বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সড়ক-মহাসড়কে সংঘটিত দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি ও প্রতিকার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : যানবাহন আধুনিক সভ্যতার একটি অপরিহার্য অংশ। এর অবিচ্ছেদ্য অংশ যানবাহন পরিচালনা। ড্রাইভার বা চালক এ ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাই যানবাহন চালকদের নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠেছে স্বতন্ত্র বিভাগ ও নিজস্ব ট্রাফিক আইন, যাকে আমরা ট্রাফিক আইন হিসেবে জানি। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ট্রাফিক আইনে যানবাহন চালক বা ড্রাইভারের যোগ্যতা, দক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও তার কর্তব্য বিষয়ে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। কেননা বিষয়টি সরাসরি মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামি শরীআহর অন্যতম উদ্দেশ্য হল ‘হিফযুন নাফস’ বা জীবন সংরক্ষণ। এ কারণে ইসলাম জীবন সংরক্ষণ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি বিধান প্রণয়ন করেছে। সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে চালিত বিভিন্ন যানবাহন এবং অন্যান্য যান্ত্রিক পরিবহন পরিচালনার ক্ষেত্রেও ইসলাম প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও বিধান নির্ধারণ করেছে। ইসলাম প্রদত্ত এ সব বিধানের আলোকে সমসাময়িক ড্রাইভিং সংক্রান্ত বিধি বিধান নিরুপন করা সময়ের অনিবার্য দাবি। এ প্রেক্ষাপটে সামনে রেকে বক্ষ্যমান প্রবন্ধে ইসলামী শরীয়ার আলোকে যানবাহন ড্রাইভিং ড্রাইভার বা যান চালকের যোগ্যতা দায়িত্ব কর্তব্য, নিরাপদ সড়ক, ট্রাফিক আইন, যানবাহন তথা গাড়ির বৈশিষ্ট্য এবং দূর্ঘটনার দায় ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধটি রচনার ক্ষেত্রে বর্ণনামূলক (Descriptive Method) ও অবরোহ পদ্ধতি (Deductive Method) অনুসরণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শরয়ী বিধান আলোচনার ক্ষেত্রে বর্ণনামূলক পদ্ধতি এবং শরীআহ নির্ধারিত বিধানের বাস্তব অনুশীলনের পদ্ধতি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অবরোহ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রবন্ধটির মাধ্যমে যানবাহন চালনা সংক্রান্ত শরয়ী বিধান অবগত হওয়ার পাশাপাশি দূর্ঘটনা এড়ানো জন্য করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা পাওয়া যাবে।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তনকে সামনের রেখে এবং যোগাযোগ ও চলাচলের ক্ষেত্রে পুরোনো অনেক পন্থা অচল হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ইসলামি ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে ড্রাইভিং এর মত আধুনিক বিষয়ের আলোচনা এবং এর সাথে সামঞ্জ্যসপূর্ণ বিধি বিধান নিরুপণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন কারণে ড্রাইভিং ষিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। বর্তমানে যন্ত্রচালিত বাহন মানুষের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এর জনপ্রিয়তা ও সহজলভ্যতার কারণে যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যম এখন অচল হতে