বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

আমাদের জীবনে ইন্টারনেট

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফসল ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডইন এবং আরো কত সব সামাজিক যোগাযোগ। এ মাধ্যমগুলো আমাদের খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তাজা খবরগুলো পৌঁছে দেয়। শুধু সংবাদই নয়, এর মাধ্যমে স্থিরচিত্র বা ধারণকৃত ভিডিও পাঠানোও খুব সহজলভ্য। আগেকার দিনে একটি পোস্টকার্ড, এনভেলাপ, টেলিগ্রাম বা ওয়ারলেস ব্যবস্থাই ছিল মানুষের  যোগাযোগের বড় মাধ্যম। এখন দেশে বা বিদেশে মোবাইল ঘুরালেই আপনজনের সঙ্গে কথা বলা খুব সহজ। মোবাইলেও রয়েছে নানা ধরনের কম খরচের ব্যবস্থা ইমো, ভাইবার, হোয়াটস্যাপ, স্কাইপি ও টুইটার আরো কত উন্নত ব্যবস্থা। মানব কল্যাণে, দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে যত সহজতর প্রযুক্তি সুবিধা মানুষ পাবে তাকে স্বাগত জানাতেই হবে। এখন জরুরি প্রয়োজনে এক নিমিষেই কথা হয় মোবাইলে।
ফেসবুক নিয়ে পারিবারিক বা সামাজিক দায়িত্ব অবশ্যই একটি বড় দিক। পারিবারিক পরিবেশ যত সুন্দর হবে এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ যত বেশি সুন্দর ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসবে ততই ফেসবুকের কল্যাণ সাধিত হবে। বুদ্ধি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ভালো-মন্দ বিষয় নিয়ে তাদের অভিভাবকদেরই বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হবে। ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এর কারণে সবাই পরস্পরের কত কাছাকাছি চলে আসে। চিন্তা-চেতনা, জানা-শোনা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান প্রদান ঘটে। মনের ভাব প্রকাশ সহজেই করা যায়। কাছের লোকজন, বন্ধুবান্ধব সবার বর্তমান অবস্থান, অগ্রগতি, ভালো-মন্দ জানা যায়। এখন সব আনন্দ উল্লাসও ফেসবুকে মেলে। যাতে অডিও-ভিডিও লাইভ সম্প্রচার সুবিধাও রয়েছে। এই মাধ্যম দিচ্ছে পরিচিতিও। অনেকেই এখন ফেসবুক তারকা। তাৎক্ষণিক লাইক, কমেন্টসের সুবিধা থাকায় যোগাযোগটা হচ্ছে অনেক সহজময়।
ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট মানুষকে নেতিবাচক অনুভূতিও দিচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইনে অন্য বন্ধুদের সুখী জীবন দেখে অনেকে ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন।
ফেসবুকের লাইক পাওয়ার আশা এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। ফেসবুকে দেয়া পোস্টে আশানুরূপ লাইক না পেলে অনেকে বিচলিত ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যরা বেশি লাইক পেলে ৪২ শতাংশ মানুষ ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন। রাশিয়ার অ্যান্টি ভাইরাস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ক্যাসপারস্কি ল্যাব বিশ্বের ১৬ হাজার ৭৫০ জন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। ওই সমীক্ষার ফল অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়াচ্ছে।
আমরা হয়তো জানি এই জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ২০০ কোটিরও বেশী  ব্যবহারকারীর মাইলফলক ছুঁয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বের এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ এখন ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক পোস্টের মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছেন। ২০১২ সালের অক্টোবরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়েছিল। এরপর পাঁচ বছরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্বিগুণ হলো। এদিকে এত ব্যবহারকারী পেয়েও সন্তুষ্ট নন মার্ক জাকারবার্গ! ইউএসএ টুডেতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ২০০ কোটি ছাড়ালেও আমরা এখনো সবাইকে সংযুক্ত করতে পারিনি। সবচেয়ে যে বিষয়টি তিনি বলেন, তা হলো সবাইকে সংযুক্ত করা।
