালো হয়েছে। যারা জিপিএ-৫ যারা পায়নি তাদের সম্পর্কে বলেন, জিপিএ-৫ তো জীবনের সব কিছু নয়। তাদের সামনে আরও অনেক সুযোগ আছে। জীবনে নিয়মানুবর্তিতা ও একাগ্রতা থাকলে তারাও অনেকদূর যেতে পারবে। এদিকে, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের উল্লাস ছিল ফল ঘোষণার পর থেকেই ক্যাম্পাসজুড়ে। তাদের একজন আনিসা হোসেন জানান, এ রেজাল্ট আমার, আমার বাবা-মা ও শিক্ষকদের পরিশ্রমের ফসল। তিনি ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চান। আর ভালো ফলকারী ছাত্রীদের অভিভাবকদের চোখে ঝরছে আনন্দের ফলগুধারা। এমনই একজন অভিভাবক আনিসার মা মমতাজ বেগম বলেন, মেয়ের রেজাল্টে আমি ভীষণ খুশি। আনন্দে কাঁদছি। সে যে এত ভালো ফল করবে তা বুঝতে পারিনি। আমি চেয়েছিলাম মেয়েকে ডাক্তার বানাবো। কিন্তু মেয়ে হতে চায় ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে আমার যা হতে চায় তাই হতে দেবো।

আরেক ছাত্রী ফারিয়া চৌধুরী লিসা জিপিএ-৫ অর্জন করায় তার মা সুলতানা লাকি চৌধুর বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে। দুজনই স্কলার। আমি গর্বিত দুই মেয়েকে নিয়ে। ছোট মেয়ের এমন রেজাল্টে আনন্দের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এবারের প্রশ্নপত্রে অনেক ভুল ছিল, পরীক্ষার সময়ে ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল, পরীক্ষার হলের জানালার কাচ ঝড়ের আঘাতে ভেঙে গিয়েছিল। এত সমস্যার মধ্যেও আমার মেয়ে মনোবল না হারিয়ে ভালো ফল করেছে। এতে আমার আনন্দের ভাষা নেই।

এদিকে কলেজ ক্যাম্পাসে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নেচে-গেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হতে থাকে কাঙ্কিত ফল পাওয়া শিক্ষার্থীরা। আনন্দে শামিল হন অভিভাবকরাও। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বিগ ড্রাম, স্ট্রিকের তালে তালে তাল মেলাতে থাকে। পুরো ক্যাম্পাসে যে সবাই উচ্ছ্াসিত ছিল তা কিন্তু নয়, কাঙ্কিত ফল না পেয়ে কেঁদেছেনও অনেকেই। যারা তাদের কাঙ্কিত ফল (এ প্লাস) অল্পের জন্য পায়নি তাদেরও কেউ কেউ কেঁদেছেন সিড়িতে বসে, কেউবা ফোনে কেঁদে কেঁদে অভিভাবকদের জানিয়েছেন কাঙ্কিত ফল না পাওয়ার কথা।

কাঙ্কিত ফল পেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে অংশ নিয়েছেন শিক্ষার্থী প্রীতি হক। তিনি বলেন, নিজের পরিশ্রম আর বাবা, মা ও শিক্ষকদের যতেœর কারণেই কাঙ্ক্ষিত ফল পেয়েছি। এ ফল আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সামনে এগিয়ে যেতে আরও আগ্রহী করে তুলেছে। শিক্ষার্থীদের আনন্দ আর উচ্ছ্াস দেখছিলেন অভিভাবক পূবালী দাস। নিজের মেয়ের কাঙ্কিত ফলের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার মেয়ে কাঙ্কিত ফল পেয়েছে। এর ফলে তার পরিশ্রমের পাশাপাশি আমাদের এবং প্রতিষ্ঠানের যতœ সার্থক হয়েছে।

ঠিক একই সময় কাঙ্কিত ফল না পেয়ে সিড়ির কোণায় কাঁদছিলেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীরা। তাদের মধ্যে একজন জিমি আক্তার। তিনি পেয়েছেন ৪ দশমিক ২৫। জিমি বলেন, এবার অনেকেরই ফল খারাপ হয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পরীক্ষার রুটিনে কোনো গ্যাপ ছিল না, আমাদের টানা পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রশ্নপত্রও তুলনামূলক কঠিন ছিল। উল্লেখ্য, উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় এবার ৬৬.৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন, যাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৯ হাজার ২৬২ জন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