বসেছে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে প্রতিনিয়তই এক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘঠছে। তবে প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও সম্প্রসারণের সাতে সাথে এর ঝুঁকি ও বৃদ্ধি পাচ্ছে সমান গতিতে। প্রতিদিনই বিভিন্ন দূর্ঘটনা ও ড্রাইভিং সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সকল মহল। যার শরয়ী বিধান উদ্ভাবিত হওয়া প্রয়োজন। ইসলামে মানবতার কল্যাণ ও জীবনঘনিষ্ঠ সব বিষয়ে বিধি বিধান রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষের চলাচল ও জনপথ সংশ্লিষ্ট সূক্ষাতিসূক্ষ্ম বিষয়ের বিধানেরই ক্ষেত্রে ও গুরুত্বরোপ করা হয়েছে। এগুলো সম্পর্কে সরাসরি কুরআন সুন্নাহ নির্দেশনা এসেছে এবং ইসলামি ফিকহের গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা বিধৃত হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের বর্ণনাময় তাদের চলাচলের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন।
“রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে বিনম্রভাবে চলাচল করে করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে সালাম”। “আল-কুরআন, ২৫:৬৩।” লুকমান আ. তাঁর পুত্রকে দেয়া উপদেশের মধ্যে  চলাচলের পদ্ধতি ও শিক্ষা দিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ উক্ত  উপদেশ উল্লেখ করেছেন: “পৃথিবীতে ঔদ্ধত্যসহকারে বিচরণ করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্ধ্যত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। চলাচলে সংযত হও এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু করো, নিশ্চয় গাধার আওয়াজই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর আওয়াজ”। “আল-কুরআন, ৩১: ১৮-১৯।”
এ ব্যাপারে আল্লাহ সরাসরি নির্দেশ: “ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না, তুমি তো কখনই ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না বরং উচ্চতায় কখনই পর্বত সমান হতে পারবে না; এগুলোর মধ্যে যেগুলো মন্দ সেগুলো তোমার প্রতিপালকের নিকট ঘৃণ্য।” “আল-কুরআন, ১৭:৩৭-৩৮।”
মহানবী স. রাস্তার হক ও চলাচলের শিষ্টাচার বর্ণনায় বলেছেন: “তোমরা রাস্তায় বসা থেকে বিরত থাক। তাঁরা (সাহাবা কিরাম) বললেন হে আল্লাহর রাসূল! এ ছাড়া আমাদের কোন  উপায় নেই। কেননা এটাই আমাদের বসার জায়গা, যেখানে আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। তখন রাসূলূল্লাহ স. বলেন বসা ছাড়া তোমাদের যেহেতু গত্যন্তরে নেই সেহেতু তোমরা রাস্তার হক আদায় কর। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন রাস্তার হক কী? তিনি বললেন দৃষ্টি অবনত রাখা কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ, সালামের প্রতিউত্তর, সৎকর্মের আদেশ ও অসৎকর্মের নিষেধাজ্ঞা প্রদান। “আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইসমাইল আল বুখারী, আল জামি আসসাহীহ (দামিশক: দুরু ইবন কাছীর, ৪র্থ প্রকাশ, ১৪১০ হি.), কিতাবুল মাজালিম ওয়াল গাসব, বাবু আফনিয়্যাতুদ দুরি ওয়াজ জুলুস ফীহা,হাদীস নং ২২৯৭:মুসলিম বিন আল-হাজ্জাজ, আসসাহীহ (বৈরুত: দারুল মা‘রিফ, ৩য় প্রকাশ ১৪১৭ হি.), কিতাবুল লিবাস ওয়ায যিনাহ, বাবুন নাহী আনিজ জুলুস ফীত