বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

একক নির্ভরতায় পিছিয়ে পড়ছে মৌলিক রফতানি খাত

এইচ এম আকতার: দেশের রফতানি খাতকে গ্রাস করছে  পোশাক খাত। অতিমাত্রায় তৈরি  পোশাক নির্ভরতায় পিছিয়ে পড়ছে অন্যান্য রফতানি খাত। জিএসপি সুবিধা কিংবা মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কারণে যদি তৈরি  পোশাক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে তাহলে ভেঙ্গে পড়বে দেশের রফতানি খাত। কোন একটি খাতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে রফতানির অন্য খাতকেও প্রধান্য দিতে হবে।
সর্বশেষ অর্থবছরে তৈরি পোশাক থেকে মোট রপ্তানির সাড়ে ৮৩ ভাগ আয় হলেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে রপ্তানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে। এছাড়াও সম্ভাবনাময় প্লাস্টিক ও প্রকৌশল পণ্য, হিমায়িত খাদ্যেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে গত অর্থবছরে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে পোশাক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে মনোযোগী হতে হবে অন্য সব খাতেই। বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশ। যেখানে মোট রপ্তানির ৩৪ থেকে ৩৬ ভাগ চীনের দখলে। তাই পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের শীর্ষ এ খাতে অপার সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে আয় বাড়ানোর।
জানা গেছে, আসলে তৈরি  পোশাক আমাদের মূল ধারার কোন রফতানি পণ্য নয়। বৈদেশিক কাপড় এমনকি সকল এক্সেসরিজ বাইরে থেকে আমদানি করা হয়, বাঙলাদেশ শুধু দর্জির কাজটা করে। আর এ কাজের জন্য গোটা ক্রেডিট পাচ্ছে বাঙলাদেশ। অথচ কি পরিমাণ কাপড় ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করা হচ্ছে তা রফতানি থেকে বাদ না দিয়েই গোটাই রফতানি আয় হিসেবে ধরা হচ্ছে। এতে করে আমাদের এক সময়ের কৃষি,চামড়া,চা,মৎস খাতের মত গুরুত্ব খাত পিছিয়ে পড়ছে। একইভাবে হারিয়ে গেছে আমাদের পাট খাতও। রফতানির মৌলিক খাতগুলোকে গুরুত্ব না দিলে পাট খাতে মত অতীত ইতিহাস হয়ে থাকবে আগামী প্রজম্মের কাছে। যা কারো কাছে কাম্য নয়।
জানা গেছে, মধ্যম আয়ের দেশের পথে বাংলাদেশ। যদি সফল হয় তাহলে জিএসপি সুবিধা ২০২৪ সাল থেকে আর পাবে না বাংলাদেশ। কোটা আর শুল্ক সুবিধাসহ অনেক ইতিবাচক সুবিধা হারাতে হবে বাংলাদেশকে। তখন বিশ্ব প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে দেশের তৈরি  পোশাক খাত। একইভাবে দেশে শ্রমিকের দাম বেড়ে গেছে তৈরি  পোশাক পিছিয়ে পড়তে পারে। মুলত যে হারে শ্রমিকের দাম দেয়ার কথা তা দিচ্ছে না  পোশাক মালিকরা। আর এ কারনেই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে পোষাত খাতে।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে প্রথমবারের মতো এ খাতের রপ্তানি ছাড়িয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলার যা কিনা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও খানিকটা বেশি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে পৌনে ৯ শতাংশ। পোশাক খাতে রপ্তানির এমন সন্তোষজনক অগ্রগতি নিয়ে বিজিএমইএ জানায়, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে গত কয়েক বছর ধরে চলা সংস্কার কাজের সুফল মিলতে শুরু করেছে রপ্তানি আয়ে। বিজিএমইএর এই নেতা জানান, রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আসছে নির্বাচনী বছরে নির্বাচন নিয়ে যতনা শঙ্কা, তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট, বন্দর ও অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করা। পোশাক খাতের হাত ধরে দেশের সামগ্রীক রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ছবি স্বস্তি দিলেও অস্বস্তিও কম নেই রপ্তানির অন্যান্য খাতগুলোতে। যেখানে সম্ভবনাময় অনেক খাতের রপ্তানি বরং আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এই যেমন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১২ শতাংশ।
প্লাস্টিক পণ্যে কমেছে পৌনে ১৬ শতাংশ। এছাড়াও প্রকৌশল পণ্যে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫০ ভাগ। তাই শুধু পোশাক নির্ভর না হয়ে রপ্তানির এমন সম্ভাবনাময় খাতে মনোযোগ বাড়ানোর পরামর্শ বিশ্লেষকদের। সবশেষ অর্থবছরে হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিতেও প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ।
এবছর রফতানি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। কিন্তু এ সন্তুষ্টি শুধু তৈরি পোশাক শিল্প খাতনির্ভর। অতৃপ্তি হলো লক্ষ্যমাত্রায় ঘাটতি এবং অর্থবছরের শেষ মাস জুনে লক্ষ্যমাত্রা ও প্রবৃদ্ধি দুটোই নেতিবাচক। চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য, পাট ও পাটজাতপণ্যসহ বেশির ভাগ রফতানি পণ্যের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা সদ্যবিদায়ী অর্থবছর ২০১৭-১৮ অর্জিত হয়নি। ফলে সার্বিকভাবে লক্ষ্যমাত্রায় এবারে ঘাটতি হলো ৮৩ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার বা ২ দশমিক ২২ শতাংশ।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো বিদায়ী অর্থবছরে তার অর্জিত আয়ের সর্বশেষ হিসাব প্রকাশ করে। তাদের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছর রফতানি থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন হাজার ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে প্রকৃত অর্জন তিন হাজার ৬৬৬ কোটি ৪১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর প্রাথমিক পণ্য খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। এখানে সবচেয়ে বড় আয় এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন হাজার ১৬ কোটি ডলার, যার বিপরীতে প্রকৃত অর্জন তিন হাজার ৬১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। এই খাতে প্রবৃদ্ধি হলো ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ। গত অর্থবছর তৈরি পোশাক খাতে আয় হয়েছিল দু’হাজার ৮১৪ কোটি ৯৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার।
