বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গে

দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আবারও জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ, অবৈধ পন্থায় বিদেশে অর্থ পাচার এবং খোদ মালিকদের আত্মসাতের মতো বহুবার বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর পাশাপাশি এবার আলোচনার প্রধান কারণ হিসেবে প্রাধান্যে এসেছে সুদের হার। শিল্পপতি, আমদানিকারক ও রফতানিকারকসহ ব্যবসায়ীদের অব্যাহত দাবির মুখে সরকার তথা অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপের পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো সম্প্রতি তাদের সুদের হার কমানোর এবং এই হার এক অংকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কেন্দ্রীয় সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ- এবিবি এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে জানিয়েছে, বাণিজ্যিক ঋণের বিপরীতে কোনো ব্যাংকই ৯ শতাংশের বেশি সুদ আদায় করতে পারবে না। পবিত্র ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে নেয়া এ সিদ্ধান্তে সাধারণ আমানতকারীদের দেয়া সুদের ব্যাপারে জানানো হয়েছে, এই সুদের হারও এক ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে এবং সঞ্চয়ী ও মেয়াদীসহ কোনো আমানতের বিপরীতেই ৩ থেকে ৫ শতাংশের বেশি সুদ বা মুনাফা দেয়া হবে না। বিষয়টি নিয়ে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে এবিবির প্রতিনিধিদের  বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, বাণিজ্যিক ঋণের সুদের সঙ্গে বিভিন্ন মেয়াদের আমানতকে শুধু একাকারই করা হয়নি, আমানতকারী তথা সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করার জন্যও পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। কেন না, হাজার কোটি টাকার অংকে যারা বাণিজ্যিক ঋণ নিয়ে আইন অনুযায়ী কিস্তি পরিশোধ করার পরিবর্তে ঋণ খেলাপিতে পরিণত হন, এবিবির নতুন সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ আমানতকারীদেরও তাদের পর্যায়েই নামিয়ে আনা হবে।
আপত্তি ও প্রতিবাদের কারণ হলো, কোনো অজুহাত দেখিয়ে ঋণ না নিয়ে আমানতকারীরা উল্টো বরং ব্যাংকগুলোতেই টাকা জমা রাখেন এবং মূলত আমানতকারীদের জমা রাখা সে অর্থ থেকেই ব্যাংকগুলো বাণিজ্যিক ঋণ দিয়ে থাকে। এটাই বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ব্যাংকিং খাতের সাধারণ নিয়ম। এই নিয়মের মূল কথা হলো, সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ দেয়া হবে এবং সে ঋণের বিপরীতে আদায় করা সুদের অর্থ থেকে ব্যাংকগুলো আবার আমানতকারীদের সুদ বা মুনাফা দেবে। দ্বিমুখী এই লেনদেনই বিশ্বের সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম। বাণিজ্যিক ঋণের বিপরীতে সুদ হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ এবং সাধারণ আমানতকারীদের দেয়া সুদ বা মুনাফার মাঝখানে যে অর্থ অবশিষ্ট থাকবে সেটাই একটি ব্যাংকের লাভ বা মুনাফা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। একই কারণে বাণিজ্যিক ঋণ এবং আমানতের সুদের মধ্যে বেশ পার্থক্য রাখা হয়। যেমন বাণিজ্যিক ঋণের বিপরীতে সুদের হার যদি ১৫ শতাংশ হয় তাহলে আমানতের সুদের হার হবে ১০ থেকে ১২ শতাংশ। মাঝখানের ৩ থেকে ৫ শতাংশ গণ্য হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের লাভ বা মুনাফা হিসেবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতও এ নিয়মেই চলে আসছিল। কিন্তু পরিস্থিতিতে অবনতি ঘটেছে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও প্রমাণিত সত্য হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম দফায় ১৯৯৬ সালে শেয়ার কেলেংকারীর মাধ্যমে সাধারণ আমানতকারীদের পথে বসানো হয়েছে। লুণ্ঠিত হয়ে গেছে তাদের শেষ সঞ্চয়টুকুও। এরপর ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় দফায় সম্ভাব্য সকল পন্থায় আমানতকারীদের ঠকানোর তথা বঞ্চিত করার ভয়ংকর কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে স্থায়ী ও মেয়াদী আমানতের ওপর সুদের হার কমাতে কমাতে মাত্র ৪/৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। শত বা হাজারের অংকে যারা টাকা জমিয়ে থাকেন তারাও পড়েছেন একই অবস্থায়। 
