জাতীয় ফলমেলায় বাহারি ফলের সমারোহ
প্রকাশিত: শনিবার ২৩ জুন ২০১৮ | প্রিন্ট সংস্করণ
মুহাম্মদ নূরে আলম : ‘এত্ত বড় আম!’ মেগা সাইজের ব্রুনাই কিং দেখে বড় বড় চোখে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন এমদাদুল হক। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর এই বাসিন্দা প্রতি বছরের মতো এবারও এসেছেন জাতীয় ফল প্রদর্শনীতে। এবার এতে রয়েছে নতুন প্রজাতির ব্রুনাই কিং’সহ মোট ৭৭টি প্রজাতির আম এনেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এছাড়া এবারের মেলায় বিদেশী ফলের আধিপত্য বেশি। বিদেশী ফলগুলো হলো: এভোকাডো, আশঁ ফল, ডে-ফল, পার্সিমন, পীচফল, এস্টার আপেল, প্যাশন ফল, থাই জামরুল, রেড জামরুল, থাই পেয়ারা, সীডলেস লেবু, কলম্বো লেবু, চায়না কাগজী লেবু, চায়না লেবু, বিদেশী জারা লেবু, ড্রাগন ফল, চায়না লিচু, বিদেশী খরমুজ (তরমুজ), রাম্বুটান ফল, টক আতা, টিসা ফল, শানতোলা, তুতঁফল, হলুদাভ সাদা নারিকেল, ল্যাংশাফর ইত্যাদি। মেলায় কেন বিদেশী ফলের আধিপত্য এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিদেশী ফল মানুষকে পরিচয় করানোর জন্য! মেলাটি হচ্ছে দেশী ফল নিয়ে জাতীয় ফল মেলা এবং মেলার উদ্দেশ্য হচ্ছে শহরের নতুন প্রজন্মের কাছে দেশী ফল পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু মেলায় কেন বিদেশী ফল বেশি প্রর্দশন হচ্ছে সেটা একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেল।
‘অপ্রতিরোধ্য দেশের অগ্রযাত্রা, ফলের পুষ্টি দেবে নতুন মাত্রা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গতকাল শুক্রবার খামারবাড়িতে শুরু হয়েছে জাতীয় ফল প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে বিভিন্ন মৌসুমি ফল দিয়ে সাজানো হয়েছে সুদৃশ্য স্তম্ভ। তিন দিনব্যাপী এই জাতীয় ফলমেলা ২২ জুন থেকে শুরু হয়ে মেলা চলবে ২৪ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ আগামীকাল রোববার মেলা শেষ হবে। মেলায় ৯টি সরকারি ও ৫১টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মোট ৮১টি স্টল রয়েছে। মেলায় আমের ৭৭টির অধিক প্রজাতিসহ প্রায় ২০৩ প্রজাতির ফলের সমারোহ এবারে মেলাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়াও মেলায় রয়েছে জাতীয় ফল কাঁঠাল ও দেশী ৭৭ প্রজাতির আমের বিশেষ কর্ণার। মেলা প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা ফল চাষের বিভিন্ন প্রযুক্তি সম্পর্কে এবং রাসায়নিক মুক্ত বিভিন্ন জাতের ফল ক্রয় করতে পারবে। এছাড়া ফল চাষের সম্পর্কে বিভিন্ন বুকলেট ও কৃষিবিদদের থেকে বিভিন্ন পরামর্শ পাবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বিভিন্ন জাতের ৭৭টি প্রজাতির আম নিয়ে এসেছে। এখানে উল্লেখযোগ্য কিছু দেশী আমের নাম দেওয়া হলো-ক্ষিরসা, বোগলাগুটি, হিমসাগর, মহারাজ, বারি আম-২, বারি আম-৩, সিন্ধুরী, পালমার, ব্যানানা ম্যাংগো, দুধস্বর, কাঁচা মিঠা আম, ল্যাংড়া, নাগ ফজলি, হাড়িভাঙ্গা, সিন্ধু, জগৎ মোহনী, মল্লিকা, ফজলি, রাঙ্গু, তোতাপুরী, মদনভোগ ইত্যাদি।