তারিকাত, হাদীন নং২১২১।” এই সামগ্রিক নির্দেশনার ভিত্তিতে ইসলামী আইনে ড্রাইভিং সংশ্লিষ্ট বিধি বিধান উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং ফকীহগণ তাদের গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে সেগুলো আলোচনা করেছেন। ড্রাইভিং এর প্রয়োজনীয়তা উপাদান : ড্রাইভিং এর কয়েকটি প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে। বিশেষজ্ঞগণের দৃষ্টিতে এগুলোর সমন্বিত রুপই ড্রাইভিং। নিম্নে ড্রাইভিং এর প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হলো:
নিরাপদ সড়ক : নিরাপদ সড়ক ছাড়া ড্রাইভিং অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর অভাবে দূর্ঘটনা বৃদ্ধি পায়। ইসলামের দৃষ্টিতে, রাস্তা সকল মানুষের সম্মিলিত ভোগের বস্তু। সুতরাং প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে রাস্তায় চলাচল করা এবং দাঁড়ানোর। প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে রাস্তা সংশ্লিষ্ট সকল উপকার গ্রহণ করার, তা নিজ জন্তু বা গাড়ির মাধ্যমে হোক। তবে শর্ত হল যে ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব সে ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া এবং সে ক্ষতি সংঘটনের আশংকা মুক্ত রাখা। এ ব্যাপারে মুলনীতি হল: “ক্ষতি সমূহ থেকে যথাসম্ভব নিরাপদে বেঁচে থাকার শর্তে রাস্তায় চলাচল করা বৈধ।”
একাধিক ফকীহ এ শব্দে কায়িদাটি উল্লেখ করেছেন। আর কোন কোন ফকীহ এর মর্মার্থ উল্লেখ করেছেন।“মুহাম্মদ আমীন ইবনু আবিদীন, রাদ্দুল মুহতাব আলাদ দুররিল মুখতার (কায়রো: মাকতাবাতু মুস্তাফা আল-বাবী আল হালবী, ২য় প্রকাশ, ১৩৮৬হি.), খ.৬,পৃ.৬০২; মুহাম্মদ বিন আহমদ আর-রমালী, নিহায়াতুল মুহতাজ (কায়রো: মাকতাবাতু মুস্তাফা আল বাবী আল হলবী  ১৩৮৬ হি.), খ. ৫, পৃ.৩৪২; ইবনু কুদামা, আল মুগনী (কায়রো: দারুল হিজরাহ, ২য় প্রকাশ ১৪১০ হি.), খ.৮.পৃ.১৬১; আলী হায়দার, দুরারুল হুক্কাম শরহু মাজাল্লাতুল আহকাম (বৈরুত; দারুল জাইল, ১৪১১ হি.), খ.১.পৃ.৬৩৯, (ধারা ৯৩২)।” সুতরাং বিষয়ের বিচারে সকল ফকীহ এ কায়িদার ব্যাপারে একমত। পূর্বেই রাস্তা হক সংক্রান্ত হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। যা থেকে রাস্তার নিরাপত্তার অপরিহার্যতা ফুটে ওঠে।
নিরাপদ সড়কের ব্যাপারে মহানবী স. এর নিম্নোক্ত বাণী উল্লেখযোগ্য: “মুসলমানদের কোন পথে বা কোন বাজারে যদি কেউ কোন জন্তু দাঁড় করিয়ে রাখে এরপর জন্তুটি যদি সামনের বা পেছনের পা দিয়ে কোন কিছু মাড়ায় তাহলে মালিক ক্ষতিপূরণ দেবে” “আলী বিন উমর আদদারাকুতনী, সুনান আদদারাকুতনী (কায়রো: দুরুল মাহাসিন, ১৩৮৬ হি.) খ.৩.পৃ.১৭৯। এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের একজন হল সারিযু বিন ইসমাঈল আল হামদানী। তার বর্ণনা পরিত্যাগযোগ্য। (ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব,খ,৩.পৃ.৪৫৯) তবে শরয়ী নীতিমালা  বিষয়টিকে সমর্থন করে। সামনে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।” এ বিষয়টি মাজাল্লাতুল আহকামিল আদলিয়্যার ধারা ৯৩২ এ স্পষ্টভাবে আলোচিত হয়েছে।
