শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

হরহামেশা ঠকছেন তিতাসের ২৭ লাখ ৩৪ হাজার গ্রাহক

কামাল উদ্দিন সুমন : হরহামেশা ঠকছেন তিতাসের ২৭ লাখ ৩৪ হাজার গ্রাহক। চাহিদামত গ্যাস ব্যবহার না করেই নিয়মিত বিল গুণছেন তারা। এ নিয়ে গ্রাহকদের আক্ষেপ করা ছাড়া আর কোন প্রতিকার নেই অন্যদিকে তিতাসের নেই কোন জবাবদিহিতা। ফলে দিনের পর দিন ঠকেই যাচ্ছেন তিতাসের গ্রাহকরা। 
সূত্র জানায়, বছরজুড়ে গ্যাস সংকটে কাটাতে হয় তিতাসের গ্রাহকদের। অথচ মাস শেষে ঠিকই বিল গুণতে হচ্ছে তাদের। বিল পরিশোধ না করলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার আতংকে থাকেন তারা। অথচ  চাপ কম থাকার অজুহাতে অনেক গ্রাহকই সারা মাসে চাহিদা মোতাবেক গ্যাস পাচ্ছেন না। যদিও ন্যূনতম হারে বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে তাদের।
 সূত্র জানায়, প্রকৃত ব্যবহার গ্যাসের নির্ধারিত ব্যবহারের চেয়ে কম হলেও মিনিমাম চার্জের নামে ন্যূনতম বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে বাণিজ্যিক থেকে শুরু করে চা-বাগান, ক্যাপটিভ ও আবাসিক গ্রাহকদেরও। নির্বিঘ্নে গ্যাস না দিয়েও গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মূল্যায়ন অনুযায়ী, গত অর্থবছরও এ পদ্ধতিতে ৩৯৫ কোটি (২০১৬-১৭) টাকা আয় করেছে তিতাস। তার আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছর মিনিমাম চার্জের নামে তিতাসের আয় ছিল ৩২১ কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছর গ্রাহকদের নির্বিঘেœ গ্যাস না দিয়েও কোম্পানিটি আয় করে ২৫৭ কোটি টাকা।
বিইআরসি বলছে, মিনিমাম চার্জ প্রদানকারী গ্রাহকের প্রকৃত গ্যাস ব্যবহার নির্ধারিত ন্যূনতম ব্যবহার থেকে সর্বদাই কম হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গ্রাহকরা।
তিতাসের হিসেবে ২০১৭ জুন ৩০ অনুসারে ক্রেতাদের সংখ্যা ২৭,৩৪,৫৩৪। এর মধ্যে আবাসিক ২৭,১৭,৫৩৬ টি, পাওয়ার (সরকারি) ০৭ টি পাওয়ার (ব্যক্তিগত) ৩৬ টি, সার ০৩ টি, শিল্প ৪,৬১০টি, সিএনজি ৩৩৫ টি, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১০৮৮টি, বাণিজ্যিক ১০,৯১৯টি। অথচ বিল না দেয়ায় গত বছর মাত্র ৯ হাজার ৯৬৮টি সংযোগ বিছিন্ন করা হয়েছে। অর্থাৎ বাকী সব গ্রাহক নিয়মিত বিল দিচ্ছে কিন্তু চাহিদা মোতাবেক গ্যাস পাচ্ছে না।
‘গ্যাস বিপণন নিয়মাবলি-২০১৪’ অনুযায়ী, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, ক্যাপটিভ ও চা-বাগান শ্রেণীর গ্রাহকদের গ্যাস ব্যবহার হোক বা না হোক, মাস শেষে অনুমোদিত ন্যূনতম লোডের ভিত্তিতে নিজ নিজ খাতের মূল্যহার দিয়ে গুণ করে বিল তৈরি করা হয়, যা মিনিমাম চার্জ নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে গ্রাহক চাহিদা মোতাবেক গ্যাস না পেলেও লাভবান হচ্ছে বিতরণ কোম্পানি।
সূত্র জানায়, সর্ব নিম্ন চার্জের নামে আবাসিকে মিটারযুক্ত গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দুই চুলায় মাসে ৮৮ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার হিসাব করে গ্রাহকের কাছ থেকে ৮০০ টাকা নিচ্ছে তিতাস। কিন্তু বেসরকারি এক হিসাবে দেখা যায়, এ গ্যাসের পরিমাণ ৬৫ ঘনমিটারেরও কম।
আবাসিকে মিটারবিহীন গ্রাহকদের জন্য সর্বনিম্ন চার্জ প্রযোজ্য নয়। তারা সর্বশেষ মূল্যহার অনুযায়ী এক চুলার জন্য ৭৫০ এবং ডাবল চুলার জন্য ৮০০ টাকা করে গ্যাস বিল দিচ্ছেন। কিন্তু যাদের মিটার আছে, তারা চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পেলে সংযোগ নেয়ার সময় আবেদনপত্রে ন্যূনতম যে চাহিদা উল্লেখ করেছেন, তাকে নির্ধারিত মূল্যহার দিয়ে গুণ করে বিল আদায় করা হয়।