ওজনে চার কেজি পর্যন্ত হতে পারে ব্রুনাই কিং আম। একজন প্রবাসী ব্রুনাই থেকে এর ডাল কলম করে দেশে এনে নিজের বাড়িতে লাগান। তারপর অনেক জায়গাতেই এর চারা লাগানো শুরু হয়েছে। ‘এখানে যে দু’টি ফল দেখছেন, এগুলো মাগুরা হর্টিকালচার সেন্টারে চাষ করার কথা বলছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার শাখার পরিচালক কুদরত-ই-গণি।
আগোরার স্টলে সর্বনিম্ন ৭০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা দামে বিভিন্ন প্রজাতির আম পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়াও রয়েছে স্বপ্ন, প্রাণসহ বিভিন্ন কোম্পানির স্টল। প্রদর্শনীতে টাটকা ফল ছাড়াও ফলজাত খাদ্যপণ্য জ্যাম, জেলি, মধু, চাটনি, সিরকা ইত্যাদি দিয়ে স্টল সাজিয়েছে অনেক কোম্পানি।
দর্শনার্থীদের জন্য ফল কেনার ব্যবস্থাও রয়েছে প্রদর্শনীতে। প্রথম দিনেই আম কিনতে বাসাবো থেকে ছুটে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখানে সাধ্যের মধ্যে ভেজালমুক্ত ফল পাওয়া যায়। ফল কিনে স্বস্তি বোধ করি।’ বেসরকারি স্টল কামাল এগ্রোফার্মের কর্মচারী জানান, ৭০ থেকে ৮০ টাকা দামে বিভিন্ন প্রজাতির আম বিক্রি করছেন তিনি।
মৌসুম ছাড়াই বছরের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে পাওয়া যাবে রকমারি জাত আর বাহারি নামের সুস্বাদু সব আম। রোপণের তিন বছরের মধ্যেই গাছে ধরবে বেশি শাঁসযুক্ত আর পানিসমৃদ্ধ নারকেল। পরিকল্পিত চাষাবাদে বাড়ির আঙিনা কিংবা ছাদেই ফলবে পুষ্টিগুণের আধার নানা জাতের দেশী ফল। এমন চেনা-অচেনা ও দেশী-বিদেশী ফলের বাহারি আয়োজনে শুরু হয়েছে জাতীয় ফল প্রদর্শনী ২০১৮।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আকামু গিয়াস উদ্দিন মিল্কী মিলনায়তন চত্বরে আয়োজিত প্রদর্শনীতে ঢুকতেই চোখে পড়বে জাম, জামরুল, পেয়ারা, সফেদা, লটকনসহ বিভিন্ন ফল দিয়ে তৈরি তোরণ। চত্বরের আরও ভেতরে তৈরি করা হয়েছে ফলের পিরামিড। প্রদর্শনীর স্টলে দায়িত্বরত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, অধিদপ্তর সারা বছর বিভিন্ন ফলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে। সাধারণ মানুষকে এসব ফলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য এই প্রদর্শনী একটা বড় সুযোগ। প্রদর্শনীতে ঢুকতেই আমের স্টলগুলো ঘিরে আমজনতার ভিড় বেশি দেখা গেল। তাঁদের অনেকেই বললেন, গৌড়মতী, কোহিতুর, কালাপাহাড়, সুবর্ণরেখা কিংবা সীতাভোগের মতো অপ্রচলিত জাতের আম চোখে দেখা দূরে থাক, নামও শোনেননি কখনো। প্রদর্শনীতে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ফলের আলাদা স্টল রয়েছে। যেমন পাহাড়ি অঞ্চলের ফল, উত্তরাঞ্চলের ফল, উপকূলীয় অঞ্চলের ফল, ভাওয়াল ও মধুপুর গড় অঞ্চলের ফল। বিভিন্ন দেশী ফলের মধ্যে আছে করমচা, কাউফল, অড়বরই, বেতফল, ডেউয়া, খেজুর, আমলকী, আঁশফল, বিলাতি গাব এবং হনুমানজটা, অগ্নিশ্বরসহ বিভিন্ন জাতের কলা।
তবে এদিন সকালেই বৃক্ষরোপণ পক্ষ উদযাপন উপলক্ষে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘মানব সম্পদ উন্নয়নে পুষ্টি সমৃদ্ধ ফলের অবদান’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে কৃষি মন্ত্রণালয়। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ। তিনি তাঁর প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশের মোট চাষযোগ্য জমির মধ্যে ফলের আওতায় আছে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ জমি। অথচ দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে মোট ফসলভিত্তিক আয়ের ১০ শতাংশই আসে ফল থেকে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সভাপতিত্বে সেমিনারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন বক্তব্য দেন।
মেলায় প্রদর্শিত ফল সমুহ : বাতাবী লেবু, কাগজী লেবু, জারা লেবু, কলম্ব লেবু, সীডলেস লেবু, আদা লেবু, শাসনি লেবু, এলাচি লেবু, ড্রাগন ফল, জামরুল, আপেল জামরুল, বাউ জামরুল, স্থানীয় জামরুল, আমলকী, রক্তগোলা, বিলম্বি, অরবরই, প্যাসন ফল, শানতৈল, লুকলুকি, বারমাসী আমড়া, লটকন, পার্সিমন, আলু বোখারা, তেঁতুল স্থানীয়, মিষ্টি তেঁতুল, করমচা, কাঁঠাল, ডেউয়া ফল, কাউফল, চাপালিস কাঁঠাল, বেদানা লিচু, কাঁঠালী লিচু, লিচু চায়না-৩, লিচু বোম্বাই, ডে-ফল, তৈকর, আঁশফল, কাঁঠ বাদাম, জংলী বাদাম, কাজু বাদাম, অ্যাভোকাডো, সফেদা, বিলাতী গাব, তরমুজ সুইট ব্লাক-২, তরমুজ (মনিয়া), রকমেলন, বাঙ্গি, কামরাঙ্গা, তরমুজ(জেসমিন), জাবাটিকাবা, জাম, জামবুরা, নারিকেল মালয় কিং, ডুমুর, সুপারি, পেঁপে, বেল, খেজুর, পেয়ারা, আঙ্গুর, সাতকরা, কেওড়া, ক্ষদি জাম, কদবেল, কলা পাহাড়ী, তাল, থাই পেয়ারা, ষ্টার আপেল প্রভৃতি ফল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, ‘দেশে বর্তমানে বছরে ৪৬ লাখ টন ফল উৎপাদন হয়। চাহিদা মেটাতে আরও ২২ লাখ টন ফল উৎপাদন করতে হবে।’ মেলায় অঞ্চলভেদে বিভিন্ন ফলের আলাদা স্টল রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উত্তরাঞ্চলের ফল, ভাওয়াল ও মধুপুর গড় অঞ্চলের ফল, উপকূলীয় অঞ্চলের ফল, পাহাড়ি অঞ্চলের ফল এসব ভাগে ফলের পসরা সাজিয়েছে স্টলগুলো।’
সেমিনার ও র্যালি : এদিকে ফলদ বৃক্ষরোপণ পক্ষ ও তিন দিনব্যাপী জাতীয় ফল প্রদর্শনী উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে শুরু হয়ে এক বর্ণাঢ্য র্যালি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এসে শেষ হয়। র্যালি শেষে কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেন, জনগণের পুষ্টির চাহিদা পূরণে ফল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, আগে বছরে চার মাস ফল পাওয়া যেত। এখন ৪০ ভাগ ফল আট মাস পাওয়া যাচ্ছে। এটাকে ৮০ ভাগে উন্নীত করতে হবে। ফল সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। ‘লিচু এখন দুই মাস পাওয়া যায়। এর ব্যাপ্তিকাল বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।’ বিদেশে কাঁচা কাঁঠাল রফতানির চেষ্টা চলছে বলে তারা জানান।