শুধু মুনাফা বা সুদের হার কমানো নয়, ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগও উঠেছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বেসরকারি ব্যাংকে একটি হিসাবের বিপরীতে প্রতি বছর কেবল সার্ভিস চার্জ হিসেবেই দেড় থেকে দু’ হাজার টাকা পর্যন্ত কেটে রাখা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো একই সঙ্গে এসএমএস পাঠানো এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং-এর জন্যও বছরে একজন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৫৭৫ টাকা পর্যন্ত কেটে নিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আপত্তির কারণ হলো, কোনো গ্রাহক এসএমএস পাওয়ার এবং ইন্টারনেট ব্যাংকিং-এর সুবিধা নেয়ার ব্যাপারে রাজি না হলেও তার কাছ থেকে টাকা কাটা হচ্ছে। সাধারণ গ্রাহকদের মধ্যে বেশি বিপদে আছেন তারা- যারা কোনো ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। বিশেষ করে বিদেশি ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের সুদ আদায়ের ক্ষেত্রে রীতিমতো চৌর্যবৃত্তি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, একবার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার শুরু করলে কারো পক্ষেই ব্যাংকের কবল থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব হয় না। সুদে আর আসলে টাকার পরিমাণ শুধু বাড়তেই থাকে।
আমরা মনে করি, সরকারের উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রতারণা ও চৌর্যবৃত্তির বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে পদক্ষেপ নেয়া। এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার- যাতে কোনো ব্যাংকের পক্ষেই কোনো গ্রাহককে সুদের গোপন ফাঁদে ফেলে চুক্তির বাইরে বেশি অর্থ আদায় করা সম্ভব না হয়। বৃহৎ ঋণের ক্ষেত্রে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে একই টেবিলে বসে হিসাব ঠিকঠাক করার ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে এমনভাবে বাধ্য করতে হবে, কোনো ব্যাংকই যাতে কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করার সুযোগ না পায়। ক্ষুদে আমানতকারীদের ক্ষেত্রেও এমন কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা দরকার, ব্যাংকগুলো যাতে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এসএমএস বা ইন্টারনেট ব্যাংকিং ধরনের অজুহাত দেখিয়ে সার্ভিস চার্জ আদায় করতে না পারে। প্রতিটি বিষয়ে ব্যাংকগুলো যাতে ঋণগ্রহণকারী ও আমানতকারীদের আগেই অবহিত করতে বাধ্য হয়- সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
আমরা মনে করি, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় সংগঠন এবিবির নেয়া সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের ব্যাপারেও সরকার এবং দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কঠোর নজরদারি করা। ব্যাংকগুলো যাতে সুদের হার এক ডিজিটে নামিয়ে আনার নামে সাধারণ আমানতকারীদের বিপুল মুনাফাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না করতে পারে সে বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা চাই, বাণিজ্যিক ঋণের সুদের হার কমানো হলেও সাধারণ আমানতকারীরা যাতে বঞ্চনার শিকার না হন। বলা দরকার, এবিবির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে বিশেষ করে সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সেই সাথে যদি নানা ধরনের প্রতারণা ও চৌর্যবৃত্তিকে চলতে দেয়া হয় তাহলে খেলাপি ঋণের বিষয়টি তো স্থায়ী হবেই, ব্যাংকিং খাতের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং সুচিন্তিতভাবে ইতিবাচক ব্যবস্থা নেয়া দরকার জরুরি ভিত্তিতে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