“সর্বসাধারণের চলাচলের পথে প্রত্যেকের নিজ জন্তুসহ চলাফেরার অধিকার রয়েছে। এ কারণে চলাচলকারী ব্যক্তি নিজ বাহনে আরোহী অবস্থায় সে ক্ষতি ও দূর্ঘটনার দায়ভার নেবে না যে ক্ষতি ও দূর্ঘটনা থেকে তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। “হায়দার, দুরারুল হুক্কাম, খ.২.পৃ. ৬৩৯; ইবন আবিদীন, রদ্দুল মুহতার, খ.৬.পৃ.৬০৪; ড. ফাওযী ফয়যুল্লাহ, নাযারিয়্যাতুয যামান ফীল ফিকহিল ইসলামী (কুয়েতে : দারুত তুরাছ, ২য় প্রকাশ, ১৪০৬ হি.) পৃ.১৭৯।”
দ্বিতীয় খলিফা উমর রা. বলতেন আমার ধরণা যদি ফুরাতের তীরে কোন ছাগী পথ হারিয়ে মারা যায় তবে আল্লাহ আমাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। “আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া *বৈরুত; দারুল কিতাবিল আরাবী, ৫ম সংষ্করণ ১৪০৭ হি.), খ.১.পৃ.৫৩, ইবন সা‘দ আততাবাকাতুল কুবরা, খ.৩.পৃ. ৩০৫।”
ত্রুটিমুক্ত গাড়ি : নিরাপদ ড্রাইভিং এর জন্য ক্রুটিমুক্ত গাড়ি প্রয়োজন। কেননা গাড়িতে ক্রুটি থাকলে যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য ড্রাইভিং এর পূর্বে ভালভাবে গাড়ির ক্রুটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। গাড়ির ক্রুটির কারণে কোন দূর্ঘটনা ঘটলে তার দায় ড্রাইভারকে বহন করতে হবে। প্রতিটি দেশের ট্রাফিক আইন ও নির্দেশনায় রাস্তায় চলাচলে উপযুক্ত গাড়ির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়।
পূর্ণাঙ্গ ট্রাফিক আইন : একটি পূর্ণাঙ্গ ট্রাফিক আইন ড্রাইভিং এর মূলভিত্তি। এ আইনের কোন ধারা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে তা পালন করা অবশ্য কর্তব্য। এ ব্যাপারে মাজমাউল ফিকহিল ইসলামির সিদ্ধান্ত। (৭৫/২/ঘ:৮) ঃ “সড়ক আইনের যে বিষয়গুলো ইসলামী শরীআহর সাথে সাংঘর্ষিক নয়, সে বিষয়গুলো মেনে চলা আবশ্যক। কেননা এ আইন মেনে চলা শাসকের সামগ্রিক আনুগত্যের অর্šÍভুক্ত। এর ভিত্তি হল মাসালিহে মুরসালাই “মাসালিহ মুরসালাহ বলা হয় ঐসব বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলিকে যা শারী‘আত প্রণেতার উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ, কিন্তু তা গ্রহণ বা পরিত্যাগ করার পক্ষে বিপক্ষে কোনো দলীল নেই। অথচ তা বিবেচনায় এনে কোনো বিধান প্রণয়ন করলে মানুষের কল্যাণ সাধিত অথবা অকল্যাণ দূরীভূত হয়। দ্রষ্টব্য: মুহাম্মদ রুহুল আমিন, ইসলামী  আইনের উৎস (ঢাকা, বাংলাদেশ ইসলামিক ল‘রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার, ২০১৩ খ্রি.),পৃ.১৫০।” এ আইন শরীআহে অপরাধ প্রতিরোধের যে মূল ধারা ও উপধারা রয়েচে তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। যা জনসাধারণের কল্যাণের বিবেচনায় আইনের এ অধ্যায়ে করা সম্ভব। এর অন্যতম একটি হল আর্থিক দন্ড। যে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করবে তার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ করা যেতে পারে, যেন সড়ক ও মহাসড়কে যে সব চালক সবাইকে বিপদের মুখোমুখী করে তারা নিবৃত্ত হয়”। “শাবাব (সাময়িকী), সংখ্যা .১৩.যুলহিজ্জাহাজ, ১৪২০হি.।” ড্রাইভিং এর জন্য প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স গ্রহণ এ আইনের একটি অংশ।