নিটওয়্যার খাতের পণ্য রফতানিতে এক হাজার ৫১৮ কোটি ৮৫ লাখ ১০ ডলার আয় হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে, যা ল্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি। আর নিট খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্য দিকে ওভেন গার্মেন্ট পণ্য রফতানিতে এক হাজার ৫৪২ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় হয়েছে, যা ল্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি হিমায়িত খাদ্যেও। এখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৪দশমিক ৯৭ শতাংশ, পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যে ৮৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, চামড়া ও চামড়াজাতপণ্যে ২১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, পাট ও পাটজাত পণ্যে ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ, হোমটেক্সটাইলে শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ, অন্যান্য ফুটওয়্যার খাতে ৯. দশমিক ৬ শতাংশ এবং প্রকৌশল পণ্য খাতে ৫৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, একক মাস হিসেবে জুনে রফতানি আয় বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। ওই মাসে আয়ের ল্যমাত্রা অর্জিত হয়নি, কমেছে প্রবৃদ্ধিও। জুনে রফতানি আয়ের ল্যমাত্রা ছিল ৩৬২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ২৯৩ কোটি ৯৩ লাখ মার্কিন ডলার, যা ল্যমাত্রার চেয়ে ১৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ কম। এমনকি তার আগের অর্থবছরের চেয়েও প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ০৮ শতাংশ কম অর্জিত হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও বিআইডিএসের সাবেক ডিজি ড. মুস্তফা কে মুজেরীর মতে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়ন, বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো। এখানে যাতায়াতে সময় বেশি লাগে। তৈরি পোশাক খাতে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমরা শুধু মূল্য কম পণ্য রফতানি করি। কিন্তু মূল্যবেশি পণ্যে আমাদের রফতানি কম। তিনি বলেন, এখানে শ্রমের মজুরি কম। আমাদের ব্যবসায় ব্যয় কমাতে হবে। আমরা তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়ের ৮০ শতাংশ পাচ্ছি। কিন্তু একক পণ্যের ওপর থেকে আমাদের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। রফতানি বহুমুখীকরণ করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক পণ্য খাতে যত বেশি প্রবৃদ্ধি হোক না কেন কোনো লাভ নেই। কারণ আমাদের রফতানির বড় অংশ আসে ম্যানফ্যাকচারিং খাত থেকে। সেখানে আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিযোগী দেশগুলো অনেক এগিয়ে গেছে। সে তুলনায় আমরা এগোতে পারছি না।
এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীর মতে, দেশের রফতানি খাতগুলোর বেশির ভাগেরই ল্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। সব খাতকে ভালো করতে হলে সরকারের উচিত সার্বিকভাবে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতার বাজারে আমাদের টিকে থাকা কষ্টকর হচ্ছে। কারণ মজুরি বৃদ্ধির কারণে এখানে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় ১৭ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে পণ্যমূল্যের ওপর।
তার মতে, এ দেশের তৈরি পোশাক শিল্প একটা চাপের মধ্যে রয়েছে। আমাদের সমতা টিকিয়ে রাখা এখন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্সের শর্তানুযায়ী এ শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারকাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
সিপিডি’র ফেলো ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কোন একক খাতের ওপর নির্ভর একটি দেশ বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। রফতানির সব খাতকে সমান তালে এগিয়ে আনতে হবে। তা না হলে এই বাজারের পরিধি আরও বাড়বে। প্রযোজনে তৈরি  পোশাক খাতের মত অন্য খাতের ওপরও নজর বাড়াতে হবে।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড.জাহিদ হোসেন বলেন ,আমাদের রফতানির সকল খাতকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। তৈরি  পোশাক খাতে যেভাবে সরকার প্রনোদনা দিয়ে একইভাবে রফতানির অন্য খাতে এসব সুবিধা দিতে হবে। তা না হলে রফতানি বড় ধরনের ঝুকিতে পড়তে পাড়ে ভবিষতে। এখনই সময় সরকারকে সমান ভাবে নজর দিতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