হ্যাঁ, বিশ্বের সবাই ফেসবুকে সংযুক্ত হবে। কিন্তু আমাদের এও জানতে হবে যে, ফেসবুকে বাড়ে বিষন্নতা।  যারা দীর্ঘক্ষণ ফেসবুকে অপরের পোস্ট করা ছবি দেখে সময় কাটান, তাদের ব্যক্তিজীবনে বিষন্নতা বৃদ্ধি পায়। নানা রকম বিতর্ক, খুনসুটি, রসালো মন্তব্য, ফটো মন্তব্য, ফটো ব্যানার, কত কিছুই না হচ্ছে ফেসবুকে। ঈর্ষা, হিংসা, বিদ্বেষও কম ছড়াচ্ছে না ফেসবুকের মাধ্যমে। দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মাইল দূরত্ব এখন ঘুচে গেছে ফেসবুকের বদৌলতে। পেশা জীবনের নিশ্চয়তা, বিচ্ছেদ ইত্যাদি নানা কারণে অনেকেই দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। এক পর্যায়ে কারো কারো মনে হয়, কী পেলাম এই বিদেশে এসে। এখানে কাউকে কিছু দেখানোর নেই। সব দেখানোর জায়গা সেই নিজের দেশে। নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এদের দেখাতে না পারলে মনের শান্তি কোথায়?। কিন্তু এখন যে যেখানেই থাকুক না কেন একটা সেলফি ক্লিক করে ফেসবুকে আপলোড করে দিলেই ফেসবুকের সব শুভাকাংখী বন্ধুরা, আত্মীয়-স্বজনরা তার অবস্থানরত জায়গাটি জানতে পারছে। সঙ্গে লাইক, কমেন্ট দিয়ে জানান দিচ্ছে যে, তুমি যেখানেই থাক না কেন আমরা আছি তোমার পাশে। এমনটা হয়। ফেসবুকাসক্তদের সেই আক্ষেপ অনেকেরই লাইক, কমেন্ট পাওয়া খুবই কষ্টের। ফেসবুকাররা শাইলকের চেয়েও কৃপণ ও নিষ্ঠুর। ভাগ্যিস ফেসবুক ডিসলাইক অপশন এখনো চালু করেনি। এই সময়ের প্র্যাকটিসিং মনোরোগ চিকিৎসকরা অনেকেই বলছেন, অতিরিক্ত ফেসবুকাসক্তি এখন মনোরোগে রূপ নিতে চলেছে। এমন অনেকের মুখোমুখী হচ্ছি এখন মধ্যরাত, শেষ রাত অবধি মেতে রয়েছেন ফেসবুক নিয়ে। ফেসবুক মানুষের অতি প্রিয় ঘুমটাকেও এখন কেড়ে নিয়েছে। মানুষ এখন ঘুমানোর সময় ফেসবুক চালায় আর কাজের সময় ঘুমায়।
মানুষ তার মনের জটিলতাকে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করে। কেউ তাকে অস্বীকার করে। কেউ মনের মাঝে তালাবন্দী করে চেপে রাখে। আবার কেউ নিজের মনের অস্থিরতা, জটিলতা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে কথা বলে। কেউ ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর মতো পথও বেছে নেন। সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সভ্য প্রমাণের জন্য মনের কটকচালির বিষয়গুলো ছবি, গল্প, উপন্যাসের মাধ্যমে প্রকাশ করে। দীর্ঘক্ষণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করলে এবং সে সময় শুধু অপরের পোস্ট কিংবা ছবিগুলোতে ঘুরে বেড়ালে মনে হিংসার উদ্রেকও হয়। আর পরবর্তী সময়ে জীবনে নেমে আসে বিষন্নতা।
ডেনমার্কের গবেষকরা একটি গবেষণায় এক হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী বেছে নিয়েছিলেন যাদের বেশিরভাগই ছিলেন নারী। এদের মধ্যে অর্ধেক ব্যক্তিকে বলা হয় ফেসবুক ব্যবহার চালিয়ে যেতে, আর বাকি অর্ধেককে লগইন করতে মানা করা হয়। ফলাফলে দেখা গেছে, যারা ফেসবুক বা অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধুদের কার্যক্রমে ঈর্ষান্বিত হন, তাদের ক্ষেত্রে ফেসবুক ব্যবহার থেকে বিরত থেকে বিষণন্নতা কমার প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার আমাদের জীবন নিয়ে আত্মতুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে মানুষের মধ্যে অবাস্তব আর্থসামাজিক তুলনা করার মানসিকতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন ফেসবুকে লাখো ঘণ্টা ব্যয় হয়। কিন্তু এই সংযুক্ততা কি আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে এনেছে। ফেসবুকে সক্রিয়ভাবে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার মানসিকতা মানুষের মনে ইতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে। কিন্তু যারা নীরবে অন্যের পোস্ট দেখে সময় কাটান, তাদের প্রতি রয়েছে সতর্কবাণী। আজকের এই যুগে ব্যস্ততার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জীবনকে সহজ থেকে সহজতর করে দেয়ার প্রচেষ্টা। বিশাল বিশ্ব এখন আমাদের ক্ষুদ্র হাতের মুঠোয়। আর এ কারণেই বর্তমানে ছেলেমেয়ে লালন-পালনের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের চিন্তার ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে নতুন বিষয় ইন্টারনেট ও ফেসবুক। মা-বাবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন ছেলেমেয়েরাও সময়ে-অসময়ে ব্যবহার করছে ইন্টারনেট। এগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা হোক, কি পারদর্শিতা বড়দের চেয়ে কোনো দিক দিয়েই পিছিয়ে নেই ছেলেমেয়েরাও। এগুলো ব্যবহার করে বিভিন্ন ভুল তথ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক শিশু কিশোর-তরুণ নিজেদের ঠেলে দিচ্ছে নানা অন্যায়-অপকর্মের দিকে। যার ফলে তারা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে নৈতিকতা-মূল্যবোধ থেকে। বর্তমানে প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যস্ততা বেড়েই চলছে।
আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক পরিম-লে পারস্পরিক সম্পর্ক আসা-যাওয়া, দেখা- সাক্ষাৎ, খোঁজ-খবর নেয়ার সংস্কৃতি আগে ছিল। এখন তো কেবল সামাজিক অনুষ্ঠানে এবং কারো মৃত্যুকে উপলক্ষ করেই পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের বিষয়টি আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার রেওয়াজ এখন আর তেমন নেই। এমন কি ধর্মীয় উৎসব, পার্বণে পর্যন্ত কেউ আর আগের মতো আত্মীয় বাড়িতে যায় না। সেই অনিবার্য সামাজিকতাও এখন নেই। মুঠোফোনে এসএমএস পাঠিয়ে কিংবা বড়জোর ফোনালাপে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনে সামাজিক দায়িত্ব পালনের অদ্ভূত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে নিকট আত্মীয় পরিজনের সান্নিধ্য-নৈকট্যের তাগিদ কেউ অনুভব করে না। যতটুকু রয়েছে তা দায় মেটানোর সীমাবদ্ধতায়। অনাবিল আন্তরিকতা, ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
ফেসবুক একটি সামাজিক মাধ্যম। একটি চলন্ত বই। একে ইতিবাচক কল্যাণের কাজে ব্যবহার করুন। খারাপ কাজে নয়। দেশ-বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন মাতৃভূমির অবদান ভুলে যাবেন না। মনকে বড় করুন।
অন্যকে সম্মান করতে শিখুন। নিজেই তখন সম্মানিত হবেন। বিদেশে যে বন্ধুটি অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করছেন, তার মূল্যায়ন করুন। তার ভালো কাজের প্রশংসায় কার্পণ্য করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার প্রবাসী বন্ধুর কাছে আপনার প্রশংসা, অভিনন্দন সোনার অক্ষরে লেখা চিঠির মতো। তাকে বঞ্চিত করবেন না। কাউকে পছন্দ না হলে তাকে সহজেই আপনি আনফলো বা ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে বাদ দিতে পারেন।
অযথা মনে জটিলতা বাড়িয়ে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। আমরা যেন ফেসবুক বা ইন্টারনেটকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে দেশকে বা দেশের মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা বা বিপদের হাত থেকে রক্ষার কাজে এগিয়ে যেতে পারি- এটাই হোক আমাদের শপথ।
-আজহার মাহমুদ

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