ড্রাইভারের দায়িত্ব ও কর্তব্য : ইসলামী শরী’আহর আলোকে ড্রাইভারের প্রধান দায়িত্ব ট্রাফিক আইন মানা। কেননা সরকার ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণার্থে এবং জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে এ আইন প্রণয়ন করেছে। এ প্রসংগে ট্রাফিক আইন মানা শাসকের নির্দেশ মান্যকরনের আওতাভুক্ত। “ওহাবাব আল যুহাইলী, আল ফিকহুল ইসলামী ও আদিল্লাতুহু (দামিশক: দারুল ফিকর ৩য় সংষ্করণ, ১৪০৯ হি.), খ.৬.পৃ.৭০৪।”
শাসকের অনুসরনের অপরিহার্যতা শরীয়তের উৎস ও বিধিবিধানের মূলসূত্র আল-কুরআনুল কারীম থেকে প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বলেন: হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর আনুগত্য করো রাসূলের এবং তাদের তোমাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী।“আল-কুরআন, ০৪: ৫৯। ” কাযী ইবনুল আরাবী (৪৬৮-৫৫৩ হি. বলেন, আনুগত্যের সারকথা হল নির্দেশ পালন করা। যেভাবে অবাধ্যতার সারকথা হল নির্দেশ অমান্য করা। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আমার মতে আয়াতের বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা হল উলিল আমর’ দ্বারা উদ্দেশ্য শাসকবৃন্দ ও আলিম সমাজ।“ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন (বৈরুত: দারুল মা‘রিফা, সনবিহীন), খ.১,পৃ.৪৫১; আবুবকর আল জাসসাস, আহকামুল কুরআন (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ সনবিহীন), খ.২.পৃ,২৬৪; ইবন হাজর আল আসকালানী, ফাতহুল বারী (কায়রো: দারুর রাইয়্যান, ২য় প্রকাশ, ১৪০৯ হি.) খ.১৩,পৃ.১২০।” এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আয়াতে আল্লাহর আনুগত্য রাসূলের আনুগত্যের সাথে উলূল আমরের মাঝে গভীর যোগসূত্র রয়েছে। রাসূলূল্লাহ স. এই গভীর যোগসূত্রকে সুস্পষ্ট করেছেন এই বলেন: “যে আমার আনুগত্য করবে সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্য হল সে আল্লাহর অবাধ্য হল। যে শাসকের অনুসরন করল সে আমার আনুগত্য করল। আর যে শাসকের অবাধ্য হল সে আমার অবাধ্য হল। “ইমাম বুখারী আসসাহীহ আহকাম অধ্যায় বাব হাদীস নং (৬৭১৮); মুসলিম আসসহীহ, ইমারাত অধ্যায়, আল্লাহর নাফরমানী না হলে শাসকের আনুগত্য আবশ্যক, হাদীস নং (৪৭২৪)। উল্লিখিত হাদীসের শব্দ সহীহ মুসলিমের।”
অতএব, ড্রাইভারের উচিত, ড্রাইভিং এর সময় ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ করা ও যে কোন প্রকার ক্ষতিসাধন থেকে দূরে থাকা। দুটি ক্ষতির একটিকে গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ালে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির বিষয়টি অবলম্বন করা।
ড্রাইভিং এর ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা : ট্রাফিক আইন মানার প্রথম দায়িত্বশীল ব্যক্তি হলেন চালক। মানুষের জানমাল রক্ষার্থে এবং ট্রাফিক সর্বসাধারণের কল্যাণার্থে শাসক যে আইন করেন তা মেনে চলতে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন। এর পাশাপাশি এ আইন সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা ও নিরাপদ ড্রাইভিং এর ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের কর্তব্য রয়েছে। আইনটি নিষ্ঠার সাথে প্রয়োগ করা পুলিশের নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য। তিনি মানুষের মাঝে কোন প্রকার বিভেদ ছাড়া, ব্যক্তি পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং উত্তম চরিত্রের গুণাবলি ধারণ করে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করবেন। এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ইসলামে মুহতাসিবের “মুহতাসিব অর্থ হিসবাহ কার্যক্রম পরিচালনাকারী। হিসবাহ বলা হয়, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের নীতিমালার ভিত্তিতে চলমান শরীআহ তথা আইন বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধ এবং শরীআহ ভিত্তিক জীবনযাপনের দিকে প্রত্যাবর্তনের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামোকে। দ্রষ্টব্য: মুহাম্মদ রুহুল আমীন, শরীআ আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নীতিমালা ও আল হিসবাহ : একটি পর্যালোচনা”  ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, বর্ষ ৫৫, সংখ্যা ২, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১৫, পৃ.৩১”  ভূমিকার ন্যায় । তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত বিষয়ে লোকদের উপর কোন কষ্ট চাপিয়ে দেবেন না। অপরদিকে নিজ কর্তব্য পালনে কোন শিথিলতা প্রদর্শন করবেন না। সড়ক দূর্ঘটনার দায় আলোচনার পূর্বে এর কারণ ও ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিশ্লেষণ করা জরুরী বিধায় নিম্নে এ সম্পর্কিত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো: হৃদয়বিদারক সড়ক দূর্ঘটনার অন্যতম কারণ ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন। এ কারণে অনেক মানুষের মৃত্যু ও সম্পদহানি ঘঠে। নিম্নে সড়ক দূর্ঘটনার কারণসমূহ তুলে ধরা হলো:
মাত্রাহীন গতি : বাস্তবতা হল, ড্রাইভিং এর গতির একক কোন মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। রাস্তা প্রশস্ত ও সংকীর্ণ হওয়ার বিবেচনায় গাড়ির ভীড় থাকা ও না থাকার বিবেচনায় গতির মাত্রা পরিবর্তন হয়। বরং এক গাড়ির সাথে অন্য গাড়ির গতির মাত্রায় ও পরিবর্তন হয়। অতএব, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যদি কোন গতির মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হলে সে গতিমাত্রায় গাড়ি চালানো আবশ্যক। আনাস রা. এর সুত্রে বর্ণিত নবী করীম স. বলেন: “ধীরস্থিরতা আল্লাহর পক্ষ থেকে আর তাড়াহুড়া শয়তানের পক্ষ থেকে”। “বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, খ.৪.পৃ.৮৯. হা. নং: ৪৩৬৭; সুয়ূতী আল জামিউস সগীর-এ হাদীসটিকে (৩৩৯০) যয়ীফ বলেছেন। তবে এ হাদীসের সমর্থনে বিভিন্ন হাদীস রয়েছে। যেগুলোর মাধ্যমে এ হাদীসটিকে দুর্বল না হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়। এ কারণে শায়খ আলবানী সহীহুল জামিউস সগীর (৩০১১) বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।” “ইবনুল কারিম রহ. (৬৯১-৭৫১হি.) বলেন: তাড়াহুড়া শয়তানের পক্ষ থেকে হওয়ার কারণ তাড়াহুড়া হল চঞ্চলতা ও অস্থিরতা, যা ধীরস্থিরতা গাম্ভীর্য ও সহনশীলতার সাথে যেকোন কাজ সম্পন্ন।” করতে মানুষকে বাধা দেয় এবং তা যে কোনো বস্তুকে অপাত্রে রাখতে বাধ্য করে। এটি বিভিন্ন ক্ষতি টেনে আনে ও কল্যাণ রোধ করে। এটি  মূলত দুটি মন্দ স্বভাবের মিলনে জন্মলাভ করে: অতিমাত্রায় অবহেলা আর সময়ের পূর্বে কোন বিষয়ের তাড়া করা। “আব্দুল রউফ আল-মানাভী, ফায়যুল কাদীর (বৈরুত:দারুল ম’রিফা, ২য় প্রকাশ, ১৩৯১হি.), খ.৩.পৃ.২৭৭” (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