সূত্র জানায়, ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে তিতাস সবচেয়ে বৃহৎ কোম্পানি। তিতাস গ্যাস ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে গ্যাস বিতরণ করে। বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহক মিলে বর্তমানে কোম্পানির মোট গ্রাহক ২৭ লাখ ৩৪ হাজার। দেশের বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদিত দৈনিক ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের অর্ধেকের বেশি এ বিতরণ কোম্পানি বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহকের মধ্যে বিতরণ করে। প্রাপ্ত গ্যাসের মধ্যে তিতাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৩ শতাংশ, ক্যাপটিভ পাওয়ার ও শিল্পে ৪১ শতাংশ এবং আবাসিকে ১৬ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে ।
সূত্র জানায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কোম্পানি মোট ১৭,০১৮.৯৯ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস বিক্রয় করে ১২,৪২৬.৯৬ কোটি টাকা এবং মিটার ভাড়া ও সারচার্জসহ সর্বমোট ১২,৫৫১.০৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে, যার পরিমাণ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ১১,৩১৭.১০ কোটি টাকা। এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ১০.৯০ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২,৫৫১.০৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের বিপরীতে বকেয়া রাজস্বসহ ১১,৮৯০.৯০ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, যা পাওনার তুলনায় ৬৬০.১৫ কোটি টাকা কম।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক শাহিদ আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিংহভাগই আমরা করে থাকি। কিন্তু গ্যাসের চাপ না পাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করা যায় না। আবার লো-প্রেসার থাকার কারণে অনেক সময় ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। তার পরও মাস শেষে ঠিকই তিতাসকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিল দিতে হয়। এতে গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি হয়রানি বাড়ে।
রাজধানীর আদাবরের তিতাসের আবাসিক গ্রাহক ইউনুস শেখ জানান, গ্যাস চাহিদা মোতাবেক না পেয়ে নিয়মিত বিল গুণতে হচ্ছে এতে করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত  হচ্ছেন। গ্যাস না পেয়ে রমযানে বেশ কয়েকদিন বাইরে থেকে খাবার কিনতে হয়েছে তাকে। যদিও মাস শেষে গ্যাসের ন্যূনতম বিল পৌঁছে গেছে বাসার ঠিকানায়। একই অভিযোগ করেন রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা ফরিদ উদ্দিন । রান্নার জন্য মাসের অধিকাংশ সময়ই প্রয়োজনীয় গ্যাস পান না তিনি। কিন্তু চারটি চুলার বিপরীতে মাস শেষে ৩ হাজার ২০০ টাকা ঠিকই তিতাসের ব্যাংক হিসাবে জমা দিতে হচ্ছে তাকে।
এভাবে বিল আদায় যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তারাও। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমান বলেন, কিছু কারিগরি দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্পে মিনিমাম চার্জ এখনই বন্ধ করা যাচ্ছে না। তবে বিলিং সিস্টেম কীভাবে আধুনিক ও স্বচ্ছ করা যায় তা নিয়ে কাজ করছি আমরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলমের ভাষায়, দীর্ঘদিন ধরে কম গ্যাস ব্যবহার করে গ্রাহকরা বিল দিয়ে আসছেন। বিনা সেবায় গ্রাহক অর্থ ব্যয় করলেও সুবিধা নিচ্ছে বিতরণ কোম্পানি। ফলে গ্যাস চুরি ও অবৈধ লাইনে গ্যাস দেয়ার ব্যবসাও বাড়ছে। তবে আবাসিকে প্রি-পেইড মিটার স্থাপন এবং শিল্পে ইলেকট্রনিক গ্যাস ভলিউম কারেক্টর (ইভিসি) মিটার স্থাপন করলে গ্রাহকরা এ হয়রানি থেকে মুক্তি পাবেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